বাংলাদেশের বড় দুটো দল নাকি প্রতিবেশী রাষ্ট্রের ‘দালাল’! আওয়ামী লীগকে বিএনপি ও তার মিত্ররা ভারতের সেবাদাস, ভারতের প্রতি নতজানু, ভারতের আজ্ঞাবাহী নামে অভিহিত করে থাকে। সম্প্রতি আওয়ামী লীগের মিত্র দুটো দলের (ওয়ার্কার্স পার্টি ও জাতীয় পার্টি) নেতারাও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রভাবশালী উপদেষ্টাদের ভারতের হয়ে কথা বলার অভিযোগ করেছেন। বিএনপিকে আওয়ামী লীগ পাকিস্তানপন্থী বা আইএসআইয়ের এজেন্ট হিসেবে বর্ণনা করে। তার মিত্র দলগুলোর কোনো কোনো নেতাও একই কথা বলে থাকেন।
বাংলাদেশের রাজনীতি এখন উত্তাল হয়ে আছে এসব প্রসঙ্গে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে এতে নিয়েছেন নেতৃস্থানীয় ভূমিকা। পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই বিএনপিকে ১৯৯১ সালের নির্বাচনের সময় পাঁচ কোটি রুপি দিয়েছিল এই অসমর্থিত সংবাদ বাংলাদেশে প্রকাশিত হওয়ার পর তিনি এর ভিত্তিতে বিএনপি ও বিরোধী দলের নেত্রীকে আক্রমণ শুরু করেন। তিনি বিএনপির নেত্রী খালেদা জিয়াকে পাকিস্তানপন্থী হিসেবে আখ্যায়িত করে পাকিস্তানে চলে যাওয়ার পরামর্শ দেন এবং ‘আইএসআইয়ের টাকা খাওয়া’ বিএনপিকে আগামী নির্বাচনে ভোট না দিতে জনগণকে আহ্বান জানান।
বিএনপিকে আইএসআইয়ের টাকা দেওয়ার তথ্য প্রথম আসে খালিজ টাইমস-এ প্রকাশিত আফজাল খান নামের একজন সাংবাদিকের লেখায়। খালিজ টাইমস-এর লেখাটি অবলম্বনে একটি প্রতিবেদন প্রথম আলোতে প্রকাশিত হওয়ার পরপরই এ নিয়ে বিএনপিকে আক্রমণ করা শুরু হয়। যার বরাতে এই সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল সেই আসাদ দুররানি (আইএসআইয়ের সাবেক প্রধান) নিজে বিবিসি এবং বাংলাদেশের দুটো দৈনিককে জানান, তিনি এ ধরনের কোনো কথা পাকিস্তানের আদালতে বলেননি, পাকিস্তানের পররাষ্ট্র দপ্তরও টাকা দেওয়ার সংবাদের সত্যতা নাকচ করে। দেশের শীর্ষস্থানীয় ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টার খালিজ টাইমস-এর সংবাদটি প্রকাশ করেছিল ২৭ মার্চ। তারা এ সংবাদটির সত্যতা এখন পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যায়নি বলে জানায় এবং এটি ছাপানোর জন্য দুঃখ প্রকাশ করে। প্রথম আলোর মশিউল আলম ২৮ মার্চের একটি লেখায় ‘অত্যন্ত স্পর্শকাতর’ এই সংবাদটি প্রকাশের আগে ‘সতর্কভাবে সম্ভাব্য সব উপায়ে তা আরও যাচাই করে দেখা প্রয়োজন ছিল’ বলে স্বীকার করেন।
এই বিতর্ক এখানেই শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতির যাঁরা নিবিড় পর্যবেক্ষক তাঁরা সম্ভবত জানেন, এটি থামবে না এখানে। এ ধরনের কাদা ছোড়াছুড়ি অব্যাহত থাকবে আরও বহুদিন। বিএনপি বলবে, ইকোনমিস্ট-এ ছাপা হয়েছে, ২০০৮-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে বস্তা বস্তা টাকা দিয়েছিল ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা র। আওয়ামী লীগ বলবে, দেশি-বিদেশি পত্রিকায় ছাপা হয়েছে, আইএসআই টাকা দিয়েছিল বিএনপিকে।
প্রমাণহীন দোষারোপ ও চরিত্র হরণের রাজনীতি ইতিমধ্যেই দেশের মানুষকে যথেষ্ট বিপর্যস্ত করেছে। কে কার কোলে বসেছে, কার সন্তান চোর, কার বাবা-মা কী ছিলেন—এমনকি কার নানা-নানির নাম কী—এসব নোংরা আক্রমণের পাশাপাশি বড় দুটো দলের কে কোন দেশের টাকা খেয়ে নির্বাচন করেছে—এসব বিতর্ক অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশের রাজনীতির দৈন্য আরও প্রকট হয়ে উঠবে।
২.
বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারত ও পাকিস্তান প্রসঙ্গ অপ্রাসঙ্গিক নয়। ১৯৪৭ সালের দেশভাগ আর সে সময়ের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার স্মৃতি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে কোনো কোনো মহলের রাজনীতিতে প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে। আবার ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন আর ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের পর থেকে এ অঞ্চলের প্রতি পাকিস্তানের বঞ্চনা আরও প্রকট হয়ে উঠলে রাজনীতির পরিভাষায় ‘পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী’ চরম নিন্দনীয় বিষয় হয়ে ওঠে। ন্যাপ প্রতিষ্ঠার জন্য মওলানা ভাসানীকে ভারতের দালাল আর ‘৯৬ শতাংশ স্বায়ত্তশাসন অর্জিত হয়েছে’ বলে ঘোষণার জন্য হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে পশ্চিম পাকিস্তানের দালাল হিসেবে সমালোচিত হতে হয়েছে। স্বাধীনতাযুদ্ধকালে গণহত্যাকারী পাকিস্তানি বাহিনী ও তার সহযোগী আলবদর, আলশামস বাহিনী বাংলাদেশের মুুক্তিকামী জনতাকে পাইকারিভাবে ভারতের দালাল হিসেবে অভিহিত করেছে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পর এসব বিতর্ক প্রশমিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তা হয়নি। দুই নেত্রীর যুগে বরং ক্রমান্বয়ে কে কার দালাল এই বিতর্ক আরও বিস্তারিত হয়েছে। বর্তমান সাফল্য বলে তেমন কিছু নেই বলে দুই নেত্রীর দল নিজ নিজ পূর্বসূরি নেতাকে দেবতার আসনে বসানোর এবং প্রতিপক্ষ পূর্বসূরি নেতাকে ধূলিসাৎ করার চেষ্টা করেছে। এর পাশাপাশি চলেছে একদল কর্তৃক আরেক দলকে ভারত বা পাকিস্তানের দালাল হিসেবে আখ্যায়িত করার প্রতিযোগিতা। একাত্তরের নির্মম বর্বরতার জন্য পাকিস্তানের প্রতি চরম ঘৃণা পোষণ করে এ দেশের সিংহভাগ মানুষ। আবার স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে অব্যাহত বঞ্চনামূলক কর্মকাণ্ডের জন্য ভারতের প্রতিও বৈরী মনোভাব পোষণ করে অনেক মানুষ। ভারত-পাকিস্তানের দালালির কথা বলে মানুষের এই আবেগকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহারের চেষ্টা করা হয়েছে, ক্রমেই তা জোরদার হচ্ছে।
রাজনীতিবিদেরা নিজেদের এই বিভাজনে বিভক্ত করার চেষ্টা করছে গোটা দেশের মানুষকে। একাত্তরে পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বরতা, এখন পর্যন্ত একাত্তরের গণহত্যার জন্য আনুষ্ঠানিক ক্ষমা না চাওয়া এবং বাংলাদেশের সম্পদ ফেরত না দেওয়ার জন্য পাকিস্তানবিরোধী মনোভাব কাজ করে দেশের যেকোনো সচেতন মানুষের মনে। কিন্তু রাজনীতিবিদেরা যে কথা ভুলে যান তা হচ্ছে, একই মানুষের মনে কাজ করতে পারে ভারতবিরোধী মনোভাবও। বাংলাদেশে স্বাধীনতাযুদ্ধে ভারতের অবিস্মরণীয় অবদান ছিল। কিন্তু সেই ভারতই যখন যৌথ নদী, দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য, সীমান্ত এবং ছিটমহল ইস্যুতে বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী কাজ করে তখন ভারতের প্রতি ক্ষোভ পোষণ করাও স্বাভাবিক বিষয়। যে মানুষ বাংলাদেশকে ভালোবাসে, সে বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী কোনো কাজ যে দেশই করুক, তার সমালোচনা করবে। যে মানুষ ১৯৭১-এর জন্য পাকিস্তানকে চরম ঘৃণা করে, সেই মানুষ তাই বিভিন্ন কারণে ভারতের প্রতিও ক্ষোভ পোষণ করতে পারে।
আমার মনে হয় না বড় দলের নেতারা এটি উপলব্ধি করতে পারেন। তাঁরা হয়তো ভাবেন, তাঁদের কারও কারও মতো এ দেশের মানুষও শুধু পাকিস্তান বা শুধু ভারতবিরোধী মনোভাব পোষণ করে। এ জন্য একটি দলকে আমরা দেখি শুধু পাকিস্তানের সমালোচনা করতে, অন্য দলের সমর্থকদের পাকিস্তানপন্থী হিসেবে আখ্যায়িত করতে। অন্য দলকে দেখি শুধু ভারতের বিরোধিতা করতে, প্রতিপক্ষ দলের সমর্থকদের ভারতপন্থী হিসেবে ভাবতে। বাংলাদেশকে ক্রমেই যেন তারা পরিণত করতে চাইছেন ভারত বনাম পাকিস্তানের যুদ্ধক্ষেত্রে।
৩.
আমি মনে করি না, দেশের সাধারণ মানুষ কে ভারতের দালাল, কে পাকিস্তানের—শুধু এটি বিবেচনা করে ভোট দেয়। তাই যদি হতো তাহলে দেশের প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষ যারা দুই প্রধান দলকে ভোট দেয়, তাদেরও আমাদের বলতে হতো ভারত বা পাকিস্তানের লোক। আওয়ামী লীগের কিছু অসুস্থ মানসিকতার মানুষ বিএনপির সমর্থকদের ঢালাওভাবে পাকিস্তানমনা ভাবতে পারেন, বিএনপির অসুস্থ মানসিকতার ব্যক্তিরা আওয়ামী লীগের সমর্থকদের একইভাবে ভারতমনা ভাবতে পারেন। কিন্তু আমার ধারণা, দেশের সিংহভাগ মানুষ এ ধরনের বিভাজনে বিশ্বাস করে না। ভোট দেওয়ার সময় ভারত বা পাকিস্তান নয়, বাংলাদেশের মানুষের স্বার্থ কতটুকু রক্ষা করা হয়েছে, তাই তাদের প্রধান বিবেচ্য বিষয় থাকে। ধর্মীয় ও রাজনৈতিক সন্ত্রাস, দ্রব্যমূল্য, দলীয়করণ এবং দুর্নীতির কারণে যারা বিএনপির প্রতি চরম ক্ষুব্ধ হয়েছিল তারা ‘নির্বাচিত হলে ভারতের কাছে দেশ বিক্রি করে দেবে আওয়ামী লীগ’ এই আশঙ্কায় আবারও বিএনপিকেই ভোট দিয়েছিল, এটি বিশ্বাস করার কারণ নেই। আবার শেয়ার মার্কেটে যারা সর্বস্বান্ত হয়েছে, দ্রব্যমূল্যে যাদের নাভিশ্বাস উঠেছে, দলীয়করণের কারণে যারা চাকরি, সম্মান বা পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত হয়েছে, সন্ত্রাস যাদের ক্ষুব্ধ করেছে তারা ‘বিএনপি পাকিস্তানের টাকা নিয়েছিল’ এই প্রচারণা শুনে আবারও আওয়ামী লীগকেই ভোট দেবে এটি ধরে নেওয়াও সম্ভবত ভুল হবে।
আমি মনে করি, ভারত বা পাকিস্তানের দালালির অভিযোগ রাজনীতিতে থাকতে পারে। এটি তথ্যভিত্তিক হলে তাতে আপত্তি করার কিছু নেই। কিন্তু সত্য-মিথ্যার বিবেচনা বাদ দিয়ে শুধু অন্ধ ভারত-পাকিস্তানকেন্দ্রিক প্রচারণায় ঝাঁপিয়ে পড়লেই ভাসমান ভোটারদের অধিকাংশকে প্রভাবিত করে নির্বাচনে জেতা যাবে এমন ভাবনা ঠিক নয়। নির্বাচনে জেতার সহজ উপায় হচ্ছে জনগণের মৌলিক পাঁচটি চাহিদা মেটানো, সুশাসন প্রদান করা, দেশের মানুষের মানবাধিকার রক্ষা করা, দেশের সম্মান বজায় রাখা। সরকারি দলকে প্রমাণ করতে হবে যে আগের সরকারের চেয়ে দৃশ্যমানভাবে তারা এসব ক্ষেত্রে অধিকতর সফল। বিরোধী দলকে মানুষের মনে এই বিশ্বাস জন্মাতে হবে যে নির্বাচিত হলে তারা নিজেদের দুঃশাসনের পুনরাবৃত্তি করবে না এবং বর্তমান সরকারের চেয়ে দেশের মানুষের স্বার্থ ভালোভাবে রক্ষা করবে।
বড় দুই দল সেই কঠিন চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে কম-বেশি অনীহ। সরকারি দলগুলো তাদের জবাবদিহি ও দায়িত্ব এড়াতে জনগণকে বিভিন্নভাবে আবেগান্ধ করে কাছে টানতেই মরিয়া হয়ে থাকে।
৪.
৮২ বছর আগে পলিটিক্যাল কোয়ার্টার্লিতে আলফ্রেড জিমার্ন লিখেছিলেন, আগের পুলিশ রাষ্ট্রে গণতন্ত্রের উদ্দেশ্য ছিল সুবিধাভোগী শ্রেণীর স্বার্থ, সম্পদ ও নিরাপত্তা রক্ষার জন্য প্রশাসন পরিচালনা, কিন্তু এখনকার ইউরোপে গণতন্ত্রের লক্ষ্য হচ্ছে জনকল্যাণের পথে সব বাধা দূর করা, জনগণকে অগণিত ও বিভিন্ন প্রকারের সামাজিক সেবা প্রদান করা। ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশসহ ১২৮টি দেশের অংশগ্রহণের মাধ্যমে ইন্টার-পার্লামেন্টারি ইউনিয়ন যে সর্বজনীন ঘোষণা গ্রহণ করে তাতেও একই ধরনের কথা বলা হয়।
দেশের মানুষের কল্যাণে বহুলাংশে ব্যর্থ হয়ে রাজনৈতিক দলগুলো যখন কে কার দালাল বা কে কার টাকা খেয়েছিল এ ধরনের বিতর্ককে মুখ্য করে তোলার চেষ্টা করে, তখন মনে হয় গণতন্ত্রের আসল লক্ষ্য খুব বেশি অনুধাবন করতে পারেনি তারা এখনো।
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
বাংলাদেশের রাজনীতি এখন উত্তাল হয়ে আছে এসব প্রসঙ্গে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে এতে নিয়েছেন নেতৃস্থানীয় ভূমিকা। পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই বিএনপিকে ১৯৯১ সালের নির্বাচনের সময় পাঁচ কোটি রুপি দিয়েছিল এই অসমর্থিত সংবাদ বাংলাদেশে প্রকাশিত হওয়ার পর তিনি এর ভিত্তিতে বিএনপি ও বিরোধী দলের নেত্রীকে আক্রমণ শুরু করেন। তিনি বিএনপির নেত্রী খালেদা জিয়াকে পাকিস্তানপন্থী হিসেবে আখ্যায়িত করে পাকিস্তানে চলে যাওয়ার পরামর্শ দেন এবং ‘আইএসআইয়ের টাকা খাওয়া’ বিএনপিকে আগামী নির্বাচনে ভোট না দিতে জনগণকে আহ্বান জানান।
বিএনপিকে আইএসআইয়ের টাকা দেওয়ার তথ্য প্রথম আসে খালিজ টাইমস-এ প্রকাশিত আফজাল খান নামের একজন সাংবাদিকের লেখায়। খালিজ টাইমস-এর লেখাটি অবলম্বনে একটি প্রতিবেদন প্রথম আলোতে প্রকাশিত হওয়ার পরপরই এ নিয়ে বিএনপিকে আক্রমণ করা শুরু হয়। যার বরাতে এই সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল সেই আসাদ দুররানি (আইএসআইয়ের সাবেক প্রধান) নিজে বিবিসি এবং বাংলাদেশের দুটো দৈনিককে জানান, তিনি এ ধরনের কোনো কথা পাকিস্তানের আদালতে বলেননি, পাকিস্তানের পররাষ্ট্র দপ্তরও টাকা দেওয়ার সংবাদের সত্যতা নাকচ করে। দেশের শীর্ষস্থানীয় ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টার খালিজ টাইমস-এর সংবাদটি প্রকাশ করেছিল ২৭ মার্চ। তারা এ সংবাদটির সত্যতা এখন পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যায়নি বলে জানায় এবং এটি ছাপানোর জন্য দুঃখ প্রকাশ করে। প্রথম আলোর মশিউল আলম ২৮ মার্চের একটি লেখায় ‘অত্যন্ত স্পর্শকাতর’ এই সংবাদটি প্রকাশের আগে ‘সতর্কভাবে সম্ভাব্য সব উপায়ে তা আরও যাচাই করে দেখা প্রয়োজন ছিল’ বলে স্বীকার করেন।
এই বিতর্ক এখানেই শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতির যাঁরা নিবিড় পর্যবেক্ষক তাঁরা সম্ভবত জানেন, এটি থামবে না এখানে। এ ধরনের কাদা ছোড়াছুড়ি অব্যাহত থাকবে আরও বহুদিন। বিএনপি বলবে, ইকোনমিস্ট-এ ছাপা হয়েছে, ২০০৮-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে বস্তা বস্তা টাকা দিয়েছিল ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা র। আওয়ামী লীগ বলবে, দেশি-বিদেশি পত্রিকায় ছাপা হয়েছে, আইএসআই টাকা দিয়েছিল বিএনপিকে।
প্রমাণহীন দোষারোপ ও চরিত্র হরণের রাজনীতি ইতিমধ্যেই দেশের মানুষকে যথেষ্ট বিপর্যস্ত করেছে। কে কার কোলে বসেছে, কার সন্তান চোর, কার বাবা-মা কী ছিলেন—এমনকি কার নানা-নানির নাম কী—এসব নোংরা আক্রমণের পাশাপাশি বড় দুটো দলের কে কোন দেশের টাকা খেয়ে নির্বাচন করেছে—এসব বিতর্ক অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশের রাজনীতির দৈন্য আরও প্রকট হয়ে উঠবে।
২.
বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারত ও পাকিস্তান প্রসঙ্গ অপ্রাসঙ্গিক নয়। ১৯৪৭ সালের দেশভাগ আর সে সময়ের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার স্মৃতি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে কোনো কোনো মহলের রাজনীতিতে প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে। আবার ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন আর ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের পর থেকে এ অঞ্চলের প্রতি পাকিস্তানের বঞ্চনা আরও প্রকট হয়ে উঠলে রাজনীতির পরিভাষায় ‘পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী’ চরম নিন্দনীয় বিষয় হয়ে ওঠে। ন্যাপ প্রতিষ্ঠার জন্য মওলানা ভাসানীকে ভারতের দালাল আর ‘৯৬ শতাংশ স্বায়ত্তশাসন অর্জিত হয়েছে’ বলে ঘোষণার জন্য হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে পশ্চিম পাকিস্তানের দালাল হিসেবে সমালোচিত হতে হয়েছে। স্বাধীনতাযুদ্ধকালে গণহত্যাকারী পাকিস্তানি বাহিনী ও তার সহযোগী আলবদর, আলশামস বাহিনী বাংলাদেশের মুুক্তিকামী জনতাকে পাইকারিভাবে ভারতের দালাল হিসেবে অভিহিত করেছে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পর এসব বিতর্ক প্রশমিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তা হয়নি। দুই নেত্রীর যুগে বরং ক্রমান্বয়ে কে কার দালাল এই বিতর্ক আরও বিস্তারিত হয়েছে। বর্তমান সাফল্য বলে তেমন কিছু নেই বলে দুই নেত্রীর দল নিজ নিজ পূর্বসূরি নেতাকে দেবতার আসনে বসানোর এবং প্রতিপক্ষ পূর্বসূরি নেতাকে ধূলিসাৎ করার চেষ্টা করেছে। এর পাশাপাশি চলেছে একদল কর্তৃক আরেক দলকে ভারত বা পাকিস্তানের দালাল হিসেবে আখ্যায়িত করার প্রতিযোগিতা। একাত্তরের নির্মম বর্বরতার জন্য পাকিস্তানের প্রতি চরম ঘৃণা পোষণ করে এ দেশের সিংহভাগ মানুষ। আবার স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে অব্যাহত বঞ্চনামূলক কর্মকাণ্ডের জন্য ভারতের প্রতিও বৈরী মনোভাব পোষণ করে অনেক মানুষ। ভারত-পাকিস্তানের দালালির কথা বলে মানুষের এই আবেগকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহারের চেষ্টা করা হয়েছে, ক্রমেই তা জোরদার হচ্ছে।
রাজনীতিবিদেরা নিজেদের এই বিভাজনে বিভক্ত করার চেষ্টা করছে গোটা দেশের মানুষকে। একাত্তরে পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বরতা, এখন পর্যন্ত একাত্তরের গণহত্যার জন্য আনুষ্ঠানিক ক্ষমা না চাওয়া এবং বাংলাদেশের সম্পদ ফেরত না দেওয়ার জন্য পাকিস্তানবিরোধী মনোভাব কাজ করে দেশের যেকোনো সচেতন মানুষের মনে। কিন্তু রাজনীতিবিদেরা যে কথা ভুলে যান তা হচ্ছে, একই মানুষের মনে কাজ করতে পারে ভারতবিরোধী মনোভাবও। বাংলাদেশে স্বাধীনতাযুদ্ধে ভারতের অবিস্মরণীয় অবদান ছিল। কিন্তু সেই ভারতই যখন যৌথ নদী, দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য, সীমান্ত এবং ছিটমহল ইস্যুতে বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী কাজ করে তখন ভারতের প্রতি ক্ষোভ পোষণ করাও স্বাভাবিক বিষয়। যে মানুষ বাংলাদেশকে ভালোবাসে, সে বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী কোনো কাজ যে দেশই করুক, তার সমালোচনা করবে। যে মানুষ ১৯৭১-এর জন্য পাকিস্তানকে চরম ঘৃণা করে, সেই মানুষ তাই বিভিন্ন কারণে ভারতের প্রতিও ক্ষোভ পোষণ করতে পারে।
আমার মনে হয় না বড় দলের নেতারা এটি উপলব্ধি করতে পারেন। তাঁরা হয়তো ভাবেন, তাঁদের কারও কারও মতো এ দেশের মানুষও শুধু পাকিস্তান বা শুধু ভারতবিরোধী মনোভাব পোষণ করে। এ জন্য একটি দলকে আমরা দেখি শুধু পাকিস্তানের সমালোচনা করতে, অন্য দলের সমর্থকদের পাকিস্তানপন্থী হিসেবে আখ্যায়িত করতে। অন্য দলকে দেখি শুধু ভারতের বিরোধিতা করতে, প্রতিপক্ষ দলের সমর্থকদের ভারতপন্থী হিসেবে ভাবতে। বাংলাদেশকে ক্রমেই যেন তারা পরিণত করতে চাইছেন ভারত বনাম পাকিস্তানের যুদ্ধক্ষেত্রে।
৩.
আমি মনে করি না, দেশের সাধারণ মানুষ কে ভারতের দালাল, কে পাকিস্তানের—শুধু এটি বিবেচনা করে ভোট দেয়। তাই যদি হতো তাহলে দেশের প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষ যারা দুই প্রধান দলকে ভোট দেয়, তাদেরও আমাদের বলতে হতো ভারত বা পাকিস্তানের লোক। আওয়ামী লীগের কিছু অসুস্থ মানসিকতার মানুষ বিএনপির সমর্থকদের ঢালাওভাবে পাকিস্তানমনা ভাবতে পারেন, বিএনপির অসুস্থ মানসিকতার ব্যক্তিরা আওয়ামী লীগের সমর্থকদের একইভাবে ভারতমনা ভাবতে পারেন। কিন্তু আমার ধারণা, দেশের সিংহভাগ মানুষ এ ধরনের বিভাজনে বিশ্বাস করে না। ভোট দেওয়ার সময় ভারত বা পাকিস্তান নয়, বাংলাদেশের মানুষের স্বার্থ কতটুকু রক্ষা করা হয়েছে, তাই তাদের প্রধান বিবেচ্য বিষয় থাকে। ধর্মীয় ও রাজনৈতিক সন্ত্রাস, দ্রব্যমূল্য, দলীয়করণ এবং দুর্নীতির কারণে যারা বিএনপির প্রতি চরম ক্ষুব্ধ হয়েছিল তারা ‘নির্বাচিত হলে ভারতের কাছে দেশ বিক্রি করে দেবে আওয়ামী লীগ’ এই আশঙ্কায় আবারও বিএনপিকেই ভোট দিয়েছিল, এটি বিশ্বাস করার কারণ নেই। আবার শেয়ার মার্কেটে যারা সর্বস্বান্ত হয়েছে, দ্রব্যমূল্যে যাদের নাভিশ্বাস উঠেছে, দলীয়করণের কারণে যারা চাকরি, সম্মান বা পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত হয়েছে, সন্ত্রাস যাদের ক্ষুব্ধ করেছে তারা ‘বিএনপি পাকিস্তানের টাকা নিয়েছিল’ এই প্রচারণা শুনে আবারও আওয়ামী লীগকেই ভোট দেবে এটি ধরে নেওয়াও সম্ভবত ভুল হবে।
আমি মনে করি, ভারত বা পাকিস্তানের দালালির অভিযোগ রাজনীতিতে থাকতে পারে। এটি তথ্যভিত্তিক হলে তাতে আপত্তি করার কিছু নেই। কিন্তু সত্য-মিথ্যার বিবেচনা বাদ দিয়ে শুধু অন্ধ ভারত-পাকিস্তানকেন্দ্রিক প্রচারণায় ঝাঁপিয়ে পড়লেই ভাসমান ভোটারদের অধিকাংশকে প্রভাবিত করে নির্বাচনে জেতা যাবে এমন ভাবনা ঠিক নয়। নির্বাচনে জেতার সহজ উপায় হচ্ছে জনগণের মৌলিক পাঁচটি চাহিদা মেটানো, সুশাসন প্রদান করা, দেশের মানুষের মানবাধিকার রক্ষা করা, দেশের সম্মান বজায় রাখা। সরকারি দলকে প্রমাণ করতে হবে যে আগের সরকারের চেয়ে দৃশ্যমানভাবে তারা এসব ক্ষেত্রে অধিকতর সফল। বিরোধী দলকে মানুষের মনে এই বিশ্বাস জন্মাতে হবে যে নির্বাচিত হলে তারা নিজেদের দুঃশাসনের পুনরাবৃত্তি করবে না এবং বর্তমান সরকারের চেয়ে দেশের মানুষের স্বার্থ ভালোভাবে রক্ষা করবে।
বড় দুই দল সেই কঠিন চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে কম-বেশি অনীহ। সরকারি দলগুলো তাদের জবাবদিহি ও দায়িত্ব এড়াতে জনগণকে বিভিন্নভাবে আবেগান্ধ করে কাছে টানতেই মরিয়া হয়ে থাকে।
৪.
৮২ বছর আগে পলিটিক্যাল কোয়ার্টার্লিতে আলফ্রেড জিমার্ন লিখেছিলেন, আগের পুলিশ রাষ্ট্রে গণতন্ত্রের উদ্দেশ্য ছিল সুবিধাভোগী শ্রেণীর স্বার্থ, সম্পদ ও নিরাপত্তা রক্ষার জন্য প্রশাসন পরিচালনা, কিন্তু এখনকার ইউরোপে গণতন্ত্রের লক্ষ্য হচ্ছে জনকল্যাণের পথে সব বাধা দূর করা, জনগণকে অগণিত ও বিভিন্ন প্রকারের সামাজিক সেবা প্রদান করা। ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশসহ ১২৮টি দেশের অংশগ্রহণের মাধ্যমে ইন্টার-পার্লামেন্টারি ইউনিয়ন যে সর্বজনীন ঘোষণা গ্রহণ করে তাতেও একই ধরনের কথা বলা হয়।
দেশের মানুষের কল্যাণে বহুলাংশে ব্যর্থ হয়ে রাজনৈতিক দলগুলো যখন কে কার দালাল বা কে কার টাকা খেয়েছিল এ ধরনের বিতর্ককে মুখ্য করে তোলার চেষ্টা করে, তখন মনে হয় গণতন্ত্রের আসল লক্ষ্য খুব বেশি অনুধাবন করতে পারেনি তারা এখনো।
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।