পৃষ্ঠাসমূহ

শনিবার, ৩১ মার্চ, ২০১২

ভারতের দালাল (!), পাকিস্তানের দালাল (!)


বাংলাদেশের বড় দুটো দল নাকি প্রতিবেশী রাষ্ট্রের ‘দালাল’! আওয়ামী লীগকে বিএনপি ও তার মিত্ররা ভারতের সেবাদাস, ভারতের প্রতি নতজানু, ভারতের আজ্ঞাবাহী নামে অভিহিত করে থাকে। সম্প্রতি আওয়ামী লীগের মিত্র দুটো দলের (ওয়ার্কার্স পার্টি ও জাতীয় পার্টি) নেতারাও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রভাবশালী উপদেষ্টাদের ভারতের হয়ে কথা বলার অভিযোগ করেছেন। বিএনপিকে আওয়ামী লীগ পাকিস্তানপন্থী বা আইএসআইয়ের এজেন্ট হিসেবে বর্ণনা করে। তার মিত্র দলগুলোর কোনো কোনো নেতাও একই কথা বলে থাকেন। 
বাংলাদেশের রাজনীতি এখন উত্তাল হয়ে আছে এসব প্রসঙ্গে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে এতে নিয়েছেন নেতৃস্থানীয় ভূমিকা। পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই বিএনপিকে ১৯৯১ সালের নির্বাচনের সময় পাঁচ কোটি রুপি দিয়েছিল এই অসমর্থিত সংবাদ বাংলাদেশে প্রকাশিত হওয়ার পর তিনি এর ভিত্তিতে বিএনপি ও বিরোধী দলের নেত্রীকে আক্রমণ শুরু করেন। তিনি বিএনপির নেত্রী খালেদা জিয়াকে পাকিস্তানপন্থী হিসেবে আখ্যায়িত করে পাকিস্তানে চলে যাওয়ার পরামর্শ দেন এবং ‘আইএসআইয়ের টাকা খাওয়া’ বিএনপিকে আগামী নির্বাচনে ভোট না দিতে জনগণকে আহ্বান জানান। 
বিএনপিকে আইএসআইয়ের টাকা দেওয়ার তথ্য প্রথম আসে খালিজ টাইমস-এ প্রকাশিত আফজাল খান নামের একজন সাংবাদিকের লেখায়। খালিজ টাইমস-এর লেখাটি অবলম্বনে একটি প্রতিবেদন প্রথম আলোতে প্রকাশিত হওয়ার পরপরই এ নিয়ে বিএনপিকে আক্রমণ করা শুরু হয়। যার বরাতে এই সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল সেই আসাদ দুররানি (আইএসআইয়ের সাবেক প্রধান) নিজে বিবিসি এবং বাংলাদেশের দুটো দৈনিককে জানান, তিনি এ ধরনের কোনো কথা পাকিস্তানের আদালতে বলেননি, পাকিস্তানের পররাষ্ট্র দপ্তরও টাকা দেওয়ার সংবাদের সত্যতা নাকচ করে। দেশের শীর্ষস্থানীয় ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টার খালিজ টাইমস-এর সংবাদটি প্রকাশ করেছিল ২৭ মার্চ। তারা এ সংবাদটির সত্যতা এখন পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যায়নি বলে জানায় এবং এটি ছাপানোর জন্য দুঃখ প্রকাশ করে। প্রথম আলোর মশিউল আলম ২৮ মার্চের একটি লেখায় ‘অত্যন্ত স্পর্শকাতর’ এই সংবাদটি প্রকাশের আগে ‘সতর্কভাবে সম্ভাব্য সব উপায়ে তা আরও যাচাই করে দেখা প্রয়োজন ছিল’ বলে স্বীকার করেন। 
এই বিতর্ক এখানেই শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতির যাঁরা নিবিড় পর্যবেক্ষক তাঁরা সম্ভবত জানেন, এটি থামবে না এখানে। এ ধরনের কাদা ছোড়াছুড়ি অব্যাহত থাকবে আরও বহুদিন। বিএনপি বলবে, ইকোনমিস্ট-এ ছাপা হয়েছে, ২০০৮-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে বস্তা বস্তা টাকা দিয়েছিল ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা র। আওয়ামী লীগ বলবে, দেশি-বিদেশি পত্রিকায় ছাপা হয়েছে, আইএসআই টাকা দিয়েছিল বিএনপিকে। 
প্রমাণহীন দোষারোপ ও চরিত্র হরণের রাজনীতি ইতিমধ্যেই দেশের মানুষকে যথেষ্ট বিপর্যস্ত করেছে। কে কার কোলে বসেছে, কার সন্তান চোর, কার বাবা-মা কী ছিলেন—এমনকি কার নানা-নানির নাম কী—এসব নোংরা আক্রমণের পাশাপাশি বড় দুটো দলের কে কোন দেশের টাকা খেয়ে নির্বাচন করেছে—এসব বিতর্ক অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশের রাজনীতির দৈন্য আরও প্রকট হয়ে উঠবে। 

২. 
বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারত ও পাকিস্তান প্রসঙ্গ অপ্রাসঙ্গিক নয়। ১৯৪৭ সালের দেশভাগ আর সে সময়ের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার স্মৃতি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে কোনো কোনো মহলের রাজনীতিতে প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে। আবার ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন আর ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের পর থেকে এ অঞ্চলের প্রতি পাকিস্তানের বঞ্চনা আরও প্রকট হয়ে উঠলে রাজনীতির পরিভাষায় ‘পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী’ চরম নিন্দনীয় বিষয় হয়ে ওঠে। ন্যাপ প্রতিষ্ঠার জন্য মওলানা ভাসানীকে ভারতের দালাল আর ‘৯৬ শতাংশ স্বায়ত্তশাসন অর্জিত হয়েছে’ বলে ঘোষণার জন্য হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে পশ্চিম পাকিস্তানের দালাল হিসেবে সমালোচিত হতে হয়েছে। স্বাধীনতাযুদ্ধকালে গণহত্যাকারী পাকিস্তানি বাহিনী ও তার সহযোগী আলবদর, আলশামস বাহিনী বাংলাদেশের মুুক্তিকামী জনতাকে পাইকারিভাবে ভারতের দালাল হিসেবে অভিহিত করেছে। 
বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পর এসব বিতর্ক প্রশমিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তা হয়নি। দুই নেত্রীর যুগে বরং ক্রমান্বয়ে কে কার দালাল এই বিতর্ক আরও বিস্তারিত হয়েছে। বর্তমান সাফল্য বলে তেমন কিছু নেই বলে দুই নেত্রীর দল নিজ নিজ পূর্বসূরি নেতাকে দেবতার আসনে বসানোর এবং প্রতিপক্ষ পূর্বসূরি নেতাকে ধূলিসাৎ করার চেষ্টা করেছে। এর পাশাপাশি চলেছে একদল কর্তৃক আরেক দলকে ভারত বা পাকিস্তানের দালাল হিসেবে আখ্যায়িত করার প্রতিযোগিতা। একাত্তরের নির্মম বর্বরতার জন্য পাকিস্তানের প্রতি চরম ঘৃণা পোষণ করে এ দেশের সিংহভাগ মানুষ। আবার স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে অব্যাহত বঞ্চনামূলক কর্মকাণ্ডের জন্য ভারতের প্রতিও বৈরী মনোভাব পোষণ করে অনেক মানুষ। ভারত-পাকিস্তানের দালালির কথা বলে মানুষের এই আবেগকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহারের চেষ্টা করা হয়েছে, ক্রমেই তা জোরদার হচ্ছে। 
রাজনীতিবিদেরা নিজেদের এই বিভাজনে বিভক্ত করার চেষ্টা করছে গোটা দেশের মানুষকে। একাত্তরে পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বরতা, এখন পর্যন্ত একাত্তরের গণহত্যার জন্য আনুষ্ঠানিক ক্ষমা না চাওয়া এবং বাংলাদেশের সম্পদ ফেরত না দেওয়ার জন্য পাকিস্তানবিরোধী মনোভাব কাজ করে দেশের যেকোনো সচেতন মানুষের মনে। কিন্তু রাজনীতিবিদেরা যে কথা ভুলে যান তা হচ্ছে, একই মানুষের মনে কাজ করতে পারে ভারতবিরোধী মনোভাবও। বাংলাদেশে স্বাধীনতাযুদ্ধে ভারতের অবিস্মরণীয় অবদান ছিল। কিন্তু সেই ভারতই যখন যৌথ নদী, দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য, সীমান্ত এবং ছিটমহল ইস্যুতে বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী কাজ করে তখন ভারতের প্রতি ক্ষোভ পোষণ করাও স্বাভাবিক বিষয়। যে মানুষ বাংলাদেশকে ভালোবাসে, সে বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী কোনো কাজ যে দেশই করুক, তার সমালোচনা করবে। যে মানুষ ১৯৭১-এর জন্য পাকিস্তানকে চরম ঘৃণা করে, সেই মানুষ তাই বিভিন্ন কারণে ভারতের প্রতিও ক্ষোভ পোষণ করতে পারে। 
আমার মনে হয় না বড় দলের নেতারা এটি উপলব্ধি করতে পারেন। তাঁরা হয়তো ভাবেন, তাঁদের কারও কারও মতো এ দেশের মানুষও শুধু পাকিস্তান বা শুধু ভারতবিরোধী মনোভাব পোষণ করে। এ জন্য একটি দলকে আমরা দেখি শুধু পাকিস্তানের সমালোচনা করতে, অন্য দলের সমর্থকদের পাকিস্তানপন্থী হিসেবে আখ্যায়িত করতে। অন্য দলকে দেখি শুধু ভারতের বিরোধিতা করতে, প্রতিপক্ষ দলের সমর্থকদের ভারতপন্থী হিসেবে ভাবতে। বাংলাদেশকে ক্রমেই যেন তারা পরিণত করতে চাইছেন ভারত বনাম পাকিস্তানের যুদ্ধক্ষেত্রে। 

৩. 
আমি মনে করি না, দেশের সাধারণ মানুষ কে ভারতের দালাল, কে পাকিস্তানের—শুধু এটি বিবেচনা করে ভোট দেয়। তাই যদি হতো তাহলে দেশের প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষ যারা দুই প্রধান দলকে ভোট দেয়, তাদেরও আমাদের বলতে হতো ভারত বা পাকিস্তানের লোক। আওয়ামী লীগের কিছু অসুস্থ মানসিকতার মানুষ বিএনপির সমর্থকদের ঢালাওভাবে পাকিস্তানমনা ভাবতে পারেন, বিএনপির অসুস্থ মানসিকতার ব্যক্তিরা আওয়ামী লীগের সমর্থকদের একইভাবে ভারতমনা ভাবতে পারেন। কিন্তু আমার ধারণা, দেশের সিংহভাগ মানুষ এ ধরনের বিভাজনে বিশ্বাস করে না। ভোট দেওয়ার সময় ভারত বা পাকিস্তান নয়, বাংলাদেশের মানুষের স্বার্থ কতটুকু রক্ষা করা হয়েছে, তাই তাদের প্রধান বিবেচ্য বিষয় থাকে। ধর্মীয় ও রাজনৈতিক সন্ত্রাস, দ্রব্যমূল্য, দলীয়করণ এবং দুর্নীতির কারণে যারা বিএনপির প্রতি চরম ক্ষুব্ধ হয়েছিল তারা ‘নির্বাচিত হলে ভারতের কাছে দেশ বিক্রি করে দেবে আওয়ামী লীগ’ এই আশঙ্কায় আবারও বিএনপিকেই ভোট দিয়েছিল, এটি বিশ্বাস করার কারণ নেই। আবার শেয়ার মার্কেটে যারা সর্বস্বান্ত হয়েছে, দ্রব্যমূল্যে যাদের নাভিশ্বাস উঠেছে, দলীয়করণের কারণে যারা চাকরি, সম্মান বা পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত হয়েছে, সন্ত্রাস যাদের ক্ষুব্ধ করেছে তারা ‘বিএনপি পাকিস্তানের টাকা নিয়েছিল’ এই প্রচারণা শুনে আবারও আওয়ামী লীগকেই ভোট দেবে এটি ধরে নেওয়াও সম্ভবত ভুল হবে। 
আমি মনে করি, ভারত বা পাকিস্তানের দালালির অভিযোগ রাজনীতিতে থাকতে পারে। এটি তথ্যভিত্তিক হলে তাতে আপত্তি করার কিছু নেই। কিন্তু সত্য-মিথ্যার বিবেচনা বাদ দিয়ে শুধু অন্ধ ভারত-পাকিস্তানকেন্দ্রিক প্রচারণায় ঝাঁপিয়ে পড়লেই ভাসমান ভোটারদের অধিকাংশকে প্রভাবিত করে নির্বাচনে জেতা যাবে এমন ভাবনা ঠিক নয়। নির্বাচনে জেতার সহজ উপায় হচ্ছে জনগণের মৌলিক পাঁচটি চাহিদা মেটানো, সুশাসন প্রদান করা, দেশের মানুষের মানবাধিকার রক্ষা করা, দেশের সম্মান বজায় রাখা। সরকারি দলকে প্রমাণ করতে হবে যে আগের সরকারের চেয়ে দৃশ্যমানভাবে তারা এসব ক্ষেত্রে অধিকতর সফল। বিরোধী দলকে মানুষের মনে এই বিশ্বাস জন্মাতে হবে যে নির্বাচিত হলে তারা নিজেদের দুঃশাসনের পুনরাবৃত্তি করবে না এবং বর্তমান সরকারের চেয়ে দেশের মানুষের স্বার্থ ভালোভাবে রক্ষা করবে। 
বড় দুই দল সেই কঠিন চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে কম-বেশি অনীহ। সরকারি দলগুলো তাদের জবাবদিহি ও দায়িত্ব এড়াতে জনগণকে বিভিন্নভাবে আবেগান্ধ করে কাছে টানতেই মরিয়া হয়ে থাকে। 

৪. 
৮২ বছর আগে পলিটিক্যাল কোয়ার্টার্লিতে আলফ্রেড জিমার্ন লিখেছিলেন, আগের পুলিশ রাষ্ট্রে গণতন্ত্রের উদ্দেশ্য ছিল সুবিধাভোগী শ্রেণীর স্বার্থ, সম্পদ ও নিরাপত্তা রক্ষার জন্য প্রশাসন পরিচালনা, কিন্তু এখনকার ইউরোপে গণতন্ত্রের লক্ষ্য হচ্ছে জনকল্যাণের পথে সব বাধা দূর করা, জনগণকে অগণিত ও বিভিন্ন প্রকারের সামাজিক সেবা প্রদান করা। ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশসহ ১২৮টি দেশের অংশগ্রহণের মাধ্যমে ইন্টার-পার্লামেন্টারি ইউনিয়ন যে সর্বজনীন ঘোষণা গ্রহণ করে তাতেও একই ধরনের কথা বলা হয়। 
দেশের মানুষের কল্যাণে বহুলাংশে ব্যর্থ হয়ে রাজনৈতিক দলগুলো যখন কে কার দালাল বা কে কার টাকা খেয়েছিল এ ধরনের বিতর্ককে মুখ্য করে তোলার চেষ্টা করে, তখন মনে হয় গণতন্ত্রের আসল লক্ষ্য খুব বেশি অনুধাবন করতে পারেনি তারা এখনো। 
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

নৃশংস খুনির পক্ষ নিয়েছে রাষ্ট্র (!)

রাষ্ট্রপতিকে প্রশ্ন করা হয়েছে, তিনি কি আইভি রহমানের (তাঁর প্রয়াত স্ত্রী) খুনিদের ক্ষমা করবেন? এ প্রশ্ন নুরুল ইসলামের স্ত্রীর। পাথরের মতো নিশ্চল এ প্রশ্নের কোনো উত্তর রাষ্ট্রপতির দেওয়ার কথা নয়। তিনি এর আগে নাটোরের গামা হত্যাকারীকে ক্ষমা করেছিলেন। এর কিছুদিন পর একই এলাকায় খুন হন গামারই রাজনৈতিক সহকর্মী কমিশনার সানাউল্লাহ নূর। রাষ্ট্রপতি এবার ক্ষমা করেছেন নুরুল ইসলামের খুনিকে। তাঁকে অপহরণ করে টুকরো টুকরো করে নদীতে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন লক্ষ্মীপুরের ত্রাস আবু তাহেরের ‘সুযোগ্য’ পুত্র বিপ্লব। এই পাশবিক হত্যাকাণ্ডে সারা দেশে নিন্দার ঝড় উঠেছিল। নুরুল ইসলামের আতঙ্কিত স্ত্রী এলাকা ছেড়ে পরিবার নিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন ঢাকায়। তিনি ও তাঁর পরিবার এখন নতুন করে বিপর্যস্ত। আমরা পত্রিকায় পড়েছি, তাঁর কিশোরী কন্যা এই সংবাদ পাওয়ার পর থেকে অস্বাভাবিক আচরণ শুরু করেছে। লক্ষ্মীপুরের মানুষের মনেও নতুন আতঙ্ক ভর করেছে। খুনিকে রাষ্ট্রপতি ক্ষমা করে দেওয়ার পর এরই মধ্যে খুনির কর্মীরা লক্ষ্মীপুরে নুরুল ইসলামের স্মৃতিসৌধ ভাঙচুর করে তাদের দাপট প্রদর্শন করেছে। দুই দিন আগে তারা মিছিল করে খুনির জয়গান গেয়েছে।
মহামান্য রাষ্ট্রপতি, আপনি এই রাষ্ট্রের প্রধান হিসেবে কী মেসেজ দিলেন বাংলাদেশের মানুষকে? আওয়ামী লীগের কেউ খুনি হলে, সেই খুন আদালতে প্রমাণিত হলেও তাকে ক্ষমা করে দিতে পারে রাষ্ট্র? নিহত ব্যক্তি, বিশেষ করে বিরোধী দলের হলে তাই খুনিদের আর ভয় পাওয়ার কিছু নেই? এই রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ব্যক্তি আপনি; আপনি আছেন অসীম উদারচিত্তে তাদের কাউকে কাউকে ক্ষমা করে দেওয়ার জন্য? আওয়ামী লীগের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ কর্মীরা এই ভরসায় তাহলে আরও হত্যাকাণ্ডে অনুপ্রাণিত হলে এর নৈতিক দায় আপনি কীভাবে এড়িয়ে যাবেন? এই রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আসনে বসে আপনি কীভাবে আপনার নাগরিকদের মনে ভীতি, ক্ষোভ কিংবা করুণ অসহায়ত্ব জন্ম দেওয়ার মতো কাজ করতে পারেন?
আমরা জানি, এই দায় একমাত্র আপনার নয়। বাংলাদেশের সংবিধান অনুসারে রাষ্ট্রপতিকে দণ্ড মওকুফ বা হ্রাস করার কাজটি করতে হয় প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে। বাংলাদেশের আইন ও রীতি অনুসারে স্বরাষ্ট্র ও আইন মন্ত্রণালয় ক্ষমা প্রদর্শনের প্রাথমিক সম্মতি দিয়ে থাকে। এসব তথ্য আমাদের আরও বিপর্যস্ত করে। কারণ, তা প্রমাণ করে, বাংলাদেশের অন্তত আরও দুজন মন্ত্রী এবং স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর সম্মতি ছিল খুনিকে ক্ষমা করে দেওয়ার জন্য। মহামান্য রাষ্ট্রপতি, তাঁদের অফিসের মাধ্যমে প্রেরিত ফাইল আপনার দপ্তরে গেছে, আপনি স্বাক্ষর করে দিয়েছেন। সংবিধান অনুসারে আনুষ্ঠানিকভাবে আপনার আপত্তি জানানোর সুযোগ ছিল না। কিন্তু সরকার বা রাষ্ট্র পুরোপুরি যান্ত্রিক কোনো বিষয় নয়। অত্যন্ত সম্মানিত একজন নেতা হিসেবে আপনি মৌখিকভাবে আপত্তি জানালে হয়তো প্রধানমন্ত্রী তা বিবেচনায় নিতেন। কে জানে, আপনি হয়তো তা জানিয়েছেনও। কিন্তু আপনারা যে সংবিধান অনুসারে শাসন করেন, তাতে আপনার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর যোগাযোগের কোনো তথ্য জানার অধিকার কারও নেই। সংবিধান অনুসারে আমাদের শুধু ধরে নিতে হবে, প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে আপনি এ কাজটি করেছেন। এই পরামর্শ মানতে অস্বীকৃতি জানালে আপনাকে হয়তো পদত্যাগ করতে হতো একপর্যায়ে। কিন্তু তাতে মানুষের মনে চিরতরে শ্রদ্ধার আসনে অধিষ্ঠিত হতেন আপনি। আপনার একবারও মনে হয়নি, নৃশংস খুনির বিপক্ষে দাঁড়ানোর জন্য প্রয়োজনে এটিই করা উচিত রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ অভিভাবকের?
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছেও আমাদের কিছু প্রশ্ন আছে। আপনার কি সত্যি পরামর্শ ছিল খুনিকে ক্ষমা করে দেওয়ার জন্য? বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচারে কোনো অসংগত হস্তক্ষেপ না করে আপনি বহু মানুষের শ্রদ্ধা পেয়েছেন। হত্যাকারী কয়েকজনের ফাঁসি কার্যকর হওয়ার পর আপনি ও আপনার কিছু মন্ত্রী দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলেছিলেন। বলেছিলেন, হত্যা করে পার পেয়ে যাবে না আর কেউ এ দেশে। গামা আর নুরুল ইসলামের হত্যাকারীরা তাহলে পার পেল কীভাবে? নাকি বিরোধী দলের কাউকে হত্যা করা হলে, খুনি আওয়ামী লীগের কেউ হলে তাকে ক্ষমা করে দেওয়ার কোনো আইন রয়েছে এ দেশে? 

২. 
হ্যাঁ, আমরা জানি, রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইনে অপরাধীকে ক্ষমা করে দেওয়ার বিশেষ অধিকার দেওয়া হয়েছে রাষ্ট্রপতিকে। এই অধিকার পৃথিবীর প্রায় সব সংবিধানে দেওয়া হয়েছে। ইংল্যান্ডে সেই ১৩২৭ সালে তৃতীয় এডওয়ার্ডের অভিষেক উপলক্ষে ঢালাও ক্ষমা করে দেওয়া হয়েছিল বহু অপরাধীকে। কিন্তু সেই যুগ এখন আর নেই। এখন পৃথিবীর বিভিন্ন সংবিধানে (যেমন: আয়ারল্যান্ড, রাশিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা) রাষ্ট্রপতির ক্ষমা করার অধিকারকে নিয়ন্ত্রিত করা হয়েছে বিভিন্ন কমিটির মাধ্যমে বা শর্তারোপ করে। যেখানে সংবিধান এটি করতে পারেনি, সেখানে বিচার বিভাগ (যেমন: ব্রিটেন, আমেরিকা, ভারত) এই ক্ষমতা প্রয়োগে স্বেচ্ছাচারিতা রোধ করতে বিভিন্ন রায় দিয়েছে।
মহামান্য রাষ্ট্রপতি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, একজন অপরাধীকেও ইচ্ছামতো ক্ষমা প্রদানের অধিকার সংবিধান আসলে দেয়নি আপনাদের। ভারতের সংবিধানে প্রায় অবিকল বাংলাদেশের মতো রাষ্ট্রপতি কর্তৃক ক্ষমা করার বিধান রয়েছে। কিন্তু সেখানে ১৯৮০ সালে মারু রাম বনাম ইন্ডিয়া মামলায় বলা হয়, কোনো বিবেচনা বা কাজ সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক, অযৌক্তিক, স্বেচ্ছাচারপ্রসূত বা অসৎ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হতে পারে না। এসব ক্ষেত্রে আদালত রাষ্ট্রপতির ক্ষমা প্রদান ক্ষমতার প্রয়োগের ন্যায্যতা পরীক্ষা করে দেখতে পারে। ১৯৮৯ সালে কেহার সিং মামলায় ভারতের সুপ্রিম কোর্ট বলেছিলেন, কেবল অসংগত হয়রানি ও প্রতীয়মান ভুলের ক্ষেত্রে মার্জনা করার ক্ষমতা প্রয়োগ করা যেতে পারে। ভারতের সংবিধানে এই ক্ষমতা রাজ্যগুলোতে প্রয়োগের অধিকার রয়েছে গভর্নরের। ২০০০ সালে সাতপাল বনাম হরিয়ানা মামলায় সুপ্রিম কোর্ট বলেন, আদালত মার্জনার আদেশ রদ করতে পারেন, যদি গভর্নর রেকর্ডে থাকা তথ্যাবলির দিকে নজর না দিয়ে যান্ত্রিকভাবে আদেশটি প্রদান করে থাকেন।
চাইলে আরও বহু রায় উত্থাপন করা যায়। কোনো রায় রাজনৈতিক বিবেচনায় বা খেয়ালখুশিমতো রাষ্ট্রপতি কর্তৃক ক্ষমা করার অধিকার মেনে নেয়নি। আমেরিকায় জেরাল্ড ফোর্ড এভাবে এই ক্ষমতা প্রয়োগ করে জনগণের ধিক্কার পেয়েছেন। আবার ভারতে প্রতিভা পাতিলকে রাষ্ট্রপতি করার পরিকল্পনার সময় তিনি তাঁর এক জ্ঞাতি ভাইকে খুনের দায় থেকে রেহাই দেবেন বলে যে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছিল, তিনি তা মিথ্যা প্রমাণ করেছেন। আর আমেরিকার বাজে উদাহরণ খুব প্রাসঙ্গিকও নয় আমাদের জন্য। সেখানে মুক্তি পাওয়া অপরাধীদের সার্বক্ষণিক নজরদারির ব্যবস্থা রয়েছে, পুনরায় অপরাধ হলে তা প্রমাণের সুদক্ষ ব্যবস্থা রয়েছে। বাংলাদেশে বিপ্লবেরা পুনরায় হত্যাকাণ্ডে মেতে উঠলে তা ঠেকাবে কে? যাঁরা তাঁকে ক্ষমা করেছেন, তাঁরাই আবার বিচার করবেন তাঁদের? 
৩. 
বিভিন্ন রাষ্ট্রপতির ক্ষমায় বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত কত খুনি, কত অপরাধী জেল থেকে বের হয়ে এসেছে, সেই তথ্য জানা নেই আমাদের। গণমাধ্যমে বিএনপির আমলে দলীয় বিবেচনায় জিন্টু নামের এক খুনিকে ক্ষমা করে দেওয়ার সংবাদ প্রকাশিত হলে তা নিয়ে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছিল দেশে (প্রসঙ্গত বলে রাখি, সে সময় সোচ্চার কিছু মানবাধিকার সংগঠন ও বিশিষ্ট নাগরিক আওয়ামী লীগের আমলের একই ধরনের ঘটনায় এখন পর্যন্ত নিশ্চুপ রয়েছে)। জিন্টুকে ক্ষমা করে দেওয়ার নিন্দা জানিয়ে আওয়ামী লীগের নেতারা একে সংবিধান লঙ্ঘন এবং রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর প্রতিষ্ঠানের জন্য মর্যাদাহানিকর বলেছিলেন। তাঁরা আইনমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদত্যাগও দাবি করেছিলেন। তাঁদের সে সময়ের বক্তব্য নিজেদের সরকারের জন্যও প্রযোজ্য হবে না কেন?
বিএনপির জন্য সেই জঘন্য কাজ করার পক্ষে যুক্তির অভাব হয়নি। তারা বলেছিল, জিন্টু সামরিক আদালতে শাস্তি পেয়েছিল, সেখানে ন্যায়বিচার হয়নি। এখন আওয়ামী লীগের আইন প্রতিমন্ত্রীও বলছেন, বিপ্লব ন্যায়বিচার পাননি। তাঁর মামলার তদন্তকালে বিএনপির নেতারা হস্তক্ষেপ করেছিলেন। তাঁর বক্তব্য শুনে নুরুল ইসলামের আত্মা নিশ্চয় হেসেই খুন হচ্ছে! প্রিয়তম সন্তান আর স্ত্রীর কাছ থেকে চিরতরে কেড়ে নিয়ে তাঁর শরীর টুকরো টুকরো করে নদীতে নিক্ষেপ করা হয়েছিল। এটাই রাষ্ট্রের কাছে ন্যায়বিচার? কসাই খুনির শাস্তি ন্যায়বিচার নয়?
মাননীয় প্রতিমন্ত্রী এবং আরও ক্ষমতাবান ব্যক্তি, বিপ্লবের মামলা তো হাইকোর্টে লড়া যেত। বিএনপি সরকার, পুলিশ আর বিচারিক আদালত যদি তাঁর প্রতি ন্যায়বিচার না করে থাকে, আপনাদের আমলে আপনাদেরই নিয়োগ দেওয়া বহু হাইকোর্টের বিচারপতি তো রয়েছেন। ন্যায়বিচারের জন্য তাঁদের কাছে আপনারা গেলেন না কেন? সর্বোচ্চ আদালতের প্রতিও আস্থা নেই আপনাদের? আর বিচারিক আদালতের প্রতিই বা আপনাদের আস্থা থাকবে না কেন? আপনাদের ভোলা উচিত নয়, বিপ্লবের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের বিবরণ ও সাক্ষ্য দিয়েছিলেন স্বয়ং লক্ষ্মীপুরের আওয়ামী লীগের ও ছাত্রলীগের কিছু নেতা-কর্মীও।

৪. 
এক জিন্টুর কুনজির সামনে রেখে আওয়ামী লীগের রাষ্ট্রপতি আধামেয়াদেই যদি অন্তত তিনটি ক্ষমা (সাজেদা চৌধুরীর পুত্রসহ) করেন, তাহলে আমরা নিশ্চিত থাকতে পারি, ভবিষ্যতের কোনো বিএনপি সরকার আরও কয়েকগুণ বেশি ক্ষমা করে দেবে। কে জানে, বঙ্গবন্ধুর অবশিষ্ট খুনি, আইভি রহমানের সব খুনি আর ২১ আগস্টের বর্বরোচিত হামলার প্রকৃত নায়কদেরও হয়তো ভবিষ্যতের কোনো রাষ্ট্রপতি ক্ষমা করে দেবেন! বলা হবে, তাঁরাও রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়েছিলেন! কে জানে, এমন মিথ্যাচারও হয়তো সইতে হবে আমাদের!
অনুসিদ্ধান্ত হচ্ছে, আওয়ামী লীগ তার নেতা-কর্মীদের খুনের অভিযোগে বিচার করবে না। বিএনপি ক্ষমতায় এসে তাদের ধরে বিচার করবে। পুনরায় আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে তাদের রাষ্ট্রপতি ক্ষমা প্রদান করবেন। বিএনপি ঠিক একই কাজ করবে। দুই দল পালাক্রমে ক্ষমতায় এসে রাজনৈতিক বিবেচনায় মামলা হয়েছে—এ অজুহাতে নিজেদের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে হাজার হাজার মামলা প্রত্যাহার করবে। যেগুলো প্রত্যাহার সম্ভব নয়, সেগুলোর তদন্ত আর বিচারে হস্তক্ষেপ করে নিজেদের লোকজনকে বাঁচানোর চেষ্টা করবে। সেটিও সম্ভব না হলে আইন ও বিচারালয়কে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে রাষ্ট্রপতি তাদের ক্ষমা করে দেবেন! আইন আর বিচার থাকবে শুধু বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের জন্য!
আমরা কি এমন ভয়াবহ এক পরিস্থিতির দিকেই ক্রমাগত ধাবিত হচ্ছি না? 
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।