পৃষ্ঠাসমূহ

শুক্রবার, ২৭ জানুয়ারী, ২০১২

চোর-বাটপারদের’ সঙ্গেই বসুন

আমাদের প্রধানমন্ত্রী কৌতুকপ্রিয় মানুষ। তবে তাঁর হাস্যরসে কখনো কখনো কিছুটা আত্মম্ভরিতার প্রকাশ থাকে। তিনি বিদেশে যেতে পছন্দ করেন। সেখানেও তিনি বিরোধী দল ও নেতাদের নিয়ে বিদ্রূপাত্মক মন্তব্য করেন। নিশ্চয়ই ভক্ত-অনুসারীরা তা উপভোগ করেন এবং তাঁকে উৎসাহিত করেন। আনগার্ডেড বা অনিয়ন্ত্রিত কথাবার্তা সেখানে তিনি আগে বলেছেন, এবার যুক্তরাষ্ট্র সফরেও বললেন। তিনি বললেন: মাসে একবার হরতাল পরিবেশবান্ধব, তাই তা হলে অসুবিধা নেই। তাঁর এই অভিনব বিশ্লেষণে উদারতা থাকতে পারে, কিন্তু তাতে ঝুঁকিও রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী এ বক্তব্যের পর যেসব মন্ত্রী ও ব্যবসায়ী নেতা হরতালের ক্ষতিকর দিক নিয়ে কথা বলেন, তাঁদের এখন থেকে থমকে যেতে হবে। তাঁদের বরং দায়িত্ব হবে হরতালে ক্ষতিকর গ্রিনহাউসের নির্গমন কতটুকু কমে যায়, তা হিসাব কষে বের করা এবং এ জন্য বিরোধী দলকে অভিনন্দন জানানো!
একদিক দিয়ে অবশ্য তা প্রধানমন্ত্রীর জন্য ভালো হবে। সরকারের নীতিনির্ধারকেরা আগের আমলে শত শত হরতাল করে তিনি পরিবেশের উন্নয়নে কী ভূমিকা রেখেছেন, তা নিয়ে গবেষণা করতে পারেন এবং দেশবাসীকে তা সবিস্তারে জানাতে পারেন। এ জন্য কোনো আন্তর্জাতিক পুরস্কারের ব্যবস্থা কোথাও আছে কি না, এই খোঁজখবরও নেওয়া যেতে পারে! এসব হোক না হোক, হরতাল যে জাতিগতভাবে উপভোগ করার বিষয়, এমন একটি চিন্তার দ্বার তিনি খুলে দিয়েছেন। তাঁকে অভিনন্দন!
সমস্যা হলো, তিনি শুধু হরতাল নিয়ে মন্তব্য করেননি। তিনি বিরোধী দলের নেত্রীসহ অন্য নেতাদের নিয়ে বিদ্রূপাত্মক মন্তব্য করেছেন। তিনি তাঁদের চোর-বাটপার হিসেবে চিহ্নিত করে বলেছেন: চোর-বাটপারদের সঙ্গে আলোচনা করে কী হবে! তাঁর এই বক্তব্যের মাহাত্ম্য বহু মানুষ বুঝতে পারেননি। প্রথম আলোর ওয়েব সংস্করণে পাঠকদের অধিকাংশ তাই তাঁদের বিরক্তি, নিন্দা ও হতাশা প্রকাশ করেছেন এই মন্তব্যে।
এই পাঠকেরা কেন এমন কুপিত হলেন প্রধানমন্ত্রীর কথা শুনে, এটি ভেবে আমারও মনে নানা প্রশ্ন ও উদ্বেগের জন্ম হলো। গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধকারী নীতিমালা প্রণয়নের যে উদ্যোগ সরকার নিয়েছে, তা বাস্তবায়িত হওয়ার আগে এসব প্রশ্ন ও ভাবনা প্রকাশ করা সম্ভবত অনুচিত হবে না।

২.
চোর ও বাটপার পেনাল কোডে সংজ্ঞায়িত অপরাধ। এদের সর্বোচ্চ শাস্তি ১০-১২ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড। কোনো চোর এই শাস্তি ভোগ করে এলে সমাজে সে আরও একঘরে হয়ে পড়ে। সাধারণ চোরদের পরিণতি তাই খুব খারাপ হয়। তবে রাজনৈতিক চোর বা রাঘববোয়াল চোরদের এ অবস্থা না-ও হতে পারে। পাকিস্তানে আসিফ আলী জারদারি মিস্টার টেন পার্সেন্ট আর ভারতে জয়ললিতা মিস টোয়েন্টি পার্সেন্ট নামে পরিচিত ছিলেন। তবে সেখানে জনগণ এ নিয়ে সম্ভবত তেমন উদ্বিগ্ন হয়নি। আসিফ আলী জারদারি তাই পাকিস্তানেরপ্রেসিডেন্ট হয়েছেন, জয়ললিতা আবারও তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন। কাঠমান্ডু এয়ারপোর্টে সম্প্রতি মাদ্রাজের এক দম্পতিকে জিজ্ঞেস করলাম, এটি কীভাবে সম্ভব? তাঁরা বললেন, জয়ললিতার আগের সরকার ছিল আরও বড় চোর। তার মানে, তাই তারা অপেক্ষাকৃত ছোট চোরকে আবার ক্ষমতায় বসিয়েছে।
সত্যি হোক, মিথ্যে হোক, তৃতীয় বিশ্বে রাজনীতিবিদেরা কমবেশি দুর্নীতি করেন—এমন বিশ্বাস বহু মানুষের মনে আছে। উন্নত বিশ্বেও (যেমন—জাপান, আমেরিকা, ইতালি) কিছু শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তি দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত হয়েছেন, পদও হারিয়েছেন। দুর্নীতির প্রায় সর্বজনীন সূত্র হচ্ছে, অসীম ক্ষমতাধর ব্যক্তির জবাবদিহি না থাকলে দুর্নীতি হবে। বাংলাদেশে মন্ত্রীরা এ ধরনের অসীম ক্ষমতা ভোগ করেন বলে দুর্নীতি হওয়া অস্বাভাবিক নয়। বাংলাদেশে দুর্নীতির অভিযোগ বেগম খালেদা জিয়া ও অন্যান্য বিরোধী দলের নেতাদের বিরুদ্ধে গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ছিল। এ নিয়ে আদালতে মামলাও হয়েছে। কাজেই তাঁদের চোর-বাটপার হয়তো বলা যেতে পারে। কিন্তু সমস্যা হলো, একই ধরনের দুর্নীতির অভিযোগ স্বয়ং বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বা তাঁর দলের অনেক নেতাদের বিরুদ্ধে ছিল। এসব অভিযোগে বিএনপি এবং তত্ত্বাবধায়ক উভয় আমলে তাঁদের বিরুদ্ধে মামলাও হয়েছে। কাজেই শুধু অভিযোগ ও মামলার ভিত্তিতে বিরোধী দলের নেতারা ‘চোর-বাটপার’ হলে সরকারি দলের নেতাদের সম্পর্কে একই কথা প্রযোজ্য। এটি শুনতে নিশ্চয়ই তাঁদের ভালো লাগবে না!
অপরাধ আদালতে প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত কাউকে অপরাধী বলা তাই সবার জন্যই অনুচিত। বর্তমান সরকার আদালতে নিজেদের নির্দোষ প্রমাণের চেষ্টা না করে অত্যন্ত অসংগতভাবে নিজেদের দলের বিরুদ্ধে সব দুর্নীতির মামলা প্রত্যাহার করেছে। অন্যদিকে বিরোধী দলের বিরুদ্ধে সব মামলা জারি রেখেছে এবং নতুন মামলা যুক্ত করেছে। এই বৈষম্য না ঘটিয়ে আইনি প্রক্রিয়ায় নিজেদের বিশুদ্ধতা প্রমাণ করে এবং অন্য পক্ষ শাস্তি পেলে কেবল তখনই তাঁদের চোর-বাটপার বলা যৌক্তিক হবে।
আমার প্রশ্ন, তা না করে মামলায় দোষ প্রমাণের আগে প্রধানমন্ত্রী বিরোধী দলের নেত্রীকে ‘চোর-বাটপার’ বলার অধিকার রাখেন কি? বিচারাধীন মামলার বিষয়ে তিনি কীভাবেই বা সরাসরি মন্তব্য করেন? বাংলাদেশে আগের আমলগুলোর মতো তাঁর আমলেও বিচার বিভাগ পরিপূর্ণ স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে বিচারকাজ পরিচালনা করতে পারে কি না, এ নিয়ে জনগণের মধ্যে সন্দেহ রয়েছে। বিচারকাজ এ দেশে ঠিকমতো হয় কি না, এ নিয়ে বহু বরেণ্য আইন বিশেষজ্ঞ এবং তাঁরই সরকারের নিযুক্ত মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান সংশয় প্রকাশ করেছেন। এই পরিস্থিতিতে জিয়া অরফানেজ-সংক্রান্ত খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে বিচারাধীন মামলায় স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী যদি খালেদা জিয়া টাকা মেরে খেয়েছেন—এমন উক্তি করেন, তাহলে বিচারকাজ সুষ্ঠুভাবে হবে, এই বিশ্বাস মানুষের কীভাবে থাকবে?

৩.
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বরং মনে যে ধারণাই থাকুক, ‘চোর-বাটপারদের’ সঙ্গেই তাঁর আলোচনায় বসা উচিত। একজন আদালতে প্রমাণিত চোরের সঙ্গে তিনি বহুবার বসেছেন, তাঁর দলের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচনও করেছেন। যাঁদের বিরুদ্ধে চুরি বা দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি এবং প্রতিহিংসামূলকভাবে যাঁদের বিরুদ্ধে মামলা পরিচালনা করা হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে, তাঁরা অবশ্যই প্রমাণিত দুর্নীতিবাজদের চেয়ে অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য। তাঁদের সঙ্গে দেশের স্বার্থে আলোচনায় না বসার কোনো যুক্তি নেই।
তা ছাড়া খালেদা জিয়া তিনবারের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী, এবারসহ দুবারের মতো সংসদে বিরোধী দলের নেত্রী। বিপর্যয়কর সর্বশেষ নির্বাচনেও তাঁর দল প্রায় এক-তৃতীয়াংশ ভোট পেয়েছে। বর্তমান সরকারের আমলে চট্টগ্রামের মেয়র নির্বাচনসহ বহু স্থানীয় সরকার নির্বাচনে তাঁর দলের ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তার প্রমাণ পাওয়া গেছে। ঢাকার সর্বশেষ জনসভায় মানুষের ঢল আর নতুন নতুন দলের সংহতিও একই ইঙ্গিত প্রদান করে। তাঁর সঙ্গে আলোচনায় না বসার মানে হচ্ছে দেশের কয়েক কোটি মানুষের নেত্রীকে উপেক্ষা করা; সুষ্ঠু বিচারে দোষ প্রমাণের আগে তাঁকে চোর-বাটপার বলার মানে সেসব মানুষের অনুভূতিতে আঘাত করা এবং দেশকে আরও হতাশার দিকে ঠেলে দেওয়া।

৪.
দুই নেত্রী বা দুই দলের মধ্যে আলোচনা এখন আরও জরুরি হয়ে পড়েছে আগামী নির্বাচন কমিশনার গঠন নিয়ে। কয়েক মাসের মধ্যে নতুন নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগ দিতে হবে সরকারকে। আদালতের রায়ের একতরফা ও ভ্রান্তিমূলক ব্যাখ্যার ভিত্তিতে তত্ত্বাবধায়ক-ব্যবস্থা বাতিল করে সরকার ইতিমধ্যে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে তার সদিচ্ছা সম্পর্কে বিভিন্ন মহলে সংশয় সৃষ্টি করেছে। সরকার বলতে চাইছে, শক্তিশালী ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনই সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে সক্ষম। সরকারকে এখন অন্তত এ ধরনের নির্বাচন কমিশন গঠনে তার আন্তরিকতার দৃশ্যমান প্রমাণ দিতে হবে। এ জন্য: ক) বিরোধী দল ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে নিয়ে নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের সার্চ কমিটি গঠনের আইন প্রণয়ন করতে হবে; খ) এ ধরনের একটি গ্রহণযোগ্য কমিটির প্রস্তাবমতো নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগ দিতে হবে; গ) নির্বাচনকালে সকল পর্যায়ের নির্বাচন-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা, সামরিক বাহিনী ও শৃঙ্খলা বাহিনী নিয়োগে নির্বাচন কমিশনের সুস্পষ্ট ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত করতে হবে; ঘ) নিজস্ব সচিবালয়সহ কমিশনের লোকবল এবং প্রয়োজনীয় আর্থিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে; ঙ) দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষকদের স্বাধীনভাবে কাজ করার আইনি কাঠামো প্রতিষ্ঠিত করতে হবে এবং ঙ) বিতর্কিত ইভিএম পদ্ধতি একতরফাভাবে চালু করার চিন্তা থেকে সরে আসতে হবে।
বিরোধী দলের নেত্রীকে জেলে ভরে, বিএনপিকে ভেঙে টুকরো করার চেষ্টা করে আগামী নির্বাচনে যেকোনো মূল্যে জেতার চিন্তা সরকারের কোনো কোনো মহলের মধ্যে রয়েছে বলে অভিযোগ শোনা যায়। আমরা মনে করি, এসব বিপজ্জনক চিন্তা কারও মধ্যে থাকলে তা পরিহার করা উচিত। দেশের স্বার্থে বরং বিরোধী দলসহ সব মহলের সঙ্গে আলোচনা করে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন ও নির্বাচনী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ সরকারের নেওয়া উচিত। না হলে দুই দলের হানাহানিতে এমন পরিস্থিতি আবারও হতে পারে, যখন দুই নেত্রীকেই বিনা বিচারে ‘চোর-বাটপার’ বা আরও খারাপ কিছু হিসেবে চিহ্নিত করার অপপ্রয়াস ঘটতে পারে। আমাদের মূল দুর্ভাবনা সেটিই।
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন