লন্ডনে থাকাকালে শামীম আজাদ খবরটি জানান। মতিউর রহমান ভোরের কাগজ ছেড়ে
দিচ্ছেন। নতুন পত্রিকা বের করছেন, নাম প্রথম আলো। প্রথম আলো সুনীল
গঙ্গোপ্যাধায়ের উপন্যাসের নাম। একা এবং কয়েকজন আর সেই সময় পড়ে আমাদের
প্রজন্ম তখন সুনীলের উন্মাতাল ভক্ত। তাঁর উপন্যাসের নামে হবে মতিউর রহমানের
নতুন দৈনিক! তত দিনে মতিউর রহমান চৌধুরী সম্পাদিত মানবজমিন (শীর্ষেন্দুর
বিখ্যাত উপন্যাস) নামের দৈনিক পত্রিকাটি বের হয়েছে। তার পরও প্রথম আলো
নামটি অভিনব মনে হয়।
২০০০ সালে চূড়ান্তভাবে দেশে ফিরে দেখি, মাত্র দুই বছরে দাঁড়িয়ে গেছে প্রথম আলো। আমার বাবা তখনো ইত্তেফাক-এর মহা ভক্ত, বাসায় তাই দ্বিতীয় পত্রিকা হিসেবে প্রথম আলোর প্রবেশ। অল্প দিনে এটিই হয়ে যায় একমাত্র পত্রিকা। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোটের বিশাল বিজয়ের পর এর সম্ভাব্য কুফল প্রসঙ্গে লেখা নিয়ে হাজির হই প্রথম আলো অফিসে। মোটা ফ্রেমের চশমা পরা সিরিয়াস এক যুবক লেখা গ্রহণ করেন। তিনি শক্তিশালী কথাসাহিত্যিক মশিউল আলম।
প্রথম আলোর সঙ্গে আমার সরাসরি সম্পর্ক শুরু এভাবে। কিন্তু এর সঙ্গে আমার প্রতিদিনের এবং প্রকৃত সম্পর্ক পাঠক হিসেবে। প্রতিদিন প্রথম আলো পড়ে আমিও মুগ্ধ হই, বিস্মিত হই, কখনো কখনো অসন্তুষ্ট হই। এটাই স্বাভাবিক। একটি দৈনিক পত্রিকা কখনো নিখুঁত হতে পারে না, এমনকি সম্পূর্ণও হতে পারে না। এটি কখনো তার সব পাঠককে সমভাবে সন্তুষ্ট করতে পারে না। সংবাদপত্রের মানের পরীক্ষা হয় প্রতিদিন, প্রকাশ্যে এবং নানাভাবে।
২.
আশার কথা হচ্ছে, এই প্রবল পরীক্ষায় বাংলাদেশে সবচেয়ে মানোত্তীর্ণ পত্রিকাই সবচেয়ে বেশি পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে। ইত্তেফাক, জনকণ্ঠ, আজকের কাগজ কিংবা যুগান্তর তাদের সবচেয়ে মানোত্তীর্ণ সময়েই সবচেয়ে পাঠকপ্রিয় ছিল। সব দেশে সব সময় এমন হয় না। ওয়াশিংটন পোস্ট, গার্ডিয়ান কিংবা দ্য হিন্দু যথাক্রমে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও ভারতে সবচেয়ে মানসম্পন্ন পত্রিকা হিসেবে অধিকাংশের কাছে বিবেচিত। কিন্তু সর্বাধিক পাঠকপ্রিয়তা এসব দৈনিক অর্জন করতে পারেনি।
প্রথম আলো সর্বাধিক পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করেছে রুচিমান ও মানসম্মত সাংবাদিকতা করে। এটি কোনো স্থূল, হলুদ বা অপসাংবাদিকতার পথ ধরেনি; বরং কিছু কিছু ক্ষেত্রে এর ‘শুচিবাই’ অসাধারণ পর্যায়ের। প্রথম আলো ভয়াবহ ছবি ছাপা থেকে বিরত থাকে, স্ক্যান্ডাল-জাতীয় খবর পরিহার করে, প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত যৌন হয়রানির অভিযোগে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের নাম নির্দিষ্টকরণ থেকেও বিরত থাকে। আমার জানামতে, প্রথম আলো বাংলাদেশের প্রথম এবং একমাত্র বাংলা দৈনিক, যার সাংবাদিকদের জন্য নিজস্ব আচরণবিধি রয়েছে।
প্রথম আলো বাংলাদেশের ইতিহাসে একমাত্র পত্রিকা হিসেবে প্রথমে তিন লাখ, পরে চার লাখ এবং বর্তমানে সাড়ে চার লাখের ওপর প্রচারসংখ্যা অর্জন করেছে। এটি বড় খবর নয়। বড় খবর হচ্ছে, দায়িত্বশীল ও মননশীল থেকে সবচেয়ে বেশি পাঠকের কাছে যাওয়া যায়, এটি এর মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে। প্রথম আলো একই সঙ্গে রাজনৈতিকভাবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে নিরপেক্ষ থেকেছে। বাংলাদেশের মতো অপশাসনের দেশে একটি দায়িত্বশীল ও নিরপেক্ষ পত্রিকা সরকারের বিরাগভাজন হবে, এটা স্বাভাবিক। প্রথম আলোর ক্ষেত্রে অব্যাহতভাবে তা হয়েছে, গত ১২ বছরে এটি সব সরকারের চক্ষুশূল হয়েছে, প্রথম আলোর সম্পাদক ও সাংবাদিকদের নানাভাবে ভোগান্তির শিকার হতে হয়েছে। এর নিরপেক্ষতার সবচেয়ে বড় প্রমাণ এটাই।
৩.
প্রথম আলো তাই বলে কোনো বিচ্ছিন্ন দ্বীপ নয়। এটা বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলোর বাইরের কোনো জগৎ নয়। প্রথম আলোর মতো সাফল্য অন্য পত্রিকাগুলোরও রয়েছে, অন্য পত্রিকাগুলোর ব্যর্থতা প্রথম আলোর ক্ষেত্রে কিছুটা হলেও রয়েছে। রাজনৈতিকভাবে অতি প্রভাবশালী ব্যক্তি বা মালিকপক্ষ জড়িত নয় অন্তত এমন ক্ষেত্রে অধিকাংশ গণমাধ্যম সোচ্চারভাবে দুর্নীতি, অনাচার ও অনিয়মের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। এসিড নিক্ষেপ, নারী নির্যাতন, মাদকাসক্তি, ভণ্ডপীর—এসব সামাজিক সমস্যার ক্ষেত্রে অনেক গণমাধ্যম জনস্বার্থমূলক ভূমিকা পালন করেছে। মেধাবীদের সংগঠিত করা ও উৎসাহ প্রদান, সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি, দুস্থ মানুষের পাশে এসে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে কিছু গণমাধ্যম অসাধারণ ভূমিকাও রেখেছে।
সমস্যা হয় রাজনৈতিক ক্ষেত্রে। ক্ষুদ্র কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে বাংলাদেশের গণমাধ্যম সব সময়ে গণতন্ত্রের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। তবে এ অবস্থান গ্রহণ অনেক ক্ষেত্রে কোনো নির্দিষ্ট দলের দৃষ্টিকোণ থেকে নেওয়া হয়। ফলে বাংলাদেশের কিছু সংবাদপত্র এবং টিভি চ্যানেলের ক্ষেত্রে বলে দেওয়া সম্ভব যে তারা কোনো নির্দিষ্ট দলের পক্ষে রয়েছে। উন্নত বিশ্বের সংবাদপত্রও কোনো কোনো রাজনৈতিক দলের প্রতি সমর্থন দিয়ে থাকে। কিন্তু এই সমর্থন যত না দলের পক্ষে, তার চেয়ে বেশি দলের কিছু নীতি ও আদর্শের পক্ষে। ফলে নীতি বা আদর্শবিরোধী অবস্থান নিলে সংবাদপত্রও তার সমর্থিত দলের বিরুদ্ধে সংবাদভাষ্য, এমনকি প্রতিবেদন প্রকাশ করে থাকে। বাংলাদেশে এটা সব সময় ঘটে না। প্রথম আলোর উজ্জ্বল একটি দিক হচ্ছে, বাংলাদেশের কোনো রাজনৈতিক দল এটাকে তাদের সমর্থক পত্রিকা মনে করে না। সন্ত্রাস, দুর্নীতি, অনিয়ম, দলীয়করণের বিরুদ্ধে প্রথম আলো বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিল, বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধেও সোচ্চার আছে।
তাই বলে কি প্রথম আলোর কোনো পক্ষপাতিত্ব নেই, দুর্বলতা নেই? তার আগে বলে নিই, একজন নিবিষ্ট পাঠক হিসেবে বাংলাদেশে অধিকাংশ সংবাদপত্রের মধ্যে রাজনৈতিক প্রশ্নে কিছু পক্ষপাতিত্বের প্রবণতা আমি লক্ষ করেছি। এগুলো হচ্ছে—ক. সমর্থিত সরকারি দলের দুর্নীতি, অনিয়ম বা মানবাধিকার লঙ্ঘন সম্পর্কে স্ব-উদ্যোগী হয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশে শৈথিল্য, বিপক্ষ দল ক্ষমতায় গেলে তার দুর্নীতি ও অনিয়ম সম্পর্কে কখনো কখনো ভিত্তিহীন তথ্য প্রকাশ; খ. সংসদ কার্যকর করার ক্ষেত্রে বা প্রশাসন সচল রাখার ক্ষেত্রে সমর্থিত সরকারি দলের ব্যর্থতা সম্পর্কে প্রতিবেদন কম গুরুত্ব দিয়ে ছাপানো বা এ ক্ষেত্রে বিরোধী দলের ব্যর্থতা বড় করে দেখানো; গ. সমর্থিত দলের জনসভার ছবি এবং বিবরণ অতিরঞ্জিত করে ছাপানো এবং বিরোধী দলের ক্ষেত্রে বিপরীত অবস্থান গ্রহণ; ঘ. সম্পাদকীয় পাতায় নির্দিষ্ট দলের পক্ষের লেখকদের লেখা ছাপানো এবং বিরোধীদের লেখা নিরুৎসাহিতকরণ; ঙ. সমর্থিত দলের পক্ষের রাজনীতিবিদেরা আইনজীবী বা নাগরিক সমাজের নামী ব্যক্তিত্ব হলে তাঁদের রাজনৈতিক পরিচয়কে আড়াল করে বিশেষজ্ঞ হিসেবে তাঁদের মতামত গ্রহণ করে কোনো বিষয়ে প্রচারণা চালানো; চ. বিশেষ বিশেষ সময় ধর্ম, জঙ্গিবাদ, স্বাধীনতাযুদ্ধে অবদান—এ ধরনের রাজনৈতিকভাবে অতি স্পর্শকাতর বিষয়ে স্ব-উদ্যোগী হয়ে প্রচারণা চালানো; চ. নিজস্ব ঘরানার এনজিওদের সভা-সেমিনারে প্রদত্ত পছন্দনীয় ব্যক্তিদের নির্বাচিত বক্তব্য খুব গুরুত্বের সঙ্গে ছাপিয়ে পরে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় সেই ্বক্তব্যকে জনগণের বক্তব্য বা সুশীল সমাজের আকাঙ্ক্ষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা; ছ. গুরুত্বপূর্ণ আইনগত প্রশ্নে পছন্দনীয় বক্তব্য প্রদান করবে শুধু এমন বিশেষজ্ঞদের মতামত গুরুত্ব দিয়ে ছাপানো; জ. দল বা গোষ্ঠীর প্রতি অন্ধ সমর্থন বা বিরোধিতা দেখাতে গিয়ে কখনো কখনো দেশের স্বার্থ বা ইমেজ খর্বকরণ ইত্যাদি।
প্রথম আলো এসব বৈশিষ্ট্য থেকে কি পুরোপুরি মুক্ত? কিংবা এসব বৈশিষ্ট্য থেকে পুরোপুরি মুক্ত থাকা কি কোনো গণমাধ্যমের জন্য উচিত কাজ? আমার ব্যক্তিগত অভিমত হচ্ছে, প্রথম আলো ওপরে বর্ণিত দু-একটি প্রবণতা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত নয়। যেমন: ১০ ট্রাক অস্ত্র আটকের ঘটনা কিংবা জঙ্গিবাদী তৎপরতা প্রথম আলো অতিরিক্ত উৎসাহী হয়ে এবং জায়গা দিয়ে প্রকাশ করেছে। অবশ্যই এসব ঘটনা দেশের স্বার্থের জন্য বিপজ্জনক ও নিন্দাযোগ্য। অবশ্যই এসবের বিরুদ্ধে সংবাদপত্রের ভূমিকা থাকবে। কিন্তু তা হতে হবে পরিমিত মাত্রায়। ১০ ট্রাক অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনায় প্রথম আলো অনেক সময় অভিযুক্ত ব্যক্তিদের জড়িত থাকার বিবরণ সবিস্তারে ছেপেছে সরকারের বিভিন্ন সূত্রে। দেশের স্বার্থে এ ঘটনা নিয়ে সুষ্ঠু তদন্ত যতটা প্রয়োজন, অতিরিক্ত প্রচারণা সম্ভবত ততটা প্রয়োজন ছিল না। আবার জঙ্গি তৎপরতার খবরও প্রথম আলো যতটা বিস্তৃতভাবে প্রকাশ করেছে, তাতে মনে হয়নি এটা বিচ্ছিন্ন গোষ্ঠীগুলোর তৎপরতা মাত্র, বাংলাদেশের সামগ্রিক চিত্র নয়।
প্রথম আলো বুদ্ধিজীবী মহলের সবার বক্তব্য সমান গুরুত্ব দিয়ে ছাপার ক্ষেত্রে কখনো কখনো সীমাবদ্ধতার পরিচয় দিয়েছে। একদল বুদ্ধিজীবীকে প্রথম আলো সংবাদ প্রচারের ক্ষেত্রে বিশেষায়িত করে বিএনপিপন্থী বা জাতীয়তাবাদী ঘরানার হিসেবে, অন্য দলের ক্ষেত্রে শুধু বুদ্ধিজীবী, বিশেষজ্ঞ বা মানবাধিকার নেতা হিসেবে। কোনো কোনো সম্মানিত ব্যক্তি প্রথম আলোয় এত বেশি কাভারেজ পান যে তা কারও কারও কাছে দৃষ্টিকটুও লাগতে পারে।
এ ছাড়া প্রথম আলোয় প্রতিবেদন মিস হওয়ার ঘটনা ঘটে। দেখা গেল, অন্য কিছু পত্রিকা সংবাদটি ছেপেছে, কিন্তু প্রথম আলো ছাপেনি বা পরে ছেপেছে। এমন ঘটনা বেশি ঘটেনি, তার পরও সংবাদ-বুভুক্ষু কিছু পাঠকের কাছে বিষয়টি ভালো লাগার কথা নয়। বিজ্ঞাপন-আগ্রাসন থেকে এটি অনেক পত্রিকার তুলনায় মুক্ত। কিন্তু প্রথম আর শেষ পাতার অর্ধেক বিজ্ঞাপনে ভরে গেছে এমন ঘটনা প্রথম আলোর ক্ষেত্রেও কখনো কখনো ঘটে।
৪.
মানুষ হিসেবে আমরা কেউ পক্ষপাতমুক্ত নই। প্রথম আলোর বিরুদ্ধে এসব লিখতে আমার তাই ভালো লাগেনি। আমার অভিমতগুলো ভুল হতে পারে। এর সঙ্গে সম্পূর্ণ ভিন্নমতও পোষণ করতে পারেন অনেকে। প্রথম আলো তার ওয়েব সংস্করণে এর অবাধ সুযোগ করে দিয়েছে। প্রথম আলোর প্রতি সরাসরি অভিযোগ করেছিলেন নিউ এজ-এর সম্পাদক নূরুল কবীর। সেটিও দেখলাম রীতিমতো হাইলাইট করে ছাপানো হয়েছে ৩ নভেম্বরের প্রথম আলোতেই। এটা বাংলাদেশে খুব বিরল একটি ঘটনা।
প্রথম আলোর আরও বহু ভালো দিক আছে। সেগুলো ঘটা করে বলার তেমন প্রয়োজন নেই। ভালো ভালো অনেক কিছু না থাকলে প্রায় পাঁচ লাখ পাঠক এটি কিনে পড়ার আগ্রহ অনুভব করতেন না।
আমাদের প্রত্যাশা প্রথম আলোর আরও সাফল্য ও দীর্ঘায়ু। প্রত্যাশা বাংলাদেশের গণমাধ্যমের সার্বিক সাফল্য। গণতন্ত্র, সুশাসন ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বাংলাদেশে অন্যান্য বহু প্রতিষ্ঠানের চেয়ে গণমাধ্যম বেশি ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছে। আরও ব্যাপক ও কার্যকর ভূমিকা পালনও গণমাধ্যমের পক্ষে সম্ভব। সেই আশার আলো আমরা গণমাধ্যমকে ঘিরেই দেখি।
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
২০০০ সালে চূড়ান্তভাবে দেশে ফিরে দেখি, মাত্র দুই বছরে দাঁড়িয়ে গেছে প্রথম আলো। আমার বাবা তখনো ইত্তেফাক-এর মহা ভক্ত, বাসায় তাই দ্বিতীয় পত্রিকা হিসেবে প্রথম আলোর প্রবেশ। অল্প দিনে এটিই হয়ে যায় একমাত্র পত্রিকা। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোটের বিশাল বিজয়ের পর এর সম্ভাব্য কুফল প্রসঙ্গে লেখা নিয়ে হাজির হই প্রথম আলো অফিসে। মোটা ফ্রেমের চশমা পরা সিরিয়াস এক যুবক লেখা গ্রহণ করেন। তিনি শক্তিশালী কথাসাহিত্যিক মশিউল আলম।
প্রথম আলোর সঙ্গে আমার সরাসরি সম্পর্ক শুরু এভাবে। কিন্তু এর সঙ্গে আমার প্রতিদিনের এবং প্রকৃত সম্পর্ক পাঠক হিসেবে। প্রতিদিন প্রথম আলো পড়ে আমিও মুগ্ধ হই, বিস্মিত হই, কখনো কখনো অসন্তুষ্ট হই। এটাই স্বাভাবিক। একটি দৈনিক পত্রিকা কখনো নিখুঁত হতে পারে না, এমনকি সম্পূর্ণও হতে পারে না। এটি কখনো তার সব পাঠককে সমভাবে সন্তুষ্ট করতে পারে না। সংবাদপত্রের মানের পরীক্ষা হয় প্রতিদিন, প্রকাশ্যে এবং নানাভাবে।
২.
আশার কথা হচ্ছে, এই প্রবল পরীক্ষায় বাংলাদেশে সবচেয়ে মানোত্তীর্ণ পত্রিকাই সবচেয়ে বেশি পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে। ইত্তেফাক, জনকণ্ঠ, আজকের কাগজ কিংবা যুগান্তর তাদের সবচেয়ে মানোত্তীর্ণ সময়েই সবচেয়ে পাঠকপ্রিয় ছিল। সব দেশে সব সময় এমন হয় না। ওয়াশিংটন পোস্ট, গার্ডিয়ান কিংবা দ্য হিন্দু যথাক্রমে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও ভারতে সবচেয়ে মানসম্পন্ন পত্রিকা হিসেবে অধিকাংশের কাছে বিবেচিত। কিন্তু সর্বাধিক পাঠকপ্রিয়তা এসব দৈনিক অর্জন করতে পারেনি।
প্রথম আলো সর্বাধিক পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করেছে রুচিমান ও মানসম্মত সাংবাদিকতা করে। এটি কোনো স্থূল, হলুদ বা অপসাংবাদিকতার পথ ধরেনি; বরং কিছু কিছু ক্ষেত্রে এর ‘শুচিবাই’ অসাধারণ পর্যায়ের। প্রথম আলো ভয়াবহ ছবি ছাপা থেকে বিরত থাকে, স্ক্যান্ডাল-জাতীয় খবর পরিহার করে, প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত যৌন হয়রানির অভিযোগে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের নাম নির্দিষ্টকরণ থেকেও বিরত থাকে। আমার জানামতে, প্রথম আলো বাংলাদেশের প্রথম এবং একমাত্র বাংলা দৈনিক, যার সাংবাদিকদের জন্য নিজস্ব আচরণবিধি রয়েছে।
প্রথম আলো বাংলাদেশের ইতিহাসে একমাত্র পত্রিকা হিসেবে প্রথমে তিন লাখ, পরে চার লাখ এবং বর্তমানে সাড়ে চার লাখের ওপর প্রচারসংখ্যা অর্জন করেছে। এটি বড় খবর নয়। বড় খবর হচ্ছে, দায়িত্বশীল ও মননশীল থেকে সবচেয়ে বেশি পাঠকের কাছে যাওয়া যায়, এটি এর মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে। প্রথম আলো একই সঙ্গে রাজনৈতিকভাবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে নিরপেক্ষ থেকেছে। বাংলাদেশের মতো অপশাসনের দেশে একটি দায়িত্বশীল ও নিরপেক্ষ পত্রিকা সরকারের বিরাগভাজন হবে, এটা স্বাভাবিক। প্রথম আলোর ক্ষেত্রে অব্যাহতভাবে তা হয়েছে, গত ১২ বছরে এটি সব সরকারের চক্ষুশূল হয়েছে, প্রথম আলোর সম্পাদক ও সাংবাদিকদের নানাভাবে ভোগান্তির শিকার হতে হয়েছে। এর নিরপেক্ষতার সবচেয়ে বড় প্রমাণ এটাই।
৩.
প্রথম আলো তাই বলে কোনো বিচ্ছিন্ন দ্বীপ নয়। এটা বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলোর বাইরের কোনো জগৎ নয়। প্রথম আলোর মতো সাফল্য অন্য পত্রিকাগুলোরও রয়েছে, অন্য পত্রিকাগুলোর ব্যর্থতা প্রথম আলোর ক্ষেত্রে কিছুটা হলেও রয়েছে। রাজনৈতিকভাবে অতি প্রভাবশালী ব্যক্তি বা মালিকপক্ষ জড়িত নয় অন্তত এমন ক্ষেত্রে অধিকাংশ গণমাধ্যম সোচ্চারভাবে দুর্নীতি, অনাচার ও অনিয়মের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। এসিড নিক্ষেপ, নারী নির্যাতন, মাদকাসক্তি, ভণ্ডপীর—এসব সামাজিক সমস্যার ক্ষেত্রে অনেক গণমাধ্যম জনস্বার্থমূলক ভূমিকা পালন করেছে। মেধাবীদের সংগঠিত করা ও উৎসাহ প্রদান, সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি, দুস্থ মানুষের পাশে এসে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে কিছু গণমাধ্যম অসাধারণ ভূমিকাও রেখেছে।
সমস্যা হয় রাজনৈতিক ক্ষেত্রে। ক্ষুদ্র কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে বাংলাদেশের গণমাধ্যম সব সময়ে গণতন্ত্রের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। তবে এ অবস্থান গ্রহণ অনেক ক্ষেত্রে কোনো নির্দিষ্ট দলের দৃষ্টিকোণ থেকে নেওয়া হয়। ফলে বাংলাদেশের কিছু সংবাদপত্র এবং টিভি চ্যানেলের ক্ষেত্রে বলে দেওয়া সম্ভব যে তারা কোনো নির্দিষ্ট দলের পক্ষে রয়েছে। উন্নত বিশ্বের সংবাদপত্রও কোনো কোনো রাজনৈতিক দলের প্রতি সমর্থন দিয়ে থাকে। কিন্তু এই সমর্থন যত না দলের পক্ষে, তার চেয়ে বেশি দলের কিছু নীতি ও আদর্শের পক্ষে। ফলে নীতি বা আদর্শবিরোধী অবস্থান নিলে সংবাদপত্রও তার সমর্থিত দলের বিরুদ্ধে সংবাদভাষ্য, এমনকি প্রতিবেদন প্রকাশ করে থাকে। বাংলাদেশে এটা সব সময় ঘটে না। প্রথম আলোর উজ্জ্বল একটি দিক হচ্ছে, বাংলাদেশের কোনো রাজনৈতিক দল এটাকে তাদের সমর্থক পত্রিকা মনে করে না। সন্ত্রাস, দুর্নীতি, অনিয়ম, দলীয়করণের বিরুদ্ধে প্রথম আলো বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিল, বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধেও সোচ্চার আছে।
তাই বলে কি প্রথম আলোর কোনো পক্ষপাতিত্ব নেই, দুর্বলতা নেই? তার আগে বলে নিই, একজন নিবিষ্ট পাঠক হিসেবে বাংলাদেশে অধিকাংশ সংবাদপত্রের মধ্যে রাজনৈতিক প্রশ্নে কিছু পক্ষপাতিত্বের প্রবণতা আমি লক্ষ করেছি। এগুলো হচ্ছে—ক. সমর্থিত সরকারি দলের দুর্নীতি, অনিয়ম বা মানবাধিকার লঙ্ঘন সম্পর্কে স্ব-উদ্যোগী হয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশে শৈথিল্য, বিপক্ষ দল ক্ষমতায় গেলে তার দুর্নীতি ও অনিয়ম সম্পর্কে কখনো কখনো ভিত্তিহীন তথ্য প্রকাশ; খ. সংসদ কার্যকর করার ক্ষেত্রে বা প্রশাসন সচল রাখার ক্ষেত্রে সমর্থিত সরকারি দলের ব্যর্থতা সম্পর্কে প্রতিবেদন কম গুরুত্ব দিয়ে ছাপানো বা এ ক্ষেত্রে বিরোধী দলের ব্যর্থতা বড় করে দেখানো; গ. সমর্থিত দলের জনসভার ছবি এবং বিবরণ অতিরঞ্জিত করে ছাপানো এবং বিরোধী দলের ক্ষেত্রে বিপরীত অবস্থান গ্রহণ; ঘ. সম্পাদকীয় পাতায় নির্দিষ্ট দলের পক্ষের লেখকদের লেখা ছাপানো এবং বিরোধীদের লেখা নিরুৎসাহিতকরণ; ঙ. সমর্থিত দলের পক্ষের রাজনীতিবিদেরা আইনজীবী বা নাগরিক সমাজের নামী ব্যক্তিত্ব হলে তাঁদের রাজনৈতিক পরিচয়কে আড়াল করে বিশেষজ্ঞ হিসেবে তাঁদের মতামত গ্রহণ করে কোনো বিষয়ে প্রচারণা চালানো; চ. বিশেষ বিশেষ সময় ধর্ম, জঙ্গিবাদ, স্বাধীনতাযুদ্ধে অবদান—এ ধরনের রাজনৈতিকভাবে অতি স্পর্শকাতর বিষয়ে স্ব-উদ্যোগী হয়ে প্রচারণা চালানো; চ. নিজস্ব ঘরানার এনজিওদের সভা-সেমিনারে প্রদত্ত পছন্দনীয় ব্যক্তিদের নির্বাচিত বক্তব্য খুব গুরুত্বের সঙ্গে ছাপিয়ে পরে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় সেই ্বক্তব্যকে জনগণের বক্তব্য বা সুশীল সমাজের আকাঙ্ক্ষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা; ছ. গুরুত্বপূর্ণ আইনগত প্রশ্নে পছন্দনীয় বক্তব্য প্রদান করবে শুধু এমন বিশেষজ্ঞদের মতামত গুরুত্ব দিয়ে ছাপানো; জ. দল বা গোষ্ঠীর প্রতি অন্ধ সমর্থন বা বিরোধিতা দেখাতে গিয়ে কখনো কখনো দেশের স্বার্থ বা ইমেজ খর্বকরণ ইত্যাদি।
প্রথম আলো এসব বৈশিষ্ট্য থেকে কি পুরোপুরি মুক্ত? কিংবা এসব বৈশিষ্ট্য থেকে পুরোপুরি মুক্ত থাকা কি কোনো গণমাধ্যমের জন্য উচিত কাজ? আমার ব্যক্তিগত অভিমত হচ্ছে, প্রথম আলো ওপরে বর্ণিত দু-একটি প্রবণতা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত নয়। যেমন: ১০ ট্রাক অস্ত্র আটকের ঘটনা কিংবা জঙ্গিবাদী তৎপরতা প্রথম আলো অতিরিক্ত উৎসাহী হয়ে এবং জায়গা দিয়ে প্রকাশ করেছে। অবশ্যই এসব ঘটনা দেশের স্বার্থের জন্য বিপজ্জনক ও নিন্দাযোগ্য। অবশ্যই এসবের বিরুদ্ধে সংবাদপত্রের ভূমিকা থাকবে। কিন্তু তা হতে হবে পরিমিত মাত্রায়। ১০ ট্রাক অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনায় প্রথম আলো অনেক সময় অভিযুক্ত ব্যক্তিদের জড়িত থাকার বিবরণ সবিস্তারে ছেপেছে সরকারের বিভিন্ন সূত্রে। দেশের স্বার্থে এ ঘটনা নিয়ে সুষ্ঠু তদন্ত যতটা প্রয়োজন, অতিরিক্ত প্রচারণা সম্ভবত ততটা প্রয়োজন ছিল না। আবার জঙ্গি তৎপরতার খবরও প্রথম আলো যতটা বিস্তৃতভাবে প্রকাশ করেছে, তাতে মনে হয়নি এটা বিচ্ছিন্ন গোষ্ঠীগুলোর তৎপরতা মাত্র, বাংলাদেশের সামগ্রিক চিত্র নয়।
প্রথম আলো বুদ্ধিজীবী মহলের সবার বক্তব্য সমান গুরুত্ব দিয়ে ছাপার ক্ষেত্রে কখনো কখনো সীমাবদ্ধতার পরিচয় দিয়েছে। একদল বুদ্ধিজীবীকে প্রথম আলো সংবাদ প্রচারের ক্ষেত্রে বিশেষায়িত করে বিএনপিপন্থী বা জাতীয়তাবাদী ঘরানার হিসেবে, অন্য দলের ক্ষেত্রে শুধু বুদ্ধিজীবী, বিশেষজ্ঞ বা মানবাধিকার নেতা হিসেবে। কোনো কোনো সম্মানিত ব্যক্তি প্রথম আলোয় এত বেশি কাভারেজ পান যে তা কারও কারও কাছে দৃষ্টিকটুও লাগতে পারে।
এ ছাড়া প্রথম আলোয় প্রতিবেদন মিস হওয়ার ঘটনা ঘটে। দেখা গেল, অন্য কিছু পত্রিকা সংবাদটি ছেপেছে, কিন্তু প্রথম আলো ছাপেনি বা পরে ছেপেছে। এমন ঘটনা বেশি ঘটেনি, তার পরও সংবাদ-বুভুক্ষু কিছু পাঠকের কাছে বিষয়টি ভালো লাগার কথা নয়। বিজ্ঞাপন-আগ্রাসন থেকে এটি অনেক পত্রিকার তুলনায় মুক্ত। কিন্তু প্রথম আর শেষ পাতার অর্ধেক বিজ্ঞাপনে ভরে গেছে এমন ঘটনা প্রথম আলোর ক্ষেত্রেও কখনো কখনো ঘটে।
৪.
মানুষ হিসেবে আমরা কেউ পক্ষপাতমুক্ত নই। প্রথম আলোর বিরুদ্ধে এসব লিখতে আমার তাই ভালো লাগেনি। আমার অভিমতগুলো ভুল হতে পারে। এর সঙ্গে সম্পূর্ণ ভিন্নমতও পোষণ করতে পারেন অনেকে। প্রথম আলো তার ওয়েব সংস্করণে এর অবাধ সুযোগ করে দিয়েছে। প্রথম আলোর প্রতি সরাসরি অভিযোগ করেছিলেন নিউ এজ-এর সম্পাদক নূরুল কবীর। সেটিও দেখলাম রীতিমতো হাইলাইট করে ছাপানো হয়েছে ৩ নভেম্বরের প্রথম আলোতেই। এটা বাংলাদেশে খুব বিরল একটি ঘটনা।
প্রথম আলোর আরও বহু ভালো দিক আছে। সেগুলো ঘটা করে বলার তেমন প্রয়োজন নেই। ভালো ভালো অনেক কিছু না থাকলে প্রায় পাঁচ লাখ পাঠক এটি কিনে পড়ার আগ্রহ অনুভব করতেন না।
আমাদের প্রত্যাশা প্রথম আলোর আরও সাফল্য ও দীর্ঘায়ু। প্রত্যাশা বাংলাদেশের গণমাধ্যমের সার্বিক সাফল্য। গণতন্ত্র, সুশাসন ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বাংলাদেশে অন্যান্য বহু প্রতিষ্ঠানের চেয়ে গণমাধ্যম বেশি ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছে। আরও ব্যাপক ও কার্যকর ভূমিকা পালনও গণমাধ্যমের পক্ষে সম্ভব। সেই আশার আলো আমরা গণমাধ্যমকে ঘিরেই দেখি।
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন