পৃষ্ঠাসমূহ

শনিবার, ২৩ জুন, ২০১২

মন্ত্রীরা কখনো দুর্নীতি করেন না!


বিষয়বুদ্ধির তোড়ে আমরা তাদের তাড়িয়ে দিতে পারলাম। এই দুঃখ রাখি কোথায়?
বিষয়বুদ্ধির তোড়ে আমরা তাদের তাড়িয়ে দিতে পারলাম। এই দুঃখ রাখি কোথায়?
আসিফ নজরুল

বাংলাদেশে গালভরা নামের কিছু প্রতিষ্ঠান আগেও ছিল। এখন এর সংখ্যা বেড়েছে। এ দেশে মানবাধিকার কমিশন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তার কিছুদিনের মধ্যে ক্রসফায়ারের পরিবর্তে গুমের তাণ্ডব শুরু হয়েছে। তথ্য কমিশন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সরকারের তথ্য গোপনের সংস্কৃতি জোরদার হয়েছে। দুর্নীতি দমন ব্যুরো প্রায় এক যুগ হলো দুর্নীতি দমন কমিশনে পরিণত হয়েছে। সেই কমিশন সবচেয়ে বেশি আলোচিত হচ্ছে দুর্নীতি হয়নি এই সার্টিফিকেট দেওয়ার জন্য। যাকে-তাকে নয়, এই সার্টিফিকেট দেওয়া হয়েছে সেই মন্ত্রীদের, যাঁরা দুর্নীতি করেননি—এ কথা বিশ্বাস করার মতো লোক খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।
মানবাধিকার আর তথ্য কমিশন শৈশব অবস্থা অতিক্রম করছে। কিন্তু দুর্নীতি দমন কমিশন বা দুদক সম্পর্কে তা বলার উপায় নেই। দুদকের ইতিহাস বহু পুরোনো, এর শিকড় ১৯৪৩ সালে ইস্ট বেঙ্গল ফুড রেশনিং ব্যবস্থায় দুর্নীতির তদন্তের জন্য গঠিত এনফোর্সমেন্ট ব্রাঞ্চ পর্যন্ত বিস্তৃত। নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে ২০০৪ সালে আইনের মাধ্যমে এটি প্রায় স্বাধীন ও উল্লেখযোগ্য ক্ষমতাসম্পন্ন একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। সরকার চাইলে দুর্নীতি দমন কমিশন কতটা কর্মতৎপর হতে পারে, তা আমরা দেখেছিলাম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে। মাত্র কয়েক মাসে দুর্নীতিবাজদের জন্য এই কমিশন ত্রাসে পরিণত হয়েছিল। এ সময়ে দুদক একাই দেড় বছরে ৩৪১টি মামলা করেছিল, যার অধিকাংশ ছিল প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে। ১৫৬টি মামলায় তখন বিচার সম্পন্ন করে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের কারাদণ্ডে দণ্ডিতও করা হয়েছিল।
দুদকের সেই হাঁকডাক আর নেই। কমিশনের প্রধান নিজেই এই কমিশনকে দন্তহীন বাঘের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। ক্যাবিনেট কমিটি ২০১০ সালে কিছু আইনগত সংশোধনীর পক্ষে মত দিলে দুদক নামের বাঘের নখরও খসে পড়বে—এই আশঙ্কা ব্যক্ত করা হয়েছিল। সেই সংশোধনী আইনসভায় পাস হবে কি হবে না, এই দোলাচলে দুদক দীর্ঘদিন প্রায় স্থবির হয়ে ছিল। এর মধ্যে দুদকের নতুন সদস্যরা এসেছেন, কর্মকর্তা পর্যায়েও এমন কাউকে কাউকে নিয়ে আসা হয়েছে, যাঁদের সঙ্গে সরকারের ঘনিষ্ঠতার অভিযোগ রয়েছে। বড় দুর্নীতিবাজ দূরের কথা, পুলিশের সাধারণ কর্মচারীদের বিরুদ্ধে দুদকের তদন্ত এখন শেষ হয় না বছর পেরোলেও।

২.
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলের পরাক্রমশালী একটি প্রতিষ্ঠান এভাবে মুখ থুবড়ে পড়ল কেন? এর নানা ব্যাখ্যা নানাজন দিয়েছেন। আসলে পতনের বীজ রোপিত হয়েছিল এর উত্তরণকালেই। অভিযোগ আছে যে এক-এগারোর নেপথ্য নায়কেরা দুদক ও বিশেষ আদালতের মাধ্যমে যতটা দুর্নীতি দমনে আন্তরিক ছিলেন, তার চেয়ে বেশি আগ্রহী ছিলেন ঢালাওভাবে রাজনীতিবিদদের হেয় করতে। পদ্ধতি না মেনে তড়িঘড়ি মামলা দায়ের, আগ্রাসী তদন্ত, ঢালাওভাবে জামিন নাকচ, বিচারকালে অনিয়ম, রাজনীতিবিদের সন্তানদের নির্বিচারে গ্রেপ্তার ইত্যাদি ঘটনার মধ্য দিয়ে দুর্নীতিবিরোধী কার্যক্রম তখনই অনেকটা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে। এর পুরোপুরি সুযোগ গ্রহণ করেন মূলত সেই সব রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও আমলা, যাঁরা গত নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতার লাগাম হাতে ফিরে পান।
এক-এগারোর পর ক্ষমতায় এসে সরকার যেসব প্রতিষ্ঠানকে দুর্বল করার পদক্ষেপ গ্রহণ করে, সেসবের মধ্যে দুদক ছিল অন্যতম। ক্ষমতার প্রথম দুই বছরে সরকারের মন্ত্রীদের দুর্নীতির বড় কোনো খবর পত্রিকায় প্রকাশিত হয়নি। দুদকের শক্তি হ্রাস নিয়ে তাই তখন ব্যাপক উৎকণ্ঠা প্রকাশ করা হয়নি। কিন্তু গত এক বছরে দুর্নীতির কিছু অভিযোগ দেশে-বিদেশে আলোড়ন তোলার পর দুদকের ভূমিকা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন উত্থাপিত হচ্ছে। বিশেষ করে, দুর্নীতির দায়ে ব্যাপকভাবে অভিযুক্ত মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের বিষয়ে বিশ্বব্যাংক নির্দিষ্ট কিছু তথ্য দেওয়ার পর দুদকের কাছে এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ তার তলানিতে ঠেকানো ইমেজকে রক্ষা করা। দুদক কি পারবে তা? নাকি পূর্বসূরিদের মতো দুদকও এটিই প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করবে যে বাংলাদেশে বিদ্যমান সরকারের মন্ত্রীরা কখনো দুর্নীতি করেন না? দুদকও কি বলবে যে আগের সরকারের সবাই চোর হতে পারে, কিন্তু বর্তমান সরকারের সবাই সাধু!

৩. 
বর্তমান সরকারের মন্ত্রীদের মধ্যে প্রথম দুর্নীতির অভিযোগ আসে সম্ভবত মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রীর বিরুদ্ধে। অভিযোগকারী ছিলেন মন্ত্রণালয়েরই একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। তারপর পাটমন্ত্রী, তৎকালীন বাণিজ্যমন্ত্রী, নৌপরিবহনমন্ত্রী, জ্বালানি উপদেষ্টা, শিল্পমন্ত্রী, সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী, সাবেক রেলমন্ত্রীসহ বিভিন্ন মন্ত্রীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে বিভিন্ন পদক্ষেপ বা বিচ্যুতির মাধ্যমে দুর্নীতিবান্ধব একটি পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয়।
এমন পরিস্থিতির কিছু উদাহরণ দিই। প্রথমত, সরকারপ্রধান নির্বাচন চলাকালীন মন্ত্রী ও সাংসদদের সম্পত্তির বার্ষিক বিবরণী দেওয়ার ঘোষণা দেওয়ার পরও এ থেকে তাঁরা বিরত থাকেন। দ্বিতীয়ত, শেয়ারবাজারে লুটপাটের ঘটনায় একজন মন্ত্রীর পরিবার ও সরকারি দলের কয়েকজন নেতার সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ সরকারের গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে আসার পরও তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণে সরকার বিরত থাকে। তৃতীয়ত, বিনা টেন্ডারে বহুল বিতর্কিত কুইক রেন্টাল পদ্ধতিতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের কাজ সরকারের কাছের লোকজনকে প্রদান করার সন্দেহজনক কার্যক্রমকে তদন্তের ঊর্ধ্বে রাখার জন্য আগেই দায়মুক্তি আইন পাস করা হয়। চতুর্থত, প্রকিউরমেন্ট রুল সংশোধন করে বিনা অভিজ্ঞতা ও বিনা দক্ষতায় দুই কোটি টাকা পর্যন্ত প্রকল্পের কাজ পাওয়ার ব্যবস্থা করে সরকার তার লোকজনকে অবাধে কাজ পাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়। পঞ্চমত, টেলিকমিউনিকেশন অ্যাক্ট, ২০১০-এর মাধ্যমে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসির ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে মন্ত্রণালয়কে দিয়ে দেওয়া হয়। এর পরপরই দেশে অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসার হিড়িক পড়ার সংবাদ প্রকাশিত হতে থাকে, এর সঙ্গে অত্যন্ত প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ ওঠে। ষষ্ঠত, প্রতিবছর বাজেটে কালোটাকা সাদা করা এবং অবাধে বিনিয়োগ করার সুযোগ দিয়ে দুর্নীতির মাধ্যমে উপার্জিত অর্থ আড়াল করার বিশাল সুযোগ সৃষ্টি করা হয়।
রাষ্ট্রের যেসব প্রতিষ্ঠান দুর্নীতি নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারবে, সেখানেও চলে নানা হস্তক্ষেপ। যেমন, উচ্চ আদালতে নিয়োগ এবং নিম্ন আদালতে পোস্টিংয়ে দলীয়করণের ব্যাপক অভিযোগ ওঠে। সংসদের সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক কমিটির (যেমন, পাবলিক অ্যাকাউন্ট কমিটি বা অর্থ মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি) দায়িত্ব দেওয়া হয় দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের।
প্রতিষ্ঠান হিসেবে দুর্নীতি দমনে সবচেয়ে প্রত্যক্ষ প্রতিষ্ঠান দুদকের শক্তিও খর্ব করা হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে কমিশনের স্বাধীনতা ও তদন্তকালীন সক্ষমতা বৃদ্ধি করে এবং এর এখতিয়ার বাড়িয়ে (যেমন, মানি-লন্ডারিং অ্যাক্টের অধীনে অপরাধ তদন্ত করার ক্ষমতা) দুটো সংশোধনী অর্ডিন্যান্স আকারে গ্রহণ করা হয়। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসে সেগুলো নাকচ করে দেয়। এমনকি সরকার এমন কিছু সংশোধনীর উদ্যোগ নেয়, যা কার্যকর হলে দুদকের দুর্নীতি দমন অভিযান ম্রিয়মাণ হতে বাধ্য। যেমন, সংশোধনীতে প্রস্তাব করা হয় যে সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতির তদন্তের জন্য কমিশনকে সরকারের পূর্বানুমোদন নিতে হবে। এ ছাড়া প্রস্তাবিত সংশোধনীতে কমিশনের চেয়ারম্যানের কিছু ক্ষমতা সরকার কর্তৃক নিয়োগ পাওয়া সচিবকে অর্পণ, রাষ্ট্রপতির (আসলে প্রধানমন্ত্রী) কাছে কমিশনের জবাবদিহি ও দুর্নীতির মামলা মিথ্যা হলে উল্টো অভিযোগকারীকে কারাদণ্ডের বিধানের কথা বলা হয়। নাগরিক সমাজের চাপের মুখে পূর্বানুমোদনের বিধানটি প্রত্যাহার করা হলেও বাকি আপত্তিকর বিষয়গুলোতে সরকারের অবস্থান এখনো পরিষ্কার নয়। 
দুদককে হেয় ও দর্শনগতভাবে দুর্বল করার সবচেয়ে বড় পদক্ষেপটি নেওয়া হয় ঢালাওভাবে ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে সব দুর্নীতির মামলা প্রত্যাহার করে। এর মধ্যে কিছু হয়রানিমূলক মামলা হয়তো ছিল, কিন্তু কিছু মামলা, বিশেষ করে জ্ঞাত উৎসবহির্ভূত সম্পত্তিসংক্রান্ত মামলাগুলো ছিল অত্যন্ত বিশ্বাসযোগ্য। সরকার তার লোকদের বিরুদ্ধে তত্ত্বাবধায়কের আমলে দায়ের করা এসব মামলা নির্বিচারে প্রত্যাহার করলেও বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে সব মামলা জারি রাখে। আর এর মাধ্যমেই সম্ভবত দুদককে কীভাবে কাজ করতে হবে, তার একটি অলিখিত নির্দেশনা সরকার দিয়ে দেয়। দুদক সেই নির্দেশনা ভালোভাবেই পড়তে পেরেছে মনে হয়। গত তিন বছরে কোনো মন্ত্রী বা এই সরকারের আমলের প্রভাবশালী আমলা ও বড় ব্যবসায়ীর দুর্নীতির কোনো হদিস তারা পায়নি; বরং সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বা আবুল হোসেনের মতো মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে পারিপার্শ্বিক প্রমাণ বা সুনির্দিষ্ট তথ্য থাকার পরও দুদককে দেখা গেছে এদের নির্দোষ হিসেবে তুলে ধরার প্রচেষ্টায় অবদান রাখতে।

৪. 
পদ্মা সেতু প্রকল্পে সৈয়দ আবুল হোসেন এবং প্রভাবশালী দুজন আমলার বিরুদ্ধে ঘুষ দাবি করার প্রস্তাব-সংক্রান্ত কানাডার পুলিশের দেওয়া তথ্য বিশ্বব্যাংক দুদককে দিয়েছে। দুদক কি সঠিকভাবে তদন্ত করবে এসব? সেই ক্ষমতা, সৎসাহস ও স্বাধীনতা কি আছে তাদের? ইতিমধ্যে দুদক ঘুষ-প্রস্তাব বিষয়ে কানাডা ও বাংলাদেশের আইনের দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য এবং অভিযুক্ত ব্যক্তিদের নাম প্রকাশ না করার পক্ষে যেসব বক্তব্য রাখছে, তাতে আশঙ্কা প্রকাশ করার কারণ আছে—এই তদন্ত সঠিকভাবে হবে না। ক্ষমতাসীন সরকারের মন্ত্রীরা দুর্নীতি করেন—এই বার্তা দুদকের পূর্বসূরিরা যেমন কখনো দিতে পারেনি, বর্তমান দুদক এর ব্যতিক্রম হবে বলে বিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই।
যদি তাই হয়, তাহলে আমাদের দেশে দুর্নীতির প্রকোপ কখনোই কমবে না। আওয়ামী লীগ সরকারের আগের আমলে আমরা দুর্নীতিতে প্রথমবারের মতো বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়েছিলাম। পরের বিএনপি সরকার সেই কুখ্যাতি পর পর চার বছর ধরে রেখে ব্যাপকভাবে নিন্দিত হয়েছিল। এখন আমরা দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন না হলেও শীর্ষস্থানীয়। তবে দুদককে যেভাবে চালিত করা হচ্ছে এবং একই সঙ্গে রাষ্ট্রের অন্যান্য জবাবদিহির প্রতিষ্ঠান যেভাবে কাজ করছে, তাতে অচিরেই এই চ্যম্পিয়নশিপের কুখ্যাতি আবার এই জাতির ঘাড়ে নেমে আসতে পারে!
 আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

রবিবার, ১০ জুন, ২০১২

আমাদের রক্ষা করবে কে


আসিফ নজরুল

অধিকাংশ বাঙালির মতো আমি বলতে ভালোবাসি। কিন্তু আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারের সামনে গেলে আমার শুধু শুনতে ইচ্ছে করে। তিনি কেতাবের কথা বলেন, তার চেয়ে অনেক বেশি বলেন নিজস্ব দর্শনের কথা। নিজের মতো চিন্তা করতে পারা এবং কঠিন বিষয় হাস্যরসের মাধ্যমে সহজ করে বলতে পারার দুটি দুর্লভ ক্ষমতা তাঁর রয়েছে। তার আরেকটি অসাধারণ গুণ হলো অগ্নিগর্ভ বিষয়েও অতি মার্জিতভাবে কথা বলতে পারা।
স্যারের সঙ্গে আমার ভালো করে আলাপ হয় না অনেক দিন। টেলিভিশনের একটি অনুষ্ঠানে অংশ নিতে গিয়ে শুনি, তিনি নাকি সাংসদদের আচরণকে চোর-ডাকাতের সঙ্গে তুলনা করেছেন। আমার উচিত ছিল প্রথমেই এতে সন্দেহ পোষণ করা। কারণ, এ ধরনের কথা বলার মতো মানুষ তিনি কখনোই না। এ ধরনের বক্তব্য দূরের কথা, কোনো তীব্র কথা এমনকি শোনার মানসিকতাও তাঁর নেই। কিন্তু তাঁর ‘বক্তব্য’ নিয়ে সংসদে আলোচনা হয়েছে। যে ভদ্রলোক সেদিন স্পিকারের দায়িত্ব পালন করেছেন, তিনি পর্যন্ত বলেছেন তাঁকে এ জন্য সংসদে তলব করা হবে এবং দাঁড়িয়ে ক্ষমা চাইতে হবে।
পরে আমরা প্রমাণ পেলাম তাঁর বয়ানে সম্পূর্ণ মিথ্যা বক্তব্য একটি পত্রিকা ছেপেছিল এবং কিছু সাংসদ সেই পত্রিকার সংবাদের ভিত্তিতে তাঁর প্রতি নিষ্ঠুর এবং অবমাননাকর মন্তব্য করেছেন। সাংসদ শেখ সেলিম, যিনি একসময় তাঁরই ছাত্র ছিলেন, তিনি তাঁর আর্থিক সততা নিয়ে পর্যন্ত প্রশ্ন তুলেছেন। সায়ীদ স্যার কোনো দিন আমাদেরও যা বলেননি, তা-ই জানিয়ে দিলেন বাধ্য হয়ে: এই বিশ্বখ্যাত মানুষটি থাকেন দুই কামরার বাসায় এবং ম্যাগসাইসাই পুরস্কার না পেলে তাঁর হয়তো চিকির‌্যাসাও করা হতো না ঠিকমতো।
আমাদের সাংসদদের উচিত ছিল সংসদের কার্যবিবরণী থেকে তাঁদের অন্যায় ও অসত্য বক্তব্যগুলো বাদ দেওয়া, সায়ীদ স্যারের কাছে দুঃখ প্রকাশ করা এবং যে পত্রিকা মিথ্যা খবর ছেপেছে, ওই পত্রিকার বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া। সংসদ তা এখনো করেনি, এমনকি সায়ীদ স্যারের একসময়ের ছাত্র শেখ সেলিম পর্যন্ত তাঁর কাছে ক্ষমা চাননি। বাংলাদেশে সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে সম্মানিত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কুর‌্যাসা রটনা, বিষোদ্গার কিংবা অশ্রদ্ধামূলক মন্তব্যের যে প্রবণতা আমরা লক্ষ করছি, সাম্প্রতিক সময়ে তাই যেন স্বাভাবিক চিত্র হতে চলেছে দেশে। 
আমাদের কারও প্রতি কারও শ্রদ্ধা নেই, কেউ কাউকে সম্মান জানাতে রাজি নয়, বাক্যসন্ত্রাসের এক অমানিশা যেন গ্রাস করছে আমাদের জীবন আর জগর‌্যা। বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ, বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, ড. মুহাম্মদ ইউনূস, ড. কামাল হোসেন, সবশেষে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ—আলোকবর্তিকার মতো যে মানুষদের আদর্শে জীবন গড়া উচিত আমাদের তরুণ প্রজন্মের, তাঁদের পর্যন্ত খাটো করে তোলার জন্য কুর‌্যাসা রটনা হয়েছে। কারও কারও বিরুদ্ধে সমালোচনা করা হয়েছে জাতীয় সংসদে।
বিশেষ অধিকারবলে সংসদ ‘ফ্রি স্টাইল’ কথা বলার জায়গা, এখানে কমবেশি কিছু বাক্যবাণ হয়তো মেনে নেওয়া যায়। কিন্তু আমরা দেখেছি সমাজের সম্মানিত ও দায়িত্বশীল মানুষ অপদস্থ হয়েছেন এমনকি উচ্চ আদালতের মতো প্রতিষ্ঠানে, যেখানে বিচারকদের অন্যতম দায়িত্ব হচ্ছে বাকসংযম, নিরপেক্ষতা এবং উচ্চ আদালতের সুমহান প্রাতিষ্ঠানিক মর্যাদা বজায় রাখা।
এখন আমরা স্বয়ং সংসদ ও উচ্চ আদালত কর্তৃক একে অপরকে আক্রমণ করতে দেখছি। স্পিকারকে অজ্ঞ ও অল্প বিদ্যা ভয়ংকরী বলা হয়েছে, তাঁর একটি বক্তব্যকে রাষ্ট্রদ্রোহের শামিল বলা হচ্ছে। যে বিচারক এটি বলেছেন, তাঁকে মানসিক বিকারগ্রস্ত ও স্যাডিস্ট বলা হয়েছে সংসদে। সংবিধান লঙ্ঘনকারী হিসেবে তাঁর অভিশংসনের দাবি উঠেছে সংসদে।
এই পরিস্থিতি যেকোনো নাগরিককে হতাশ করার মতো। এর মধ্য দিয়ে জনগণের কাছে দুটি প্রতিষ্ঠানেরই মর্যাদাহানি হয়েছে। প্রধান বিচারপতি এবং স্পিকার উদ্যোগ নিয়ে হয়তো এই বিশেষ পরিস্থিতি সামাল দিতে পারবেন। দুটি শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান নিজেদের স্বার্থেই হয়তো পারস্পরিক সংঘাত এড়াতে পারবেন। কিন্তু সাধারণ নাগরিকদের, বিশেষ করে স্বাধীন মত প্রকাশের মাধ্যমে বা কর্মগুণে যাঁরা মানুষের কাছে শ্রদ্ধার আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছেন, অশালীন কিংবা অসম্মানজনক বাক্যবাণ থেকে তাঁদের রক্ষা করবে কে?

২. 
আমরা ভুলে যাই যে শালীনতা, সৌজন্যবোধ এবং মার্জিত ব্যবহারের বাধ্যবাধকতা রয়েছে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সব প্রতিষ্ঠানের জন্য। সাংসদেরা তাঁদের অবাধ বাক্স্বাধীনতা-সংক্রান্ত বিশেষ অধিকারের কথা বলেন। ব্রিটিশ পার্লামেন্টে গৃহীত ১৬৬৯ সালের বিল অব রাইটসের ৯ম অনুচ্ছেদ অনুসারে অধিকাংশ দেশের মতো বাংলাদেশেও সাংসদদের অবাধ বাক্স্বাধীনতার অধিকার রয়েছে। তবে আমাদের মনে রাখতে হবে বিল অব রাইটসের সেই অনুচ্ছেদেও বলা হয়েছিল যে স্বয়ং পার্লামেন্টে এ বিষয়ে প্রশ্ন তোলা বা বাধা সৃষ্টি করা যাবে।
আমাদের জাতীয় সংসদ পরিচালনা-সংক্রান্ত কার্যপ্রণালি বিধির বিভিন্ন জায়গায়ও সাংসদদের বাক্স্বাধীনতার ক্ষেত্রে কিছু সীমারেখা টানা হয়েছে। যেমন, আইন-আদালতে বিচারাধীন বিষয়ে মন্তব্য থেকে শুরু করে যে কারও সম্পর্কে আক্রমণাত্মক, কটু বা অশ্লীল ভাষা ব্যবহার না করার দায়িত্ব রয়েছে সাংসদদের। কার্যপ্রণালি বিধি অনুসারে স্পিকার বাকসংযমে ব্যর্থতার জন্য কোনো সাংসদকে সতর্ক করতে পারেন, তাঁর মাইক বন্ধ করে দিতে পারেন, কার্যপ্রণালি বিধি থেকে তাঁর বক্তব্য বাতিল করে দিতে পারেন, এমনকি ১৫ বিধি অনুসারে বিশৃঙ্খল আচরণের জন্য তাঁকে সংসদ থেকে চলে যেতে আদেশ দিতে পারেন। এরস্কিন মে রচিত পার্লামেন্টারি প্র্যাকটিস বইয়ে রয়েছে, ব্রিটিশ পার্লামেন্টে অতীতে আপত্তিকর বক্তব্যের জন্য বহু সাংসদকে নানা শাস্তি (যেমন: তিরস্কার, আটকে রাখা, বহিষ্কার) দেওয়ার নজির রয়েছে।
এমন নজির আমরা আমাদের সংসদে খুবই কম দেখি। এই সংসদে কারও ‘কোলে ওঠার’ অশ্লীল বাক্যবিনিময় হয়েছে, একজন প্রয়াত নেতার মৃতদেহ নিয়ে অত্যন্ত অরুচিকর বক্তব্য দেওয়া হয়েছে, সংসদে অনুপস্থিত ব্যক্তি সম্পর্কে চরম অসত্য বিষোদ্গার করা হয়েছে। কখনো আমরা তিরস্কার বা মাইক বন্ধের মতো মৃদু শাস্তি দেখেছি, কিন্তু যেসব বক্তব্য ফৌজদারি অপরাধতুল্য (যেমন, মানহানিকার), সেসব ক্ষেত্রেও আমরা স্পিকার কর্তৃক কাউকে সংসদ থেকে বহিষ্কার করতে দেখিনি।

৩. 
সৌজন্যতার বাধ্যবাধকতা আছে উচ্চ আদালতের বিচারকদের ক্ষেত্রেও। অভিযুক্ত ব্যক্তিকে ভুলভাবে শাস্তি না দেওয়ার তাগিদ ইংলিশ জুরিস্ট উইলিয়াম ব্লাকস্টোনের মৌলিক নীতিতে ছিল। পরবর্তী সময়ে সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা এবং নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার-সংক্রান্ত ১৯৬৬ সালের আন্তর্জাতিক চুক্তিতে ‘প্রিসাম্পশন অব ইনোসেন্স’-এর নীতি গৃহীত হয়। কমনওয়েলথ হিউম্যান রাইটস্ ইনিশিয়েটিভসের ফেয়ার ট্রায়াল ম্যানুয়াল অনুসারে বিচার সম্পন্ন হওয়ার আগে যেহেতু কাউকে দোষী বলা যায় না, তাই বিচারকদের কর্তৃক যেকোনো অভিযু্ক্ত ব্যক্তির সঙ্গে সম্মানজনক আচরণ করা বাঞ্ছনীয়। ১৯৮৫ সালের জাতিসংঘের প্রিন্সিপাল অব ইনডিপেনডেন্স অব জুডিশিয়ারির ১১ নম্বর গাইডলাইন অনুসারে একজন বিচারকের তাঁর সম্মুখে উত্থাপিত বিষয়ে কোনো রকম পূর্ব ধারণা পোষণ না করারও কঠোর বাধ্যবাধকতার কথা বলা হয়েছে। উচ্চ আদালতে রিট পিটিশনের শুনানির আগে যেহেতু ফৌজদারি অপরাধের মতো তদন্ত, চার্জশিট দাখিল ও চার্জ গঠন করা হয় না, তাই সেখানে বিবাদী বা রেসপোনডেন্টকে শুনানিকালে নির্দোষ ধরে নিয়ে তাঁর সঙ্গে সৌজন্যমূলক আচরণ করার বাধ্যবাধকতা আরও বেশি রয়েছে বলা যায়।
এ দেশে উচ্চ আদালতের একটি বেঞ্চে আমরা অন্যরকম আচরণ দেখি। পিটিশনের শুনানি চলাকালে রেসপোনডেন্টদের বিরুদ্ধে নাজিমুদ্দিন রোড (জেলখানা) বা পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেওয়ার হুমকি আমরা সেই বেঞ্চ থেকে শুনেছি। শুনানি সম্পন্ন হওয়ার আগে ঢালাওভাবে ‘চোর’ বলা হয়েছে, এটিও পত্রপত্রিকায় এসেছে। কেউ দোষ করেছেন কি না, সে সম্পর্কে প্রাথমিক শুনানিকালে তাঁকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড় করিয়ে রাখার বহু ঘটনা ঘটেছে। এগুলো কোনোভাবেই বিচারের আন্তর্জাতিক নর্ম বা মানদণ্ডের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
উচ্চ আদালতের বিচারকেরা আমাদের জাতির ক্রান্তিলগ্নে অনেক সময় প্রত্যাশিত ভূমিকা রেখেছেন। মানবাধিকার ও পরিবেশ রক্ষা করার ক্ষেত্রে বর্তমানেও উচ্চ আদালত থেকে আমরা অনেক সময় জনমুখী রায় পেয়ে থাকি। কিন্তু উচ্চ আদালতের একজন বিচারকও যদি আইন ও রীতি লঙ্ঘন করেন বা এজলাসে কারও প্রতি সংবিধানের ৩৫(৫) লঙ্ঘনতুল্য লাঞ্ছনাকর ব্যবহার করেন, তার প্রতিকার বিচার বিভাগের মর্যাদা ও সম্মান রক্ষার স্বার্থে হলেও করতে হবে।
উচ্চ আদালতের বিচারকদের জবাবদিহি আমাদের সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ অনুসারে প্রণীত কোড অব কনডাক্ট কর্তৃক সুনির্দিষ্ট। আচরণবিধিতে বলা হয়েছে যে একজন বিচারক মামলার পক্ষগণ এবং আইনজীবীদের প্রতি ধৈর্যশীল, মর্যাদাপূর্ণ, সশ্রদ্ধ এবং ভদ্র আচরণ করবেন। এতে আরও বলা আছে যে একজন বিচারক কোনো অবস্থাতেই প্রকাশ্য বিতর্কে জড়াবেন না বা রাজনৈতিক বিষয়ে প্রকাশ্য কোনো মতামত ব্যক্ত করবেন না কিংবা তাঁর বিচারাধীন কোনো মামলার বিষয়ে কোনো মন্তব্য করবেন না। আচরণবিধির উপসংহারে বলা হয়েছে যে এই আচরণবিধির ১৪টি বিধি কেবল সুনির্দিষ্ট উদাহরণ হিসেবে উপস্থাপিত হলো, এর বাইরে একজন বিচারক এমন কিছু করবেন না, যা উচ্চ আদালতের আস্থাযোগ্যতা ও স্বাধীনতাকে ক্ষুণ্ন করে।
আচরণবিধির লঙ্ঘন গুরুতর অসদাচরণ হলে প্রধান বিচারপতি ও আপিলেট ডিভিশনের দুজন সিনিয়র বিচারপতির সমন্বয়ে গঠিত সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল রাষ্ট্রপতির কাছে বিষয়টি জানিয়ে তাঁকে অভিশংসনের প্রক্রিয়া শুরু করতে পারেন। এ ছাড়া সুপ্রিম কোর্ট রুলস অনুসারে প্রধান বিচারপতি কর্তৃক কোনো বিচারপতির বেঞ্চ ভেঙে দেওয়া, তাঁকে কিছু সময়ের জন্য ছুটি প্রদান করা বা তাঁকে সংশোধনমূলক পরামর্শ দেওয়ার বহু সুযোগ রয়েছে।
দু-একজন বিচারকের আচরণ ও উচ্চ আদালতের মর্যাদা নিয়ে বিচলিত হওয়ার মতো বহু সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত হলেও আমরা সর্বোচ্চ বিচার প্রশাসনকে কোনো প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে দেখিনি। আমার মনে হয় না এ ধরনের ব্যবস্থা আগে গ্রহণ করলে আজকের বিপর্যয়কর পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো।

৪. 
জাতি হিসেবে আমাদের শালীনতাবোধ নিয়ে গভীরভাবে আত্মসমালোচনা করার সময় এসেছে। রাষ্ট্রকাঠামোতে অধিষ্টিত সর্বোচ্চ ব্যক্তিরা যখন নিজেরাই সৌজন্য ও শালীনতার চর্চা ভুলে যান বা তাঁদের এখতিয়ারভুক্ত ব্যক্তিদের কর্তৃক অসৌজন্যমূলক ও ভব্যতাহীন আচরণ নিয়ন্ত্রণে অপারগ থাকেন, তখন আমাদের কপাল খুবই মন্দ বলতে হবে। এসব অব্যাহত থাকলে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম কী শিখবে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারক ও নীতি প্রয়োগকারীদের কাছে থেকে? কীভাবে তাঁরা গর্বিত ও সম্মানিত বোধ করবেন এই রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে?
মানুষের আচার-আচরণ নাকি বংশের পরিচয়। তেমনি রাষ্ট্রের কর্ণধারদের আচার-আচরণও জাতি হিসেবে আমাদের ভব্যতা ও সভ্যতার পরিচায়ক। তাঁদের কেউ কেউ সে বিষয়ে সচেতন আছেন কি না, তা নিয়ে আমাদের আমজনতার অবশ্যই উদ্বেগ রয়েছে।
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।