পৃষ্ঠাসমূহ

শুক্রবার, ২৭ জানুয়ারী, ২০১২

সংবিধান সংশোধন কিছু প্রশ্ন ও আমাদের অভিমত- আমরা জানতে চাই

গত ২৯ আগস্ট প্রথম আলো কারওয়ান বাজার কার্যালয়ের সভাকক্ষে ‘আমরা জানতে চাই: সংবিধান সংশোধন, কিছু প্রশ্ন ও আমাদের অভিমত’ শীর্ষক আলোচনা সভার আয়োজন করে তরুণদের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন জাগরী। আলোচনা সভায় অংশগ্রহণকারী জাগরীর সদস্য বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ শিক্ষক, পেশাজীবী ও শিক্ষার্থীর প্রশ্নের উত্তর দেন আইনজ্ঞরা। এতে অংশ নেন সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. কামাল হোসেন, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ড. শাহ্দীন মালিক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল, প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক মিজানুর রহমান খান। সভার সঞ্চালক হিসেবে ছিলেন প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক আব্দুলকাইয়ুম এবং সমন্বয়কারী ছিলেন জাগরীর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য বিধান চন্দ্র পাল। সভার প্রশ্নোত্তর পর্ব ও আলোচনা সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো।

আবদুল কাইয়ুম
সংবিধান সংশোধন নিয়ে তরুণদের মধ্যে অনেক প্রশ্ন ও দ্বিধার উদ্বেগ রয়েছে। তরুণদের এসব প্রশ্ন ও নিজস্ব মতামত তুলে ধরাও হবে সবার সামনে। তারই অংশ হিসেবে তরুণদের সংগঠন জাগরীর উদ্যোগে এই আলোচনা সভার আয়োজন। সুপ্রিম কোর্টের রায়ে পঞ্চম ও সপ্তম সংশোধনী বাতিল হওয়ার ফলে আমাদের ৭২-এর মূল যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মূল্যবোধকে ধারণ করে সংবিধান প্রণীত হয়েছিল তার কাছে ফিরে যেতে পারছি। ইতিমধ্যে সংবিধান সংশোধনীতে সংসদীয় বিশেষ কমিটি গঠন করা হয়েছে। সংবিধান সংশোধন বিষয়ে তরুণ সমাজের মধ্যে বিভিন্ন প্রশ্ন ও মতামত রয়েছে। পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে যে প্রেরণাকে মূলধন করে সংবিধান প্রণীত হয়েছিল, সেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সংবিধানের মধ্যে ফিরিয়ে আনা হচ্ছে। একই সঙ্গে সামরিক শাসন ও আইন জারি করে গণতন্ত্রকে যেভাবে অবরুদ্ধ করা হয় তাকে বেআইনি ঘোষণা করার মাধ্যমে ভবিষ্যতে গণতন্ত্রকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রসারিত হয়েছে। আজকের আলোচনা এ বিষয়গুলো নিয়েই।

উত্থাপিত প্রশ্ন
‘সংবিধান সংশোধন কেন জরুরি।’ ’৭৫-পরবর্তী দীর্ঘ সময় আমরা অতিক্রম করেছি, এ সময়ের মধ্যে সংবিধানে অনেক পরিবর্তন করা হয়েছে। এখন সংবিধান সংশোধন করে আমরা ’৭২-এর সংবিধানে ফিরে যাওয়ার কথা বলছি। উল্টো পথে হাঁটা, অর্থাৎ আবার কেন আমাদের পেছনে ফিরে যাওয়া প্রয়োজন। বাংলাদেশের যারা প্রান্তিক মানুষ, যারা আসলে সংবিধানের সংশোধন সম্পর্কে অজ্ঞ, তাদের কাছে সংশোধনীর প্রয়োজনীয়তা কী?

ড. কামাল হোসেন
’৭২-এর সংবিধানে ফিরে যাওয়া মানে এই নয় যে অতীতে ফিরে যাওয়া। সংবিধান করা হয়েছিল স্বাধীন রাষ্ট্রের ওপর আনুগত্য রেখে। পরবর্তী সময়েও এটাকে রক্ষা করার জন্য আনুগত্য প্রয়োজন ছিল। সংবিধান কী কী আদর্শ, আকাঙ্ক্ষা ও চিন্তা নিয়ে তৈরি করেছি তা জনসাধারণকে বোঝাতে হবে। পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন পটভূমিতে সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে আঘাত করা হয়েছে। সব সময় সংশোধনীর সময় বলা হয়, জনস্বার্থে ও জাতীয় কল্যাণে করা হয়েছে। সংশোধনীর বৈধতা প্রদানের জন্য প্রস্তাবনায় বলা হয়, আজকে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে জন ও রাষ্ট্রীয় স্বার্থেই সংবিধানের সংশোধনী করা হয়েছে। কিন্তু লক্ষ করলে দেখা যায়, সংশোধনীর পেছনে তৎকালীন পটভূমিতে বিশেষ মহলের স্বার্থ রয়েছে। সংবিধান একটি কাঠামোগত বিষয় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে কীভাবে প্রয়োগ করা হবে। কী কী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে করা হবে। কী কী প্রক্রিয়া করা হবে এ সবকিছুই সংবিধান কাঠামোর মাধ্যমে লক্ষ্য স্থির করে এগিয়ে যাওয়া। নির্বাচন প্রক্রিয়ার সংশোধনী প্রয়োজন। নির্বাচনের মাধ্যমে কারা জনগণের প্রতিনিধিত্ব করছেন সে বিষয়ে বর্তমানে প্রশ্ন উঠছে। বর্তমান সময়ে রাজনীতিতে জনগণের প্রতিনিধিত্বকারী ব্যক্তি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এর মূল কারণ আমাদের গণতান্ত্রিক চর্চাবোধের অভাব। সংসদ ভবন হচ্ছে জনগণের ভবন। অর্থাৎ ওখানে জনগণের অধিকার, মতামত ও স্বার্থ নিয়ে আলোচনা করা হবে। কিন্তু তৃণমূল পর্যায়ের লোকজন জানেন না যে সংসদে তাঁদের নিয়ে আলোচনা করার কথা। সংসদকে কার্যকর করতে প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্র, জবাবদিহিতা ও দায়িত্ববোধ নিয়ে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত করতে হবে। আমাদের সংবিধানের সংশোধনীর চেয়ে আমাদের নিজস্ব মানসিকতার, মূল্যবোধের সংশোধনী প্রথমে প্রয়োজন। জনগণ সব ক্ষমতার মালিক—এই মূল্যবোধ সব রাজনীতিবিদের মধ্যে ধারণ করা দরকার। সংবিধান কোনো সাধারণ আইন নয় যে প্রতিবছর পরিবর্তন করতে হবে। আমেরিকার সংবিধান প্রায় ২০০ বছরের পুরোনো কিন্তু খুব কমই সংবিধান সংশোধনী করা হয়েছে, কিন্তু সেখানে সমাজে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। সংবিধানের সংশোধনী যদি খুব বেশিই জরুরি হয়ে দাঁড়ায় তবে তা আগে ব্যাপক আলোচনা, পর্যালোচনা, জনগণের মতামতের ভিত্তিতে সংশোধন করা উচিত।

ড. আসিফ নজরুল
’৭২-এর সংবিধানে ফিরে যাওয়া মানে আমার মত হচ্ছে, ’৭২-এর সংবিধানে মূলত যে চারটি মূলনীতি ছিল সেখানে ফিরে যাওয়াকে বুঝাচ্ছি। এর মানে এই নয় যে ’৭২-পরবর্তী বিশ্বে ও দেশের সামাজিক পরিবর্তিত পরিস্থিতে যে সংশোধনী প্রয়োজন ছিল সেগুলোকে অস্বীকার করছি। আমরা ’৭২-এর মূল চেতনার জায়গায় থেকে এমন একটি সংবিধান প্রণয়ন করতে চাই যা ভবিষ্যতে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। ’৭২-এর সংবিধান যে সময় রচিত হয়েছিল, তখনকার প্রেক্ষাপটে এটি একটি অসাধারণ সংবিধান। তখনও পর্যন্ত পরিবেশ সম্মেলন হয়নি। তাই পরিবেশের বিষয়ের কথা সেখানে ছিল না। আবার আইন সহায়তার কথা ভারতীয় সংবিধানে ছিল কিন্তু আমাদের সংবিধানে ছিল না। কারণ এ ধারণাগুলো তখন এত জোরদার হয়নি। শিশুশ্রম বন্ধকরণ, ক্ষুদ্র জাতিসত্তার ভাষা ও সংস্কৃতির অধিকারের কথা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ ছিল না তখন। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এ বিষয়গুলো অনেক পরে এসেছে। ’৭২-এর সংবিধানের মূল চেতনা ঠিক রেখে সংবিধানকে আধুনিকায়ন ও পরবর্তী সময়ে জনকল্যাণমূলক ও জনস্বার্থে যেসব বিষয় সংযুক্ত হয়েছে সেগুলোকে অস্বীকার করা হচ্ছে না।

ড. শাহ্দীন মালিক
’৭০-এ যে গণপরিষদ নির্বাচন হয়েছিল। যেখানে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছিল সেটি কিন্তু সংসদ নির্বাচন ছিল না। তখন পাকিস্তানের কোনো সংবিধান ছিল না। গণপরিষদ নির্বাচন হয়েছিল গণপরিষদ গঠনের জন্য। যাদের দায়িত্ব ছিল পাকিস্তানের জন্য একটি সংবিধান রচনা করা এবং পরবর্তী সময়ে সেই সংবিধান অনুযায়ী সংসদ নির্বাচন করে সরকার গঠন করা। স্বাধীনতা ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছিল ১৯৭০-এর ডিসেম্বর থেকে ’৭১-এর জানুয়ারি পর্যন্ত গণপরিষদের নির্বাচন হয়ে দেশের জনগণ তাদের একটি সংবিধান রচনা করার দায়িত্ব দিয়েছিল। সেই দায়িত্ব পালনের জন্য ১ মার্চ ১৯৭১ গণপরিষদে অধিবেশন আহ্বান করা হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানি সামরিক জান্তার গণহত্যা ও নির্যাতনের কারণে যাদের জনগণ সংবিধান রচনার জন্য দায়িত্ব দিয়েছিল আমরা সে দায়িত্ব পালন করতে পারছিলাম না। সেই দায়িত্ব পালন করার জন্য বাংলাদেশকে স্বাধীন দেশ হিসেবে ঘোষণা করলাম। এটিই ছিল আমাদের মুজিবনগর গঠিত বাংলাদেশে প্রথম সরকারের ঘোষণাপত্রের অঙ্গীকার। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সংবিধান রচনার জন্য অধিবেশন ডাকা হয়। ১৯৭২ সালের নভেম্বরে সংবিধানের চূড়ান্ত খসড়া গ্রহণ করে, যাঁরা ১৯৭০-এর গণপরিষদের নির্বাচনে নির্বাচিত হয়েছিলেন, ১৬ নভেম্বর সে সংবিধানে তাঁরা স্বাক্ষর করেন। সেই স্বাক্ষরের মাধ্যমে গণপরিষদের সবাই একসঙ্গে পদত্যাগ করলেন। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭২ সালে সংবিধান গৃহীত হওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে সংসদ নির্বাচন হয় ১৯৭৩ সালের মার্চে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবোধ থেকে রচিত সেই সংবিধানে ফিরে যাওয়া মানে পিছিয়ে যাওয়া নয়। সেই সংবিধান বাঙালি জাতির মূল। অর্থাৎ আমরা যে চেতনা ও মূল্যবোধ নিয়ে ’৭২-এর সংবিধান রচনা করেছিলাম তার মূলে ফিরে যেতে পারছি।

উত্থাপিত প্রশ্ন
বর্তমান পঞ্চম ও সপ্তম সংশোধনী বাতিল হওয়ার মাধ্যমে আমরা ’৭২-এর সংবিধানে ফিরে যাচ্ছি। সেখানে পার্বত্য অঞ্চলের আদিবাসী ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর কথা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ নেই। যদিও সংবিধানে বলা হয়েছে, জন্মস্থান ভেদে নারী-পুরুষ সবারই মৌলিক অধিকার ভোগ করার অধিকার থাকবে কিন্তু স্পষ্টভাবে আদিবাসীদের কথা উল্লেখ করা হয়নি ’৭২-এর সংবিধানে। বর্তমানে আদিবাসীদের অধিকারের কথা স্পষ্টভাবে সংবিধানে যুক্ত করা হবে কি না।

ড. কামাল হোসেন
আমরা যারা নিজেদের বাঙালি হিসেবে পরিচয় দিতে গর্ববোধ করি, মুক্তিযুদ্ধের আগে যখন কাউকে পাকিস্তানিরা গ্রেপ্তার করত তাদের প্রশ্ন করা হতো আমরা বাঙালি না মুসলমান। যারা বাঙালি পরিচয় দিত তাদের গুলি করে হত্যা করা হতো। আদিবাসী হিসেবে তাদের পরিচয়ের জন্য বর্তমানে দাবি উঠেছে। আমি তখন সংবিধানে বাঙালি জাতীয়তাবাদের কথা বলেছি। আমি কখনো ভাবিনি এ কারণে আদিবাসীদের একদিন সমস্যায় পড়তে হবে। আমরা বাংলাদেশকে এমন একটি রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছি যেখানে ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীদের সঙ্গে নিয়ে অসাম্প্রদায়িক বাঙালি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত করা হবে। তখন আমরা পার্বত্য চট্টগ্রাম আদিবাসীদের জন্য আলাদা পরিকল্পনা তৈরি করেছিলাম, যাতে তারা পিছিয়ে না থাকে। আমি আন্তর্জাতিক বিশ্বের কাছে মাথা উঁচু করে বলতাম, আমরা এমন একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করব যেখানে ক্ষুদ্র জাতি-গোষ্ঠী যারা সুবিধাবঞ্চিত আছে তাদের দ্রুত অগ্রগামী করে সমঅধিকার নিশ্চিত করার মাধ্যমে অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হবে। ’৭৫-পরবর্তী সময়ে এই পরিকল্পনাগুলো আর বাস্তবায়ন করা হয়নি। বর্তমান সময়ে আদিবাসীদের সংস্কৃতি ও ভাষার অধিকারের কথা সংবিধানে সংযোজন করা উচিত।

ড. আসিফ নজরুল
’৭২-এর সংবিধান অনুচ্ছেদ ১৪তে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হবে কৃষক, শ্রমিক ও মেহনতি মানুষের মুক্তি। আবার অনুচ্ছেদ ১৫তে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হচ্ছে রাষ্ট্রের জনগণের পাঁচটি মৌলিক চাহিদা পূরণ করা এবং সামাজিক নিরাপত্তা, বিশ্রাম ও বিনোদনের কথা উল্লেখ রয়েছে। ’৭২-এর সংবিধানে পিছিয়ে পড়া সবার মৌলিক অধিকার নিশ্চিতের কথা স্পষ্টভাবে ব্যক্ত করা হয়েছে। পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে আমাদের সংবিধানে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ভাষা ও সংস্কৃতির কথা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করে সংযোজন করা উচিত। দক্ষিণ আফ্রিকার সংবিধান কিংবা পাকিস্তানের মতো দেশের সংবিধানে বলা আছে, জনগণের অর্থনীতিক ও সামাজিক অধিকারগুলো এবং অনগ্রসর শ্রেণীর অধিকার আদায়ের জন্য রাষ্ট্র কী ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছে, এ ধরনের প্রতিবেদন সংসদের কাছে নির্বাহী বিভাগকে জানাতে। এ ধরনের বিধান সংবিধানে ১৪ অথবা ১৫ অনুচ্ছেদের সঙ্গে সংযোজন করা যেতে পারে।

উত্থাপিত প্রশ্ন
’৭২ সালে যে চারটি মূলনীতির ওপর ভিত্তি করে সংবিধান রচিত হয়েছিল তার শেষ কাঠামো ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা। পঞ্চম সংশোধনী বাতিল হওয়ার মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক সমিতি বা সংঘ বাতিল হয়ে যাচ্ছে। এর আওতায় জামায়াতে ইসলাম এবং সমমনা দলগুলো নিষিদ্ধ হয়ে যাচ্ছে কি?

ড. কামাল হোসেন
আমি বলতে চাই ধর্মের ব্যবহার ও অপব্যবহার কী প্রথমে তার সংজ্ঞায়ন প্রয়োজন। ধর্মকে রাজনীতির সঙ্গে মেশানোর যে প্রক্রিয়া ব্রিটিশ আমল থেকে শুরু হয়েছিল তা বর্তমান আধুনিক বিশ্বায়নের যুগেও রয়ে গেছে। আমি একজন মুসলমান হিসেবে বলতে চাই, ধর্মকে রাজনীতির সঙ্গে মেশানো উচিত নয়। ধর্মকে রাজনৈতিক উদ্দেশে ব্যবহার করলে তার ফল খুব ভালো হয় না। প্রত্যেকের নিজ নিজ ধর্ম পালনের অধিকার রয়েছে। কিন্তু ধর্মের অপব্যবহার করা উচিত নয়। টাকা ব্যবহার করে নিজের ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলে লোক ভেড়ানো খুব ভালো কাজ নয়। ধর্মের নামে দলীয়করণ করা হলে ধর্ম ও রাজনীতি—দুটিই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। জনগণের ক্ষমতায়ন নিশ্চিতকরণের জন্য জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। সংবিধানে ৭০ অনুচ্ছেদ এবং রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য প্রশ্নে বলতে চাই ’৭২-এর প্রেক্ষাপটে এটির প্রয়োজন ছিল। বর্তমান সময়ে এর সংশোধনী করা যেতে পারে।

ড. আসিফ নজরুল
সংবিধানে ৩৮ নম্বর অনুচ্ছেদের শর্তাংশ পুনঃস্থাপিত হলে জামায়াতে ইসলামী বা ইসলামী রাজনৈতিক দলগুলো নিষিদ্ধ হয়ে যাবে এ বিষয়ে আমি একমত নই। কারণ, বলা হয়েছিল সাম্প্রদায়িক বা ধর্মকে অপব্যবহার করার উদ্দেশে সমিতি বা সংঘ করা যাবে না। সংবিধানের ১৫২ অনুচ্ছেদে রাজনৈতিক দলের যে সংজ্ঞায়ন করা হয়েছে তাতে রাজনৈতিক দলকে সংঘ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়নি। রাজনৈতিক দলগুলো অধিসংঘ হিসেবে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন। কাজেই ৩৮ অনুচ্ছেদটি রাজনৈতিক দলের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে কি না সে বিষয়ে সন্দেহ রয়েছে। ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মনির্ভর রাজনীতি নিষিদ্ধকরণ কি না এ প্রশ্নের ক্ষেত্রে বলতে চাই পৃথিবীর যে কটি দেশে ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান দেখেছি কোথাও ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ নয়। ভারতে জমিয়তে ওলামা ইসলাম জামায়ে ইসলামি হিন্দ, আবার শিবসেনা দলও রয়েছে। আবার ইউরোপে অনেক দেশে যারা ক্ষমতাসীন দল আছে তাদের দলের নামের আগে ক্রিস্টিয়ানো উল্লেখ রয়েছে। আমি মনে করি, আমাদের সংবিধানে ১২ অনুচ্ছেদে রাজনৈতিক উদ্দেশে ধর্মের ব্যবহারকে নিষিদ্ধ করেনি, রাজনৈতিক উদ্দেশে ধর্মের অপব্যবহারকে নিষিদ্ধ করেছে। মুজিবনগর সরকার চারটি ধর্মনির্ভর রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল শুধু মুক্তিযুদ্ধের সময় বিপক্ষে ভূমিকা রাখার জন্য, ধর্মনির্ভরতার জন্য নয়। তার মধ্যে জামায়াতে ইসলামীও ছিল। বাংলাদেশে ধর্মনির্ভর জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস বন্ধের জন্য ঢালাওভাবে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ না করে ধর্মের অপব্যবহারকারী ও কর্মতৎপর রাজনৈতিক দলগুলো চিহ্নিত করে নিষিদ্ধ করা উচিত। ধর্মের নামে অপব্যবহার সবচেয়ে বেশি করেছে জামায়াতে ইসলামী। এই অপব্যবহার বিএনপি ও আওয়ামী লীগও করেছে। জামায়াতে ইসলামী রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করা উচিত তাদের ’৭১-এ আমাদের মুুক্তিযুদ্ধে তাদের বিপক্ষ ভূমিকা পালনের জন্য।

উত্থাপিত প্রশ্ন
সংশোধনীর ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের রায়ে সংবিধান সংশোধন হয়, না কি সংসদীয় সংশোধনী কমিটির সুপারিশে সংশোধন হবে। সংসদীয় সংশোধনী কমিটি গঠন প্রক্রিয়ায় শুধু ক্ষমতাসীন দলের প্রতিনিধিত্ব পরিলক্ষিত হচ্ছে। অন্য সব রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিত্ব দেখা যাচ্ছে না। সবার অংশগ্রহণে সংবিধান সংশোধন না হলে ভবিষ্যতে বিভিন্ন দলের শাসনের সময় রাজনৈতিক কারণে সংবিধান সংশোধনের রীতি তৈরি হতে পারে। এ থেকে মুক্তির উপায় কী?

ড. কামাল হোসেন
আমাদের সংবিধানে স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে, আপিল বিভাগ যে রায় দেন, তা মানতে সবাই বাধ্য থাকেন। আর অন্যদিকে সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা বলতে দুই-তৃতীয়াংশ সংসদীয় নেতা সংবিধান সংশোধন করতে পারেন।
আমাদের সর্বোচ্চ আদালত যে রায় দেবেন, তা পালন করতে সবাই বাধ্য থাকবে।
সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজনৈতিক দল এমনকি দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের কাছেও কখনো সংবিধান সংশোধনের দায়িত্ব দেওয়া উচিত হবে না। কারণ সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে সব দলের প্রতিনিধিত্ব থাকা উচিত। জনগণের অংশগ্রহণ না থাকলে সুফল পাওয়া যাবে না। এ ক্ষেত্রে গঠিত কমিটিকে উদ্যোগ নিতে হবে। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সংবিধানের ব্যাখ্যার পরিবর্তন হওয়া প্রয়োজন। আর সেই দায়িত্বটি সঠিকভাবে পালন করতে পারেন সর্বোচ্চ আদালত। বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্ট সব সময় জনগণের কাছে নিজের গ্রহণযোগ্যতা ও আস্থা বজায় রাখার চেষ্টা করছেন।

মিজানুর রহমান খান
আমাদের সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদ বলছে, সংবিধান হচ্ছে প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন। এর সঙ্গে যা অসামঞ্জস্যপূর্ণ হবে, ততখানি বাতিল বলে গণ্য হবে। এমনকি সংসদীয় আইন দ্বারা যে সংবিধান সংশোধন করা হচ্ছে, তা সংবিধানের সঙ্গে কতটুকু সামঞ্জস্যপূর্ণ কিংবা সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, তা কিন্তু নির্ধারণ করছেন সুপ্রিম কোর্ট।
পঞ্চম কিংবা সপ্তম সংশোধনী বাতিল হলো। কিন্তু টেকনিক্যালি আসলে পঞ্চম ও সপ্তম সংশোধনী সম্পূর্ণ বাতিল হয়নি। পঞ্চম সংশোধনী ঠিক মাঝামাঝি অবস্থানে আছে। পঞ্চম সংশোধনীর যে ফরমানগুলো বাতিল করা হয়েছে, তা কিন্তু সংসদের নিয়মানুযায়ী বৈধ করা হয়েছিল। কিন্তু বাতিল করা হলো সংবিধানের যে মৌলিক কাঠামো রয়েছে, তার সঙ্গে অসামঞ্জস্যের কারণে। সংসদ মৌলিক কাঠামো বদলাতে পারে না।
বাতিল করা অংশটুকু সংবিধানের আওতায় স্বাভাবিক সংসদও করতে পারত না, কিন্তু সামরিক ফরমান ও পরে পঞ্চম সংশোধনী দিয়ে সে সীমার লঙ্ঘন ঘটেছিল। আমাদের অষ্টম সংশোধনী মামলার রায়ও কিন্তু সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর ওপর ভিত্তি করেই। মৌলিক কাঠামোর সঙ্গে অসামঞ্জস্য দেখিয়ে বাতিল করা হয়েছিল সেটি। সেখানে কিন্তু সংসদীয় কোনো আইন দ্বারা সংশোধন করা হয়নি। একমাত্র ব্যতিক্রম হলো এটি। সংবিধানের ১০০ অনুচ্ছেদ সংশোধন হয়েছিল আপিল বিভাগের রায়ে। অন্যদিকে পঞ্চম সংশোধনীতে সামরিক ফরমান দিয়েই বাকশাল বিলোপ করা হয়েছিল, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল আনা হয়েছিল। হাইকোর্টকে রিট জুরিসডিকশন ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। পঞ্চম সংশোধনীর এই অংশ টিকে আছে। তাই বলা যায়, পঞ্চম সংশোধনীর অংশবিশেষ বাতিল করা হয়েছে। আবার সপ্তম সংশোধনী বিলে দুটি দফা আছে। একটিতে বিচারকদের বয়সসীমা ৬২ থেকে ৬৫ বছর করা হয়েছিল। সেটির বৈধতা চ্যালেঞ্জ করা হয়নি। সেটি টিকে আছে। সংবিধানে ১৫০ অনুচ্ছেদে ক্রান্তিকালীন ও অস্থায়ী বিধানাবলি আছে। সেখানে ১৯ নম্বর প্যারাগ্রাফ ঢুকিয়ে ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত সামরিক শাসনকে বৈধতা দেওয়া হয়েছিল। এ বিষয়টিকে হাইকোর্ট অবৈধ বলেছেন। সপ্তম সংশোধনীর পূর্ণাঙ্গ লিখিত রায় না আসা পর্যন্ত এখনো বোঝা যাচ্ছে না, আসলে সপ্তম সংশোধনীর কোন অংশ কীভাবে অবৈধ বলে গণ্য হবে।
আরেকটি বিষয়, সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদের শর্তাংশ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এটি ফিরে এসেছে। যখন আমাদের দেশে ৩৮ নম্বর অনুচ্ছেদটি পুরোপুরি কার্যকর ছিল, তখন কিন্তু ধর্মের নাম দিয়ে রাজনৈতিক দল গঠন করা হয়নি। কিন্তু বর্তমানে যেহেতু এই বিধান ফিরে এসেছে, এই মুহূর্তে ধর্মের নাম ব্যবহার করে যেসব রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে, তা কিন্তু বৈধ নয়। সে জন্য সরকারপক্ষ বলেছে, এটি নির্ধারণ করবে নির্বাচন কমিশন। আমরা বর্তমানে সংবিধানের সংশোধন নিয়ে কিছুটা অগোছালো অবস্থায় আছি। সে জন্য আমরা আশা করি, সংসদীয় কমিটিও বিষয়টিতে নজর দেবে। সুপ্রিম কোর্টের রায়ের আলোকে সংবিধানের মৌলিক কাঠামো ফিরিয়ে আনতে হবে। সংসদীয় কমিটিতে সব দলের মতামত যাতে প্রতিফলিত হয়, সে বিষয়ে লক্ষ রাখা উচিত। সংবিধান সংশোধন করতে হলে আর গণভোট লাগবে না। কারণ বিধানটি বাতিল হয়েছে। তবে যেকোনো উদ্যোগ সবাই মিলে নিলে গ্রহণযোগ্যতা বেশি থাকে।
গ্রন্থনা: আল-মামুন

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন