পৃষ্ঠাসমূহ

শুক্রবার, ২৭ জানুয়ারী, ২০১২

আওয়ামী লীগ বনাম বিএনপি

গত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও তার সমর্থক দলগুলো ভোট পেয়েছিল প্রায় ৬০ শতাংশ। দল হিসেবে আওয়ামী লীগ সফল হলে এখনো অন্তত এই সংখ্যার মানুষের তাদের পক্ষে থাকার কথা। প্রথম আলোর ২০১০ সালে জরিপে তা দেখা যায়নি।
আওয়ামী লীগকে গত বছর সবচেয়ে কালিমালিপ্ত করেছে ছাত্রলীগ ও কিছু ক্ষেত্রে যুবলীগের কর্মকাণ্ড। বিরোধী দল শুধু নয়, সরকারি কর্মকর্তা ও সাধারণ মানুষও এদের সন্ত্রাসের শিকার হয়েছে এ সময়। প্রথম আলোর জরিপে ২০০৯ সালে ১১ শতাংশ মানুষ বলেছিলেন তাঁরা ছাত্রলীগ ও যুবলীগের কর্মকাণ্ডে একেবারেই সন্তুষ্ট নন। ২০১০ সালের জরিপে ২৬ শতাংশ মানুষ অর্থাৎ প্রায় আড়াই গুণ বেশি মানুষ তাঁদের তীব্র অসন্তোষের কথা জানিয়েছেন। ২৯ শতাংশ (আগের বছর ১৮ শতাংশ) জানিয়েছেন, তাঁরা তেমন সন্তুষ্ট নন। তার মানে পুরোপুরি ও অনেকাংশে অসন্তুষ্ট মানুষের মোট সংখ্যা ৫৫ শতাংশ।
এ দেশে অঙ্গসংগঠনের কোনো স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নেই, তাদের কর্মকাণ্ডের দায় তাই কিছুটা হলেও মূল দলের ওপর এসে পড়ার কথা। প্রথম আলোর জরিপে অবশ্য তা সামান্যই প্রমাণিত হয়েছে। প্রথম আলো প্রশ্ন করেছিল আওয়ামী লীগ কি তার কর্মীদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে? ৪৫ শতাংশ (আগের বছর ৪৭ শতাংশ) বলছেন পেরেছে, ৫৩ শতাংশ (আগের বছর ৫২ শতাংশ) বলেছেন পারেনি। প্রশ্নটি যদি এমন হতো যে ছাত্রলীগ-যুবলীগকে আওয়ামী লীগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে কি না, তাহলে নেতিবাচক ভোটের সংখ্যা বাড়ত বলে আমার ধারণা।
গত বছর মানুষের হতাশার একটি বড় কারণ ছিল রাজনৈতিক সংস্কৃতির দৈন্যদশা। আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা এবং বর্তমান নেতাদের সম্পর্কে অশোভন, কখনো কখনো অশ্লীল কথাবার্তা বলেছেন। বিরোধী দলের কর্মসূচি নস্যাৎ করার জন্য শুধু সরকারের বাহিনীগুলো নয়, আওয়ামী লীগ তার দলগত দাপটও ব্যবহার করেছে। বিরোধী দলের প্রতি মামলা, হামলা ও হুমকির ঘটনা গত বছরের তুলনায় বেড়েছে। অন্যদিকে বিরোধী দলও বেশি আক্রমণাত্মক হয়েছে, কখনো আওয়ামী লীগের নেতাদের সম্পর্কে অশোভন উক্তি করেছে, অধিকাংশ সময়ে সংসদ বর্জন করেছে। জরিপে এর কিছুটা প্রতিফলন রয়েছে। ২০০৯ সালে ৫৯ শতাংশ মানুষ রাজনীতিতে ভালো পরিবর্তন লক্ষ করেছিলেন, এবার সেই সংখ্যা নেমে এসেছে ৪৭ শতাংশে। আগের বছর ৫৯ শতাংশ মানুষ মনে করতেন হরতাল, সহিংসতা ইত্যাদি রাজনৈতিক অসুখ ফিরে আসবে না দেশে। এখন তা মনে করেন ৫৩ শতাংশ মানুষ। অর্থাৎ খুব তীব্রভাবে না হলেও মানুষের মধ্যে হতাশা বেড়েছে।
জরিপের ফলাফলে আওয়ামী লীগের জন্য যা গভীরতর সতর্কবার্তা, তা হচ্ছে ভোটার হিসেবে মানুষের মনোভাব। এখন নির্বাচন হলে আপনি কোন দলকে ভোট দেবেন? এই প্রশ্নের উত্তরে গত বছর জরিপে অংশ নেওয়া ৫৬ শতাংশ মানুষ বলেছিলেন, তাঁরা আওয়ামী লীগকে ভোট দেবেন, এবার তা ১০ শতাংশ কমে ৪৬ শতাংশে নেমে এসেছে। ঢাকায় এই জনপ্রিয়তা কমেছে ১৬ শতাংশ, চট্টগ্রামে ইতিমধ্যে বিএনপি আওয়ামী লীগের চেয়ে সামান্য হলেও বেশি জনপ্রিয় দল। গোটা দেশের হিসাবে, গত বছর বিএনপির প্রতি সমর্থন জানিয়েছিলেন ২৫ শতাংশ মানুষ, এবার তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৯ শতাংশে। জরিপের ফল অনুসারে সামগ্রিকভাবে আওয়ামী লীগ এখনো বিএনপির চেয়ে ৭ শতাংশ বেশি জনপ্রিয়। তবে এক বছরে ১০ শতাংশ জনপ্রিয়তা কমে যাওয়ার গতি মোটামুটিভাবে অব্যাহত থাকলে আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ সুখকর হবে না, দলটির মধ্যে এখনই এই ভাবনা আসা উচিত।
বিএনপির প্রতি মানুষের সমর্থন বেড়েছে। তবে এই বৃদ্ধি যত না বিএনপি নিজে অর্জন করেছে, তারচেয়ে বেশি আওয়ামী লীগের ব্যর্থতার কারণে হয়েছে। আমরা এটিকে বলি নেতিবাচক ভোট। এর প্রমাণ জরিপে রয়েছে। যেমন: ৮৩ শতাংশ (আগের বছর ৮৮ শতাংশ) মানুষ মনে করেন বিএনপির সংসদ বর্জন ঠিক হয়নি, ৬০ শতাংশ (আগের বছর ৫০ শতাংশ) মানুষ মনে করেন বিএনপি সংসদের বাইরে কার্যকর কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি, মাত্র ২৪ শতাংশ (আগের বছর ৩০ শতাংশ) মানুষের ধারণা, বিএনপি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে ভালো ভূমিকা রেখেছে। এ বছর বিএনপির ভূমিকার প্রতি মানুষের নেতিবাচক মনোভাব বাড়লেও তাদের প্রতি সমর্থন বাড়ার একটিই কারণ হতে পারে; তা হচ্ছে সরকারের ব্যর্থতা তুলনামূলকভাবে আরও প্রকটভাবে ধরা পড়েছে মানুষের কাছে।
বাংলাদেশে দল মানেই একক নেতৃত্বকেন্দ্রিক। সরকার মানেও তা-ই। অনেক দেশেই তা নয়। আমেরিকায় ওবামার জনপ্রিয়তা যতটা ওঠানামা করে, রিপাবলিকান পার্টির ততটা হয় না। ব্রিটেনে একসময় লেবার পার্টির জনপ্রিয়তার ভাটার সময়েও টনি ব্লেয়ার জনপ্রিয় ছিলেন। বাংলাদেশে সংগত কারণেই তা হওয়ার কথা নয়। জরিপে তাই দলের মতো জনপ্রিয়তা কমতির দিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনারও। জনপ্রিয়তার বিচারে আওয়ামী লীগের চেয়ে এখন বিএনপির ব্যবধান ৭ শতাংশ। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে কাকে দেখতে চান, এই প্রশ্নের উত্তরে শেখ হাসিনা (৪৮ শতাংশ) খালেদার (৪০ শতাংশ) চেয়ে প্রায় একই রকমভাবে ৮ শতাংশ এগিয়ে এখন। এখানেও চট্টগ্রামে খালেদা এগিয়ে, বাকি তিনটি বিভাগে হাসিনা এগিয়ে। বিভাগভিত্তিক জরিপে বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তরে রাজশাহীর লোকজন এখন পর্যন্ত সরকার ও আওয়ামী লীগের প্রতি সবচেয়ে ইতিবাচকভাবে ভোট দিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রিত্বের ক্ষেত্রেও রাজশাহী বিভাগে হাসিনা এগিয়ে ১৬ শতাংশ ভোটে। গোটা দেশে শহরাঞ্চলগুলোয় হাসিনা এগিয়ে মাত্র ২ শতাংশ, গ্রামাঞ্চলে এগিয়ে ৯ শতাংশ। আবার পুরুষদের মধ্যে হাসিনা এগিয়ে ৯ শতাংশ, নারীদের মধ্যে ২ শতাংশ।
দুই নেত্রীর গ্রহণযোগ্যতার হ্রাসবৃদ্ধির চিত্র ফুটে উঠেছে আরও দুটো প্রশ্নে। এবারের জরিপ অনুসারে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনাকে খুব ভালো মনে করেন ৩২ শতাংশ মানুষ, আগের বছর মনে করতেন ৩৯ শতাংশ মানুষ। খালেদা জিয়াকে জাতীয় নেত্রী হিসেবে খুব ভালো মনে করতেন ২৩ শতাংশ মানুষ, এবার তা ২৪ শতাংশ। তাঁদের একদমই ভালো মনে করেন না এমন মানুষের সংখ্যা শেখ হাসিনার ক্ষেত্রে বেড়েছে ৫ শতাংশ, খালেদার ক্ষেত্রে বেড়েছে ১ শতাংশ।
আমার ধারণা, এই জরিপের ফলাফল দুই দলকেই হতাশ করবে। বিএনপি ভাবে, এখন নির্বাচন হলে অবশ্যই আওয়ামী লীগ পরাজিত হবে; আওয়ামী লীগ ভাবে, দল হিসেবে বিএনপি প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। প্রথম আলোর জরিপের ফলাফলে দুই দলের ধারণাই ভুল মনে হয়। এখনো এগিয়ে থাকলেও আওয়ামী লীগের সমর্থন এ বছর উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে, বিএনপির সমর্থন আগের তুলনায় বেড়েছে। কিন্তু সমর্থন মানে গ্রহণযোগ্যতা নয়। দুই দলের প্রতি মানুষের নেতিবাচক মনোভাব বেড়েছে। তাদের সামনে তৃতীয় কোনো বিকল্প নেই। আওয়ামী লীগের প্রতি অসন্তুষ্ট কিছু মানুষ, তাই বিএনপিকে ভোট দেবে বলছেন।
নেতিবাচকভাবে ক্ষমতার পালাবদল আমরা আগেও দেখেছি। সরকার আর আওয়ামী লীগের ব্যর্থতা অব্যাহত থাকলে আগামী নির্বাচনেও হয়তো তা হতে পারে। কিন্তু আমরা চাই, দুই দলের ইতিবাচক প্রতিযোগিতা। সুশাসন প্রদানকারী হিসেবে আওয়ামী লীগ আর সুশাসন প্রদানের সম্ভাবনাময় দল হিসেবে বিএনপির প্রতিযোগিতাই কেবল বাংলাদেশকে প্রত্যাশিত মাত্রায় এগিয়ে নিতে পারে। অন্য কিছু নয়।
আসিফ নজরুল: রাজনৈতিক বিশ্লেষক, গবেষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক।
তারিখ: ০৬-০১-২০১১

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন