ভারতের অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জি এক নতুন সম্ভাবনার ইঙ্গিত দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে বন্ধুত্ব চায়, কোনো বিশেষ দলের সঙ্গে নয়। তিনি বিরোধী দলের নেত্রী খালেদা জিয়াকে ভারত সফরেরও আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। প্রণবের প্রথম বাংলাদেশ সফরকালে যে শীতল মনোভাব বিএনপির প্রতি দেখানো হয়েছিল, তার পরিপ্রেক্ষিতে এসব পরিবর্তন তাৎপর্যপূর্ণ।
প্রণব, হিলারি এবং সবশেষে ইউরোপীয় ইউনিয়ন আগামী নির্বাচন প্রসঙ্গে দুটো বিষয়ের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছে। এক. রাজনৈতিক সমঝোতা এবং দুই. সবার অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। দুটো বিষয়ের মূল লক্ষ্য অভিন্ন: তা হচ্ছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠান। বাংলাদেশে এখন যত রকম রাজনৈতিক হানাহানি হচ্ছে, তার মূলেও রয়েছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাখা না-রাখা নিয়ে বিরোধ।
অশক্ত গণতন্ত্রের একটি দেশ হিসেবে এই বিরোধ অস্বাভাবিক নয়। এ ধরনের দেশে শাসকগোষ্ঠী ‘অলটেরোকেসি’ বা ক্ষমতার পরিবর্তনে বিশ্বাস করে না। নির্বাচনে কারচুপি যতভাবে করা সম্ভব, তার মাধ্যমে জনগণের রায়কে ছিনতাই করার চেষ্টা এসব দেশে থাকে। বাংলাদেশে এটি চরম পর্যায়ে চলে গিয়েছিল বলে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্ব অরাজনৈতিক কিছু নাগরিকের কাছে প্রদান করার জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের রাজনৈতিক সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সেই সমঝোতাকে অগ্রাহ্য করার চেষ্টা সম্ভবত সফল হবে না। আন্তর্জাতিক মহলও সে রকম ইঙ্গিত দিয়ে যাচ্ছে এখন পর্যন্ত।
২.
গণতন্ত্র মানে যদি হয় জনগণের ম্যান্ডেট, সে ম্যান্ডেট তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে এখনো রয়েছে। জাতীয় পার্টি ছাড়া বাংলাদেশের প্রতিটি বড় রাজনৈতিক দল এই সরকারব্যবস্থার পক্ষে ছিল। জাতীয় পার্টির নেতারা ১৯৯১ সালে অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে সংগত কারণে এর বিরুদ্ধে কথা বলেছিলেন। সেই দলের নেতা এরশাদ পর্যন্ত জনগণ চাচ্ছে বলে তাঁর দল তত্ত্বাবধায়ক সরকারে রাজি আছে বলেছেন সাম্প্রতিক কালে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে দেশে এত সংঘাত হওয়ারও কথা ছিল না। সরকারে থাকা অবস্থায় ২০১০ সালে সংসদীয় কমিটির সঙ্গে সংলাপে স্বয়ং শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সংস্কার সাপেক্ষে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে মতামত জানিয়েছে। শেখ হাসিনা নিজে ১৯৯১ সালের নির্দলীয় সরকার, পরের দুটো তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং ২০০৭ সালের ‘অস্বাভাবিক’ তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার পেছনে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিলেন। তাঁর এই অবস্থানে পরে বিচ্যুতি না ঘটলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকবে কি থাকবে না তা নিয়ে দেশে কোনো সংঘাত সৃষ্টির কারণ হয়তো থাকত না।
প্রশ্ন হচ্ছে, আওয়ামী লীগ কেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারে এখন রাজি নয়? এর সহজ উত্তর হতে পারে নির্বাচনে হেরে যাওয়ার প্রবল ভীতি। বিদেশি ‘বন্ধুরা’ সামনের সময়ে হয়তো আরও স্পষ্ট করে বলবেন, দেশে এখনি ড. কামাল হোসেন, ড. ইউনূস, ড. আবেদের মতো বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তি থেকে অধিকাংশ সাধারণ মানুষ (প্রথম আলোর ৯ মের জরিপ অনুসারে ৯০ দশমিক ১৯ শতাংশ) বলছেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে। সুপ্রিম কোর্টের যে আদেশের খণ্ডিত ও একপেশে প্রয়োগ করে সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিলোপকে যৌক্তিক করতে চায়, সেখানেও জনগণ এবং রাষ্ট্রের নিরাপত্তার স্বার্থে আগামী দুটো নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত করার নির্দেশনা দেওয়া আছে। আওয়ামী লীগ তবু রাজি নয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারে। সর্বশেষ যা খবর, এ নিয়ে এমনকি কোনো সংলাপে বসতেও রাজি নয় দলটি।
সরকারি দলের কেন এই অনড় অবস্থান? একটি সফল সরকারের তো সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রতি ভীতি থাকার কথা নয়। আমরা পত্রিকায় দেখি, সরকারের মন্ত্রীরা সবাই নিজেকে সফল ভাবেন। প্রধানমন্ত্রী নিজেই বলেন, চালচলনে সবাই স্যুটেড-বুটেড না হলেও তাঁর সব মন্ত্রীই সফল। আজকের পত্রিকায় দেখি, দেশে এমন এক গুম আতঙ্কে গুমোট সময়ে সাহারা খাতুন বললেন: তিনি অবশ্যই সফল!
আবারও বলি, এত সফল একটি সরকারের তো নিরপেক্ষ নির্বাচনে ভয় পাওয়ার কথা নয়! তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে এর আগে মহাব্যর্থ কিছু সরকার অংশ নিয়েছিল। তারা প্রত্যেকেই পরাজিত হয়েছিল। গত বিএনপি সরকারের ভরাডুবিই ঘটেছিল ২০০৮ এর নির্বাচনে। আওয়ামী লীগ কি নিজেদের ব্যর্থতার কারণে এমন পরিণতির আশঙ্কা করছে? একমাত্র এই আশঙ্কা থাকলেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে তাদের প্রবল বিরোধিতা আমাদের কাছে বোধগম্য হতো।
কিন্তু আমরা প্রকাশ্যে তাদের কোনো ব্যর্থতা স্বীকার করতে দেখি না। এ জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিরোধিতার ক্ষেত্রে তাদের মনস্তত্ত্ব আরও দুর্বোধ্য হয়ে পড়ছে।
৩.
প্রকাশ্যে আমরা আওয়ামী লীগকে বলতে শুনি শুধু তাদের সফলতার কথা। এর কারণ হতে পারে এই যে, সাধারণ মানুষ যেভাবে সফলতার মানে বোঝে, তার চেয়ে সরকারি দলগুলোর বোঝাটার ভঙ্গিটি ভিন্ন ধরনের। যেমন: আমরা যখন ইলিয়াসের গুম হওয়া নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছি, সরকারের লোকজন হয়তো ভাবছেন ড. কিবরিয়া বা আহসানউল্লাহ মাস্টারের হত্যাকাণ্ডের তুলনায় এটি তেমন কোনো বিষয় নয়। আমরা যখন ড. ইউনূসের অপমানে দেশের মর্যাদা ক্ষুণ্ন হয়েছে ভাবি, তাঁরা হয়তো ভাবেন প্রধানমন্ত্রীর শান্তির মডেল উত্থাপন বাংলাদেশকে নিয়ে গেছে নতুন উচ্চতায়! আমরা যখন নদী শুকিয়ে যাচ্ছে বলে হাহাকার করে উঠি, তাঁরা হয়তো ভাবেন সমুদ্রজয়ের পানি দিয়ে সমাধান হয়ে যাবে সব সমস্যার। আমরা যখন কর্মসংস্থান বা বিনিয়োগ-পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন হই, তাঁরা তখন শুধু জিডিপির গতি দেখেই তৃপ্ত থাকেন।
আমাদের চেয়ে তাঁদের দেখার চোখ ভিন্ন। দলীয়করণকে তাঁরা হয়তো ভাবেন ‘মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের’ লোকের মূল্যায়ন, দুর্নীতিকে ভাবেন দেশসেবার কারণে অর্জিত অধিকার বা ধনতন্ত্রের জন্য মূলধন পুঞ্জীভূতকরণ, রাজনৈতিক সন্ত্রাসকে ভাবেন মহৎ প্রতিশোধ, শেয়ারবাজার লুট করাকে ভাবেন চতুর মানুষের অর্জন, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি মানে ভাবেন বাজার অর্থনীতি!
সরকারি দল নির্বাচনী ম্যানিফেস্টো করে শুধু নির্বাচনে জেতার জন্য, আমরা ভুল করে ভাবি তা বাস্তবায়নের জন্য। সরকারি দল দিনবদল মানে ভাবে শাসকগোষ্ঠী আর তার অনুগতদের দিনবদল, আমরা ভাবি সবার জন্য দিনবদল। সরকার ভাবে দেশটা সরকারি দলের, আমরা ভাবি জনগণের। সরকার ভাবে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক মানে ভারত, আমরা ভাবি অন্যরাও।
বোঝার ক্ষেত্রে এই মনস্তাত্ত্বিক পার্থক্য সত্যি না হলে সরকার আর আমাদের মূল্যায়ন এত ভিন্ন হওয়ার কারণ নেই। আমার কথা হচ্ছে, সরকারের আত্মমূল্যায়ন সঠিক হলে সুষ্ঠু আর অবাধ নির্বাচনে তাদের ভয় পাওয়ার কারণ নেই। আর এমন নির্বাচন কেবল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই হওয়া সম্ভব।
৪.
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রতি অনীহার একটি কারণ আমরা সরকারের নীতিনির্ধারকদের মুখে শুনি। তাঁরা ১/১১ পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রসঙ্গ টেনে সে সময় রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও আমলাদের প্রতি নিপীড়নের কথা বলেন। এই অভিযোগ অমূলক নয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকার যে সংবিধান-বহির্ভূতভাবে বহুদিন ক্ষমতায় ছিল, এটিও সত্যি। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে, সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছিল একটি অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে অস্বাভাবিকভাবে সৃষ্ট একটি সরকার। এ ধরনের পরিস্থিতির মূল কারণ ছিল বিএনপি কর্তৃক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মোড়কে একটি অনুগত নির্বাচন প্রশাসন ও নির্বাচনী প্রক্রিয়া স্থাপনের চেষ্টা। সেই চেষ্টা সহিংসভাবে ঠেকাতে গিয়েছিল তৎকালীন বিরোধী দল, এর পরিণতিতে সৃষ্ট অস্বাভাবিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে সদলবলে অভিনন্দিত করেছিলেন দলটির সভানেত্রী। একইভাবে বর্তমান সরকারি দলও কারসাজির নির্বাচন করতে গেলে তা যেকোনো মূল্যে বর্তমান বিরোধী দল প্রতিহত করার চেষ্টা করবে, এটাই স্বাভাবিক।
এই অনিবার্য সংঘাত এড়ানোর একমাত্র সমাধান হচ্ছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন (এবং ২০০৬ সালের মতো তা টেম্পারিং করার চেষ্টা না করা)। এ জন্য দেশি-বিদেশি বিভিন্ন মহল সংলাপের প্রয়োজনীয়তার কথা বলছে। কিন্তু আমার মতে, সরকার নিজে থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিলে সংলাপেরও তেমন প্রয়োজন নেই। এই উদ্যোগের ভিত্তিতে সংসদে বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের যে ত্রুটিগুলো রয়েছে (যেমন: এর গঠন, কার্যকাল এবং ক্ষমতাসংক্রান্ত), তা দূর করে সর্বমহলে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনকালীন একটি সরকার প্রতিষ্ঠা করা অসম্ভব নয়।
এ জন্য অতিকেন্দ্রীভূত বর্তমান সরকারব্যবস্থায় সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সরকারপ্রধানের সদিচ্ছা। এই সদিচ্ছার অভাব ছিল বলে অতীতে সংলাপের মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের কোনো নজির আমরা পাইনি। গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শেষ দিকে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কিছু সফল সংলাপ হয়েছিল। কিন্তু ৯০-পরবর্তী গণতন্ত্র পুনরুত্থানের যুগে সংলাপের মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের নজির সম্ভবত আর নেই। বর্তমান সরকারের আমলে সংবিধান সংশোধনী সংক্রান্ত সংলাপে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রয়োজনীয়তাসহ বহু বিষয়ে মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সরকার সেই মতৈক্যের গুরুত্ব অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রদান করেনি। এটি প্রমাণ করে, সরকারপ্রধান না চাইলে রাজনৈতিক সংলাপের মাধ্যমে প্রকৃত সমাধানের সম্ভাবনা তেমন নেই বাংলাদেশে।
আমরা সেই সদিচ্ছার প্রত্যাশা করি। দলীয় সরকারের মাধ্যমে একতরফা নির্বাচন বাংলাদেশে অতীতে হয়েছে। আমাদের অভিজ্ঞতা বলে, এমন নির্বাচনগুলো হয়েছে জনগণ কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হওয়ার ভয় থেকে। আগামী নির্বাচনও এভাবে করার উদ্যোগ নিলে মানুষ সেই ভয়ের গন্ধ পাবে। আমার মনে হয় না, জনগণকে ভয় পেয়ে বা ভয় দেখিয়ে বাংলাদেশে ক্ষমতায় টিকে থাকা যায়।
জনগণের সঙ্গে এমন ভয়ের সম্পর্ক যদি না থাকে, তাহলে জনগণের প্রত্যাশা অনুসারে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনঃপ্রবর্তনে সরকারের রাজি হওয়া উচিত। সেটি যত তাড়াতাড়ি হবে, ততই মঙ্গলজনক।
প্রণব, হিলারি এবং সবশেষে ইউরোপীয় ইউনিয়ন আগামী নির্বাচন প্রসঙ্গে দুটো বিষয়ের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছে। এক. রাজনৈতিক সমঝোতা এবং দুই. সবার অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। দুটো বিষয়ের মূল লক্ষ্য অভিন্ন: তা হচ্ছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠান। বাংলাদেশে এখন যত রকম রাজনৈতিক হানাহানি হচ্ছে, তার মূলেও রয়েছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাখা না-রাখা নিয়ে বিরোধ।
অশক্ত গণতন্ত্রের একটি দেশ হিসেবে এই বিরোধ অস্বাভাবিক নয়। এ ধরনের দেশে শাসকগোষ্ঠী ‘অলটেরোকেসি’ বা ক্ষমতার পরিবর্তনে বিশ্বাস করে না। নির্বাচনে কারচুপি যতভাবে করা সম্ভব, তার মাধ্যমে জনগণের রায়কে ছিনতাই করার চেষ্টা এসব দেশে থাকে। বাংলাদেশে এটি চরম পর্যায়ে চলে গিয়েছিল বলে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্ব অরাজনৈতিক কিছু নাগরিকের কাছে প্রদান করার জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের রাজনৈতিক সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সেই সমঝোতাকে অগ্রাহ্য করার চেষ্টা সম্ভবত সফল হবে না। আন্তর্জাতিক মহলও সে রকম ইঙ্গিত দিয়ে যাচ্ছে এখন পর্যন্ত।
২.
গণতন্ত্র মানে যদি হয় জনগণের ম্যান্ডেট, সে ম্যান্ডেট তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে এখনো রয়েছে। জাতীয় পার্টি ছাড়া বাংলাদেশের প্রতিটি বড় রাজনৈতিক দল এই সরকারব্যবস্থার পক্ষে ছিল। জাতীয় পার্টির নেতারা ১৯৯১ সালে অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে সংগত কারণে এর বিরুদ্ধে কথা বলেছিলেন। সেই দলের নেতা এরশাদ পর্যন্ত জনগণ চাচ্ছে বলে তাঁর দল তত্ত্বাবধায়ক সরকারে রাজি আছে বলেছেন সাম্প্রতিক কালে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে দেশে এত সংঘাত হওয়ারও কথা ছিল না। সরকারে থাকা অবস্থায় ২০১০ সালে সংসদীয় কমিটির সঙ্গে সংলাপে স্বয়ং শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সংস্কার সাপেক্ষে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে মতামত জানিয়েছে। শেখ হাসিনা নিজে ১৯৯১ সালের নির্দলীয় সরকার, পরের দুটো তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং ২০০৭ সালের ‘অস্বাভাবিক’ তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার পেছনে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিলেন। তাঁর এই অবস্থানে পরে বিচ্যুতি না ঘটলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকবে কি থাকবে না তা নিয়ে দেশে কোনো সংঘাত সৃষ্টির কারণ হয়তো থাকত না।
প্রশ্ন হচ্ছে, আওয়ামী লীগ কেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারে এখন রাজি নয়? এর সহজ উত্তর হতে পারে নির্বাচনে হেরে যাওয়ার প্রবল ভীতি। বিদেশি ‘বন্ধুরা’ সামনের সময়ে হয়তো আরও স্পষ্ট করে বলবেন, দেশে এখনি ড. কামাল হোসেন, ড. ইউনূস, ড. আবেদের মতো বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তি থেকে অধিকাংশ সাধারণ মানুষ (প্রথম আলোর ৯ মের জরিপ অনুসারে ৯০ দশমিক ১৯ শতাংশ) বলছেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে। সুপ্রিম কোর্টের যে আদেশের খণ্ডিত ও একপেশে প্রয়োগ করে সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিলোপকে যৌক্তিক করতে চায়, সেখানেও জনগণ এবং রাষ্ট্রের নিরাপত্তার স্বার্থে আগামী দুটো নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত করার নির্দেশনা দেওয়া আছে। আওয়ামী লীগ তবু রাজি নয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারে। সর্বশেষ যা খবর, এ নিয়ে এমনকি কোনো সংলাপে বসতেও রাজি নয় দলটি।
সরকারি দলের কেন এই অনড় অবস্থান? একটি সফল সরকারের তো সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রতি ভীতি থাকার কথা নয়। আমরা পত্রিকায় দেখি, সরকারের মন্ত্রীরা সবাই নিজেকে সফল ভাবেন। প্রধানমন্ত্রী নিজেই বলেন, চালচলনে সবাই স্যুটেড-বুটেড না হলেও তাঁর সব মন্ত্রীই সফল। আজকের পত্রিকায় দেখি, দেশে এমন এক গুম আতঙ্কে গুমোট সময়ে সাহারা খাতুন বললেন: তিনি অবশ্যই সফল!
আবারও বলি, এত সফল একটি সরকারের তো নিরপেক্ষ নির্বাচনে ভয় পাওয়ার কথা নয়! তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে এর আগে মহাব্যর্থ কিছু সরকার অংশ নিয়েছিল। তারা প্রত্যেকেই পরাজিত হয়েছিল। গত বিএনপি সরকারের ভরাডুবিই ঘটেছিল ২০০৮ এর নির্বাচনে। আওয়ামী লীগ কি নিজেদের ব্যর্থতার কারণে এমন পরিণতির আশঙ্কা করছে? একমাত্র এই আশঙ্কা থাকলেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে তাদের প্রবল বিরোধিতা আমাদের কাছে বোধগম্য হতো।
কিন্তু আমরা প্রকাশ্যে তাদের কোনো ব্যর্থতা স্বীকার করতে দেখি না। এ জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিরোধিতার ক্ষেত্রে তাদের মনস্তত্ত্ব আরও দুর্বোধ্য হয়ে পড়ছে।
৩.
প্রকাশ্যে আমরা আওয়ামী লীগকে বলতে শুনি শুধু তাদের সফলতার কথা। এর কারণ হতে পারে এই যে, সাধারণ মানুষ যেভাবে সফলতার মানে বোঝে, তার চেয়ে সরকারি দলগুলোর বোঝাটার ভঙ্গিটি ভিন্ন ধরনের। যেমন: আমরা যখন ইলিয়াসের গুম হওয়া নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছি, সরকারের লোকজন হয়তো ভাবছেন ড. কিবরিয়া বা আহসানউল্লাহ মাস্টারের হত্যাকাণ্ডের তুলনায় এটি তেমন কোনো বিষয় নয়। আমরা যখন ড. ইউনূসের অপমানে দেশের মর্যাদা ক্ষুণ্ন হয়েছে ভাবি, তাঁরা হয়তো ভাবেন প্রধানমন্ত্রীর শান্তির মডেল উত্থাপন বাংলাদেশকে নিয়ে গেছে নতুন উচ্চতায়! আমরা যখন নদী শুকিয়ে যাচ্ছে বলে হাহাকার করে উঠি, তাঁরা হয়তো ভাবেন সমুদ্রজয়ের পানি দিয়ে সমাধান হয়ে যাবে সব সমস্যার। আমরা যখন কর্মসংস্থান বা বিনিয়োগ-পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন হই, তাঁরা তখন শুধু জিডিপির গতি দেখেই তৃপ্ত থাকেন।
আমাদের চেয়ে তাঁদের দেখার চোখ ভিন্ন। দলীয়করণকে তাঁরা হয়তো ভাবেন ‘মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের’ লোকের মূল্যায়ন, দুর্নীতিকে ভাবেন দেশসেবার কারণে অর্জিত অধিকার বা ধনতন্ত্রের জন্য মূলধন পুঞ্জীভূতকরণ, রাজনৈতিক সন্ত্রাসকে ভাবেন মহৎ প্রতিশোধ, শেয়ারবাজার লুট করাকে ভাবেন চতুর মানুষের অর্জন, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি মানে ভাবেন বাজার অর্থনীতি!
সরকারি দল নির্বাচনী ম্যানিফেস্টো করে শুধু নির্বাচনে জেতার জন্য, আমরা ভুল করে ভাবি তা বাস্তবায়নের জন্য। সরকারি দল দিনবদল মানে ভাবে শাসকগোষ্ঠী আর তার অনুগতদের দিনবদল, আমরা ভাবি সবার জন্য দিনবদল। সরকার ভাবে দেশটা সরকারি দলের, আমরা ভাবি জনগণের। সরকার ভাবে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক মানে ভারত, আমরা ভাবি অন্যরাও।
বোঝার ক্ষেত্রে এই মনস্তাত্ত্বিক পার্থক্য সত্যি না হলে সরকার আর আমাদের মূল্যায়ন এত ভিন্ন হওয়ার কারণ নেই। আমার কথা হচ্ছে, সরকারের আত্মমূল্যায়ন সঠিক হলে সুষ্ঠু আর অবাধ নির্বাচনে তাদের ভয় পাওয়ার কারণ নেই। আর এমন নির্বাচন কেবল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই হওয়া সম্ভব।
৪.
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রতি অনীহার একটি কারণ আমরা সরকারের নীতিনির্ধারকদের মুখে শুনি। তাঁরা ১/১১ পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রসঙ্গ টেনে সে সময় রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও আমলাদের প্রতি নিপীড়নের কথা বলেন। এই অভিযোগ অমূলক নয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকার যে সংবিধান-বহির্ভূতভাবে বহুদিন ক্ষমতায় ছিল, এটিও সত্যি। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে, সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছিল একটি অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে অস্বাভাবিকভাবে সৃষ্ট একটি সরকার। এ ধরনের পরিস্থিতির মূল কারণ ছিল বিএনপি কর্তৃক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মোড়কে একটি অনুগত নির্বাচন প্রশাসন ও নির্বাচনী প্রক্রিয়া স্থাপনের চেষ্টা। সেই চেষ্টা সহিংসভাবে ঠেকাতে গিয়েছিল তৎকালীন বিরোধী দল, এর পরিণতিতে সৃষ্ট অস্বাভাবিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে সদলবলে অভিনন্দিত করেছিলেন দলটির সভানেত্রী। একইভাবে বর্তমান সরকারি দলও কারসাজির নির্বাচন করতে গেলে তা যেকোনো মূল্যে বর্তমান বিরোধী দল প্রতিহত করার চেষ্টা করবে, এটাই স্বাভাবিক।
এই অনিবার্য সংঘাত এড়ানোর একমাত্র সমাধান হচ্ছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন (এবং ২০০৬ সালের মতো তা টেম্পারিং করার চেষ্টা না করা)। এ জন্য দেশি-বিদেশি বিভিন্ন মহল সংলাপের প্রয়োজনীয়তার কথা বলছে। কিন্তু আমার মতে, সরকার নিজে থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিলে সংলাপেরও তেমন প্রয়োজন নেই। এই উদ্যোগের ভিত্তিতে সংসদে বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের যে ত্রুটিগুলো রয়েছে (যেমন: এর গঠন, কার্যকাল এবং ক্ষমতাসংক্রান্ত), তা দূর করে সর্বমহলে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনকালীন একটি সরকার প্রতিষ্ঠা করা অসম্ভব নয়।
এ জন্য অতিকেন্দ্রীভূত বর্তমান সরকারব্যবস্থায় সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সরকারপ্রধানের সদিচ্ছা। এই সদিচ্ছার অভাব ছিল বলে অতীতে সংলাপের মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের কোনো নজির আমরা পাইনি। গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শেষ দিকে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কিছু সফল সংলাপ হয়েছিল। কিন্তু ৯০-পরবর্তী গণতন্ত্র পুনরুত্থানের যুগে সংলাপের মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের নজির সম্ভবত আর নেই। বর্তমান সরকারের আমলে সংবিধান সংশোধনী সংক্রান্ত সংলাপে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রয়োজনীয়তাসহ বহু বিষয়ে মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সরকার সেই মতৈক্যের গুরুত্ব অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রদান করেনি। এটি প্রমাণ করে, সরকারপ্রধান না চাইলে রাজনৈতিক সংলাপের মাধ্যমে প্রকৃত সমাধানের সম্ভাবনা তেমন নেই বাংলাদেশে।
আমরা সেই সদিচ্ছার প্রত্যাশা করি। দলীয় সরকারের মাধ্যমে একতরফা নির্বাচন বাংলাদেশে অতীতে হয়েছে। আমাদের অভিজ্ঞতা বলে, এমন নির্বাচনগুলো হয়েছে জনগণ কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হওয়ার ভয় থেকে। আগামী নির্বাচনও এভাবে করার উদ্যোগ নিলে মানুষ সেই ভয়ের গন্ধ পাবে। আমার মনে হয় না, জনগণকে ভয় পেয়ে বা ভয় দেখিয়ে বাংলাদেশে ক্ষমতায় টিকে থাকা যায়।
জনগণের সঙ্গে এমন ভয়ের সম্পর্ক যদি না থাকে, তাহলে জনগণের প্রত্যাশা অনুসারে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনঃপ্রবর্তনে সরকারের রাজি হওয়া উচিত। সেটি যত তাড়াতাড়ি হবে, ততই মঙ্গলজনক।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন