পৃষ্ঠাসমূহ

শুক্রবার, ২৭ জানুয়ারী, ২০১২

ডায়েরি: কলাম লেখকের রাত

সন্ধ্যা থেকে বসে আছি বিরক্ত হয়ে। কী নিয়ে লিখব ঠিক করতে পারছি না। সংসদে সংবিধান সংশোধনী কমিটি হয়েছে। সংবিধান আমার প্রিয় বিষয়। কাজেই আমার ঝাঁপিয়ে পড়ে লেখার কথা এ নিয়ে। কিন্তু আমি বুঝতেই পারছি না এখনই কেন এই কমিটি। বলা হয়েছে, আদালতের রায় বাস্তবায়নের জন্য কমিটি গঠিত হয়েছে। অথচ আমি জানি, আপিল বিভাগের হয়ে সাবেক প্রধান বিচারপতি তাফাজ্জল হোসেন এই রায় লেখাই শেষ করেননি। আমার জানা ভুল হতে পারে। সাংবাদিক মিজানুর রহমান খানকে ফোন করি। তিনিও জানালেন, রায় লেখা শেষ হয়নি। তিনি ক্ষুব্ধ হয়ে আরও কিছু কথা বললেন। মানহানি মামলার ভয়ে সেগুলো লেখার সাহস আমার নেই। দেশে এখন মানহানি মামলার জোয়ার বইছে। যার ‘মানহানি’ হয়েছে তিনি না, মামলার বাদী হচ্ছেন অন্য কেউ। আদালত এসব মামলা গ্রহণ করছেন। আবার ক্ষমতাসীন দলের কারও বিরুদ্ধে মানহানির মামলা হলে তা গ্রহণ করা হচ্ছে না। এর মাজেজা নিয়ে লিখতে হলে আমাকে কিছুটা পড়াশোনা করতে হবে। কিন্তু সেটি করার ইচ্ছে নেই এখন।
তার চেয়ে সংবিধান সংশোধনী কমিটি নিয়ে জানার চেষ্টা করি। দেশের একটি বিখ্যাত সংবাদ সংস্থার ওয়েব পাতায় এ নিয়ে বেশ কিছু প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে। মূল লেখায় বলা হয়েছে, ১৯৭২ সালের সংবিধানে ফিরে গেলে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো নিষিদ্ধ হয়ে যাবে। এই ভুল ব্যাখ্যা প্রতিবেদকের একার নয়। নামকরা দু-একজন মন্ত্রীও ইতিমধ্যে এ রকম মন্তব্য সাংবাদিকদের কাছে করেছেন। আসলে তাঁদের বক্তব্য ঠিক নয়। ১৯৭২ সালের সংবিধানে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের ‘অপব্যবহার’কে নিষিদ্ধ করা হয়েছে, ধর্মের ‘ব্যবহার’কে নয়। ব্যবহার ও অপব্যবহার দুটো ভিন্ন জিনিস। ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো নিষিদ্ধ করতে হলে ১৯৭২ সালের সংবিধানের ১২ অনুচ্ছেদ পুনরুজ্জীবিত করতে হবে, ১২ অনুচ্ছেদের আলোকে আইন প্রণয়ন করতে হবে। সেখানে ধর্মের অপব্যবহার বলতে কী বোঝায় তা ব্যাখ্যা করতে হবে। এরপর কোনো রাজনৈতিক দল ধর্মের অপব্যবহার করলে একটি পদ্ধতি অনুসরণ করে তাকে নিষিদ্ধ করা যাবে। কাজেই ১৯৭২ সালের সংবিধানে ফিরে যাওয়া মাত্র ধর্মভিত্তিক দলগুলো অবৈধ বা নিষিদ্ধ হয়ে যাবে না।
এসব ভেবেও সংবিধান নিয়ে লিখতে ইচ্ছে হয় না। আমার প্রিয় কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ এ নিয়ে লিখছেন প্রথম আলো পত্রিকাতে। মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে টেলিফোন আলাপে এ কথা জানিয়েছেন তিনি। নিশ্চয়ই আরও অনেকে লিখবেন। এ বিষয়ে লেখার সময়ও থাকবে আরও অনেক দিন।

২.
চৌধুরী আলমকে নিয়ে লেখা যায় এখন। কয়েক সপ্তাহ আগে তিনি নিখোঁজ হয়েছেন। পরিবারের লোকজন তখনই অভিযোগ করেছিল যে সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন তাঁকে তুলে নিয়ে গেছে। অনেক দিন চুপচাপ থেকে পুলিশ এ বিষয়ে তাদের বক্তব্য জানিয়েছে। তাদের ধারণা, চৌধুরী আলমকে অপহরণ করা হয়েছে। কে করেছে, কারা করেছে, তাঁর খোঁজ এখনো পাওয়া যাচ্ছে না কেন, পুলিশ কিছু বলেনি। বিএনপি বলেছে, এটা সরকারের কাজ, এমন আশঙ্কাও প্রকাশ করা হচ্ছে যে তাঁকে খুন করে লাশ গুম করে ফেলা হয়েছে। সিসটেমেটিক ক্রসফায়ার বিএনপি সরকার শুরু করেছিল। আওয়ামী লীগ কি তাহলে আরেক দফা বাড়িয়ে লাশ গুম করার চর্চা শুরু করল? টিভি সংবাদে দেখি, আওয়ামী লীগের মাঠ গরম করা নেতারা দাবি করছেন, বিএনপিই আলমকে লুকিয়ে রেখেছে। কোনো সাংবাদিক তাঁদের জিজ্ঞেস করল না, সরকার এত দিনেও তাহলে তাঁকে খুঁজে বের করছে না কেন?
ভয়াবহ ব্যাপার হচ্ছে, সরকার এই অজুহাতে বেছে বেছে বিএনপির কয়েকজন নেতাকে রিমান্ডে নিতে পারে এখন। রিমান্ড চলাকালে পুলিশ কর্মকর্তা স্মিতহাস্যে সাংবাদিকদের জানাতে পারেন, বিএনপির নেতারা এমন কথাই স্বীকার করেছেন রিমান্ডে! আরও কী কী ষড়যন্ত্র তারা করছেন তাও সবিস্তার জানাতে পারেন। টিভি আর পত্রিকা ফলাও করে তা প্রচার করবে। দেশের মানুষের আরও একবার মাথা খারাপ অবস্থা হবে। কারও কারও মাথায় নতুন দুর্ভাবনা ঢুকবে। এই যেমন আমারই বেশ কিছুদিন ধরে মনে হচ্ছে, বাংলাদেশে সাংবাদিকতা এখন থমকে আছে কারও কারও বরাতে সংবাদ প্রচারে। সত্যানুসন্ধানের গরজ নেই যেন কারও!

৩.
রাত ১০টার সংবাদ শেষ হয়েছে কিছুক্ষণ আগে। সেখানে একটি সুপরিচিত বেসরকারি ক্লিনিক ভাঙচুরের দৃশ্য দেখানো হয়েছে। অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে সাধারণ একটি টেস্ট করাতে নিয়ে আসা হয়েছিল ক্লিনিকে। সেখানে তাঁকে ইঞ্জেকশন দেওয়া হলো, একটু পরেই মৃত ঘোষণা করা হলো। এমন হূদয়বিদারক যন্ত্রণা কার সহ্য হয়! স্বজনেরা ভাঙচুর করলেন মনের দুঃখে। একটি কারণ হয়তো এই যে তাঁরা জানেন, এর কোনো বিচার হবে না এ দেশে। সংবাদ শেষ হতে সেই ক্লিনিকেরই বিজ্ঞাপন: ‘উন্নত বিশ্বের সেবা বাংলাদেশে’! আনিসুল হক এই ব্যাপারস্যাপার দেখলে মজার একটি গদ্যকার্টুন লিখতে পারতেন।
উন্নত বিশ্বের কোনো সেবাই নেই আসলে এ দেশে। বরং আছে অত্যাচার-অনাচার। ডাক্তার হলে মানুষ খুন করে বহাল তবিয়তে থাকা যায় এ দেশে। আমরা সুযোগ পেলেই বলি, রাজনীতিবিদদের কোনো বিচার নেই দেশে, তারা জবাবদিহির ঊর্ধ্বে। আসলে জবাবদিহির ঊর্ধ্বে আরও বহু ধরনের মানুষ। শিক্ষক হলে এ দেশে যৌননির্যাতন করে রেহাই পাওয়া যায়। ধর্ষনের সেঞ্চুরি করা ছাত্রনেতাকে রক্ষার চেষ্টার পর উপদেষ্টা হওয়া যায়। আইনজীবী হলে বিনা রসিদে মক্কেলের টাকা নিয়ে বছরের পর বছর নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরানো যায়। তারকা সাংবাদিক হলে হাজার টাকার বেতনে কোটি টাকার দালানকোঠার মালিক হওয়া যায়। প্রকৌশলী হলে কয়েকবার হজে যাওয়ার কারণ ও সামর্থ্য অর্জন করা যায়। ভূমিদস্যু হলে কয়েক গন্ডা মন্ত্রী-সাংসদ পকেটে ঢুকিয়ে রাখা যায়।
সব ডাক্তার, আইনজীবী, শিক্ষক কিংবা সাংবাদিক এমন না। কিন্তু কেউ কেউ তো অবশ্যই এমন। এ দেশে বিচার নেই তাদের।

৪.
রাত বাড়ছে। ক্যালেন্ডারের হিসাবে এখন ২২ জুলাই ২০১০। বেলা ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার ক্লাস। আমার পড়ানোর কথা ছিল প্রাণবৈচিত্র্য চুক্তি নিয়ে। এটি কঠিন বিষয়। আমার ছাত্ররা অনুরোধ করেছে সহজ কোনো চ্যাপ্টার পড়াতে। তাদের দোষ না। কয়েক দিন পর তারা সরকারি চাকুরির আশায় বিসিএস পরীক্ষা দেবে। সেখানে মাত্র ৪৫ শতাংশ পদ উন্মুক্ত রাখা হয়েছে মেধাবীদের জন্য। সংখ্যাগরিষ্ঠ অর্থাৎ বাকি ৫৫ শতাংশ সংরক্ষিত বিভিন্ন কোটাধারীদের জন্য। পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে এই অদ্ভুত বিটকেলে ব্যবস্থা আছে বলে আমার জানা নেই। আমার বেশ কয়েকজন ছাত্র এ নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছে। এখন তারা অনেক কম আসনের জন্য প্রতিযোগিতা করবে কোটাধারীদের যন্ত্রণায়। প্রাণবৈচিত্র্যের মতো কঠিন বিষয়ে ঢোকার মানসিকতা এখন থাকার কথা না।
সময় থাকলে বরং হয়তো ক্রিকেটের খবর রাখত আমার ছাত্রছাত্রীরা। অস্ট্রেলিয়াকে মাত্র ৮৮ রানে গুটিয়ে দিয়েছে পাকিস্তান। ক্রিকেটে অমিত সম্ভাবনাময় এই দেশটি থমকে আছে চরম অরাজক ব্যবস্থাপনার কারণে। বাংলাদেশের ক্রিকেটের ব্যবস্থাপনাও ভালো নয়। চলচ্চিত্র নির্মাতা ফারুকীর বিয়েতে একজন সাবেক ক্রিকেটার শোনালেন ত্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ডের এক বর্তমান কর্তার হাস্যকর কর্মকাণ্ড। তিনি নাকি একবার দলকে পরামর্শ দিয়েছিলেন: একজন ব্যাটসম্যান, তারপর একজন বোলার—এভাবে ব্যাটিং অর্ডার সাজানোর জন্য। এমন ক্রিকেটবোদ্ধা নেতার আরও কত পরামর্শ থাকে কে জানে! তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পর আয়ারল্যান্ড, নেদারল্যান্ডের মতো টিমের কাছে হারছে বাংলাদেশ। লজ্জায়-অপমানে ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে ক্রিকেটপ্রেমীদের মন।

৫.
ক্রিকেট নিয়ে বেশি লেখার ক্ষমতা নেই আমার। আমি বরং এক রাতের এই ডায়েরি নিজেই পড়ি। অবাক হয়ে লক্ষ করি, অল্প সময়ে কত কিছু নিয়ে ভাবি আমরা। কতবার কাতর হয়ে ওঠে আমাদের মন। নিজের কষ্টে, অন্যের বেদনায়। সদ্য বিপত্নীক মানুষটিকে চিনি না আমি। কিন্তু ভাবি, অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীর মৃতদেহ নিয়ে বাড়ি ফেরা মানুষটি কি পারবেন ঘুমাতে আজ রাতে? কোনো দিনও কি পারবেন? চৌধুরী আলমকে কি আর কোনো দিন বাবা বলে ডাকতে পারবেন তার সন্তান? সংবিধান নিয়ে আবার কি যুদ্ধে মেতে উঠবে আওয়ামী লীগ-বিএনপি? আবার কে হবেন খুন, কে যাবেন রিমান্ডে, কার লাশ হবে গুম! আরও কতশত প্রাণ, ঘন সবুজ ঘাস আর শান্ত দিঘি বিলীন হবে ক্রূর কংক্রিটের থাবায়! আরও কত তরুণের বুক খানখান হবে চাকরি খুঁজে খুঁজে।
বাইরে গভীর হয় রাত, ভেতরে গভীরতর রাত। আমার, আমাদের অনেকের!
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন