পৃষ্ঠাসমূহ

শুক্রবার, ২৭ জানুয়ারী, ২০১২

কোটা (৫৫) বনাম মেধা (৪৫)

কিছুদিন আগে ২৮তম বিসিএস পরীক্ষার চূড়ান্ত ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে। এরপর মুখ চুন করে বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন ছাত্রছাত্রী আমার বাসায় এসেছেন। তাঁদের আপত্তি বা হতাশা সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা নিয়ে। সরকারি কর্মকমিশন ২৮তম বিসিএসে সাধারণ ক্যাডারে নিয়োগের জন্য সুপারিশ করেছে ৬৫৭ জনকে। এই ৬৫৭ জনের মধ্যে ৩৪৭ জনই নিয়োগ পেয়েছেন বিভিন্ন কোটায়। বাকি মাত্র ৩১০ জন নিয়োগ পেয়েছেন মেধার ভিত্তিতে। অর্থাৎ সরকারি চাকরিতে শতকরা ৪৫ জনকে নিয়োগ দেয়া হয় মেধার ভিত্তিতে, বাকি ৫৫ জনকে কোটার ভিত্তিতে। তাত্ত্বিকভাবে বললে, ১০০ জন নিয়োগ পেলে মেধার ভিত্তিতে ৪৬তম স্থান লাভকারীকে চাকরি না দিয়ে ১০০০তম স্থান লাভকারী ব্যক্তিকে কোটার ভিত্তিতে সরকারি চাকরি দেয়া যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, ২০০৬ সালে সম্পন্ন হয়া ২৫তম বিসিএস পরীক্ষায় মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ পেয়েছেন প্রথম ২২৮ জন। অপরদিকে বিভিন্ন কোটার কল্যাণে ১৬১১তম হয়ে পররাষ্ট্র, ৫১০৪তম হয়ে প্রশাসন, ৫৩৭৭তম হয়ে কেউ কেউ পুলিশ ক্যাডারের চাকরি পেয়েছেন। পরবর্তী নিয়োগগুলোতেএ রকম বহু ঘটনা ঘটেছে বলে ধারণা করা যায়।
বর্তমানে বাংলাদেশে বেসামরিক সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে শতকরা ৫৫ ভাগ কোটা প্রধানত চার ধরনের সুবিধাভোগীদের জন্য সংরক্ষিত। প্রথমে এই ৫৫ ভাগকে জেলা/বিভাগ অনুযায়ী বণ্টন করা হয়। জেলা/বিভাগয়ারি বণ্টন শেষে সংশ্লিষ্ট জেলার অধীনে মুক্তিযোদ্ধা সন্তান কোটায় ৩০ ভাগ, শুধু জেলা কোটায় ১০ ভাগ (একে ‘সাধারণ মেধা কোটা’ বলা হয়), নারী কোটায় ১০ ভাগ এবং ‘উপজাতি’ কোটায় ৫ ভাগ লোক নিয়োগ করা হয়। কোটার জন্য বিবেচিত ব্যক্তিরা আবার মেধার ৪৫ জনের ক্ষেত্রেবিবেচিত হবেন। উল্লেখ্য, সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তা নিয়োগের ক্ষেত্রে এ রকম কোনো নির্দিষ্ট কোটা পদ্ধতি অনুসরণ করা হয় না।
এ ধরনের বৈষম্যের কারণে সরকারি চাকরির কোটাব্যবস্থা বারবার বিতর্কিত হয়েছে। কোটাবিরোধী আন্দোলনহয়েছে বেশ কয়েকবার। কিন্তু কোটাব্যবস্থা রয়ে গেছে কিংবা ক্ষেত্রবিশেষে তা আরশক্তিশালী হয়েছে। যেমন, সম্প্রতি সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কোটায় প্রয়োজনীয়সংখ্যক প্রার্থী না পায়া গেলে কোটার জন্য নির্ধারিত শূন্য আসনসমূহ শূন্যই থাকবে। মেধাবীদের সেসব পদে আর নিয়োগ দেয়া হবে না।

২.
কোটাব্যবস্থার অসংগতি নিয়ে বিভিন্ন গবেষণায়প্রশ্ন তোলা হয়েছে। যেমন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা ড. আকবর আলি খান এবং সাবেক সচিব কাজী রকিবুদ্দিন আহমাদ ২০০৮ সালের মার্চ মাসে ‘Quota System for Civil Service Recruitment : An Exploratory’ শীর্ষক একটি গবেষণাকর্ম সম্পাদন করেছেন।ই গবেষণায় সংবিধান, বিভিন্ন আইননীতিমালা এবং অন্য দেশের তুলনামূলক অবস্থা পর্যালোচনা করে সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে বিদ্যমান অধিকাংশ কোটাকে সংবিধানন্যায়নীতির পরিপন্থী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এ গবেষণায় নিম্নোক্ত পাঁচটি বিষয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
মেধার ভিত্তিতে মাত্র শতকরা ৪৫ জনকে নিয়োগ সংবিধানসম্মত নয়। সংবিধান বৈষম্যহীনতার কথা বলেছে এবং ক্ষেত্রবিশেষে ব্যতিক্রম হিসেবে (যেমন, সমাজের অনগ্রসর শ্রেণীর জন্য) কোটাকে অনুমোদন করেছে। ব্যতিক্রমী নিয়োগ (শতকরা ৫৫ ভাগ) কখনো সাধারণ নিয়োগের (শতকরা ৪৫ লাভ) চেয়ে বেশি হতে পারে না।
সংবিধানের ২৯(৩) অনুচ্ছেদ নাগরিকদের ‘অনগ্রসর অংশের’ জন্য চাকরিতে বিশেষ কোটা প্রদান অনুমোদন করেছে বলা যায়। কিন্তু সংবিধান ‘অনগ্রসর অঞ্চলের’ জন্য কোনো কোটাকে অনুমোদন করে না। ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের পর্যবেক্ষণ অনুসারে এ ধরনের কোটার সুবিধা ভোগ করে অনগ্রসর অঞ্চলের অপেক্ষাকৃত বিত্তবানসচ্ছল শ্রেণী, যাদের অবস্থা অন্যান্য অঞ্চলের অনেক মানুষের চেয়ে উন্নত। ফলে জেলা কোটার সাংবিধানিক ভিত্তি সন্দেহজনক।
মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কোটার কোনো আইনগত ভিত্তি নেই। এই কোটা কেবল তখনই যৌক্তিক হবে যদি প্রমাণ করা যায় যে মুক্তিযোদ্ধারা নাগরিকদের মধ্যে অনগ্রসর অংশ। মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের জন্য এই কোটার ভিত্তি আইনগতভাবে আরদুর্বল।
সংবিধানের ২৮ এবং ২৯ অনুচ্ছেদ অনুসারে নারীউপজাতিদের জন্য কোটা সংরক্ষণ আইনসম্মতবৈধ।
কোনো কোটাই চিরস্থায়ী হয়া উচিত নয় এবং প্রতিটি কোটার প্রয়োজনীয়তা সময়ে সময়ে পর্যালোচনা করা উচিত।
ড. খানজনাব রকিবের গবেষণার তথ্য অনুসারে ১৯৭৭ সালে তৎকালীন পেসার্ভিস কমিশনের প্রায় সব সদস্য সরকারি নিয়োগে কোটাব্যবস্থার বিরোধিতা করেন। কমিশনের সদস্যদের মধ্যে একমাত্র এম এম জামান কোটার পক্ষে অবস্থান নিলেপ্রচলিত কোটাসমূহ প্রথম ১০ বছর বহাল রেখে ১৯৮৭ থেকে পরবর্তী ১০ বছরে ধীরে ধীরে কমিয়ে দশম বছরে তা বিলুপ্ত করার পক্ষে মত দেন। অথচ ১৯৯৭ সালেই এই কোটাব্যবস্থাকে আরসম্প্রসারিত করা হয় মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের এর আতাভুক্ত করে। মুক্তিযোদ্ধা কোটাকে মুক্তিযোদ্ধা কিংবা শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানের জন্য সংরক্ষণ করা নানা বিবেচনায় একটি প্রশ্নবিদ্ধ সিদ্ধান্ত ছিল।
প্রথমত, মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের জন্য কোটা সংরক্ষণ করায় এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে বাদবাকিদেরপর। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০০৫ সালের খানা আয়ব্যয় জরিপ অনুযায়ী দুই লাখ ১০ হাজার ৫৮১ জন মুক্তিযোদ্ধার পরিবারের মোট সদস্যসংখ্যা হচ্ছে প্রায় ১০ লাখ ২১ হাজার ৩১৮ জন (গড় খানার আকার ৪ দশমিক ৮৫ ধরে)। সে হিসাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানসন্ততির সংখ্যা দেশের জনসংখ্যার ৭ শতাংশর কম। এদের জন্য মোট শূন্যপদের ৩০ ভাগ সংরক্ষণ সমানুপাতিক নয়, যৌক্তিকনয়। তা ছাড়া এই কোটা সংরক্ষণের কারণে একদিকে যেমন মেধাতালিকায় শীর্ষস্থানীয় একজন চাকরি থেকে বঞ্চিত হন, অন্যদিকে মেধাতালিকায় অধিকাংশের নিচে থেকেকারকারগুরুত্বপূর্ণ পদে চাকরি হয়ে যায়। ফলে সার্বিকভাবে দেশ মেধাবী আমলাদের সেবা থেকে বঞ্চিত হয়।
দ্বিতীয়ত, ১৯৭২ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়োগের জন্য কোটা সংরক্ষণ করে তাঁরা যেন চাকরিতে প্রবেশের সুযোগ পান, সে কারণে তাঁদের বয়সের ঊর্ধ্বসীমা শিথিল করে ৩২ করা হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তাঁদের অবদানবিড়ম্বনার কথা বিবেচনা করে এটি একটি সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল। কিন্তু বয়সের ঊর্ধ্বসীমার শিথিলতা স্বাধীনতার এক কিংবা দেড় দশক পর জন্ম নেয়া তাঁদের সন্তানের বেলায় প্রয়োগের কোনো যুক্তি নেই।
তৃতীয়ত, মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের মধ্য থেকে উপযুক্ত প্রার্থী না পায়া গেলে তাঁদের জন্য নির্ধারিত পদসমূহ শূন্য রাখায় প্রশাসনিক সচলতাব্যাহত হচ্ছে। ২৮তম বিসিএসে পেশাগতকারিগরি ক্যাডারে বিভিন্ন কোটায় ৮১৩টি পদের জন্য কোনো যোগ্য প্রার্থীই পায়া যায়নি। ফলাফল প্রকাশের এক মাসেরকম সময় আগে পরিবর্তন করা আইনের কারণে পিএসসি কর্তৃপক্ষ বাধ্য হয়েছে এই পদগুলো শূন্য রেখে দিতে। অথচ কোটাহীন শত শত মেধাবী চিকিৎসক, প্রকৌশলী উত্তীর্ণ হয়েচাকরি পাননি।
ড. আকবর আলি খানের রিপোর্টে ১৯৮২ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত পাবলিক সার্ভিস কমিশনের বার্ষিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখানো হয়েছে যে এ সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সংরক্ষিত ৩০ ভাগ কোটার খুব সামান্যই পূরণ হচ্ছিল। যেমন ২১, ২২২৫তম বিসিএস পরীক্ষার ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখানো হয়েছে যে এই বিসিএসগুলোতে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য সংরক্ষিত কোটার যথাক্রমে মাত্র ১০ দশমিক ৮, ২ দশমিক ২৫ দশমিক ২ ভাগ পূর্ণ হয়েছে। আর এই বিশাল সংখ্যায় পদ অপূর্ণ থেকে যায়ার মূল কারণ হলো কারিগরিপেশাগত ক্যাডারে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান কিংবা অন্যান্য কোটায় উপযুক্ত প্রার্থীর স্বল্পতা। এ অবস্থায় যদি মেধাতালিকা থেকে এই শূন্য আসনগুলো পূর্ণ করা হয়, তাতে অন্যায় কী হয়?

৩.
কোটাব্যবস্থার সমর্থকেরা পৃথিবীর অন্যান্য দেশেকোটা আছে বলে যুক্তি দেখান। কিন্তু আমার জানামতে, সরকারি চাকরিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ পদ কোটার ভিত্তিতে সংরক্ষণ করার নজির পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে নেই। ভারতের উদাহরণ দিই। জনসংখ্যা অনুপাতে ভারতে সরকারি চাকরির যথাক্রমে ১৫৭ দশমিক ৫ ভাগ পদ দলিত শ্রেণীআদিবাসীদের জন্য সংরক্ষিত। ভারতের সুপ্রিম কোর্টের রায় অনুযায়ী সরকারি নিয়োগে কোটার সমষ্টি কোনোক্রমেই মোট শূন্যপদের ৫০ ভাগের বেশি হতে পারবে না। ভারতের এই কোটাব্যবস্থা কোনো চিরস্থায়ী পদ্ধতিনয়। ১৬ নভেম্বর ১৯৯২ সালে ভারতের সুপ্রিম কোর্টের রায় অনুসারে যে জাতীয় অনগ্রসর জনগোষ্ঠী কমিশন (National Commission for Backward Classes) গঠন করা হয়, তার অন্যতম দায়িত্বই হচ্ছে কোটাব্যবস্থায় নানা অসংগতি পর্যালোচনা করে এটির ক্রমাগত সংস্কার করা। কমিশন ইতিমধ্যে সাংবিধানিক পদাধিকারী, আমলা, ব্যবসায়ী, চিকিৎসক, আইনজীবীসহ সচ্ছল শ্রেণীর সন্তানদের ‘অন্যান্য অনগ্রসর জনগোষ্ঠী’ হিসেবে বিবেচনার অযোগ্য ঘোষণা করেছে।
বাংলাদেশেন্যায়পরায়ণতাবাস্তবতার ভিত্তিতে কোটাব্যবস্থার সংস্কার জরুরি। বিদ্যমান কোটাব্যবস্থায় শুধু যে বেসামরিক প্রশাসনের মান খর্ব হচ্ছে তাই নয়, মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট জোগাড়ের ক্ষেত্রে দিন দিন দুর্নীতিঅনিয়মবৃদ্ধি পাচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এটি পরিবর্তন করে যুদ্ধাহতআর্থসামাজিক বিচারে অনগ্রসর মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিকভাবে চিহ্নিত করে শুধু তাঁদের সন্তানদের জন্য সমানুপাতিক কোটা রাখলে তা যৌক্তিকগ্রহণযোগ্য হবে। এ ছাড়া তাঁদের জন্য উচ্চশিক্ষাপ্রশিক্ষণের পর্যাপ্ত সুবিধাসরকার প্রদান করতে পারে। জেলা কোটার অবসান ঘটিয়ে প্রতিবন্ধীদের জন্য কোটা সংরক্ষণের চিন্তাসরকার করতে পারে।
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
 তারিখ: ২৫-০৬-২০১০

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন