পৃষ্ঠাসমূহ

রবিবার, ২২ এপ্রিল, ২০১২

গুম হয়ে যাচ্ছে গণতন্ত্র?



রোববারের পত্রিকা পড়ার পর আরও চিন্তিত হয়ে আছি। মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান বলেছেন, গুম ও নিখোঁজের কিছু ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সম্পৃক্ততার প্রমাণ পেয়েছে কমিশন। তাঁর এই সাহসী বক্তব্যের জন্য তাঁকে ধন্যবাদ; কিন্তু তিনি যা বলেছেন, তা উদ্বেগজনকও। এই উদ্বেগ আরও বেড়ে যায় যখন আমরা মিজানুর রহমান খানের লেখায় পাই গুমের একটি ঘটনার সঙ্গে র‌্যাবে থাকা একজন সেনাসদস্যের সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ।
বাংলাদেশে বহু বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে র‌্যাব জড়িত ছিল। এ ধরনের ঘটনা বানানো হলেও র‌্যাবের একটি কৈফিয়ত থাকে। লাশ উদ্ধার হয় বলে তার ময়নাতদন্ত, সৎকার এবং ভবিষ্যতে বিচারের একটি সম্ভাবনা থাকে। গুমের ক্ষেত্রে এসব কিছুই থাকে না; থাকে না এমনকি ‘মৃত’ মানুষের জন্য প্রার্থনা করার সুযোগটুকু। এই পৈশাচিক অপরাধকে তাই নিকৃষ্টতম অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয় আইন ও নৈতিকতা—উভয় বিচারে। পৃথিবীর ইতিহাস বলে, যে দেশের সরকার যত বেশি ফ্যাসিস্ট, সেখানে তত বেশি গুমের ঘটনা ঘটে। কম্পুচিয়া, ভিয়েতনাম, কলম্বিয়া, নিকারাগুয়া, জিম্বাবুয়ের মতো দেশে এসব ঘটনা প্রায়ই ঘটত একসময়। ইলিয়াসের নিখোঁজের ঘটনা আবারও এই প্রশ্ন জন্ম দিয়েছে যে আমরা কি সেদিকে যাচ্ছি? নাকি এরই মধ্যে এমন এক রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছি, যেখানে জনগণের নিরাপত্তার বড় শত্রু স্বয়ং রাষ্ট্র!
অতীতের বিশাল বর্ণনা বাকি রাখি। সাম্প্রতিক সময়ের কিছু ঘটনাই চরম অস্বস্তির জন্ম দেয় আমাদের মনে। সাগর-রুনির হত্যাকাণ্ডের পর এর তদন্ত তদারকির দায়িত্ব স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীও নিয়েছেন—এ কথা বলেছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিজে। পুলিশের আইজি হত্যাকাণ্ডের দুই দিন পর বলেছিলেন, তদন্তে প্রণিধানযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী তদারকির দায়িত্ব নেওয়ার পরও সেই পুলিশি তদন্তের ফলাফল উচ্চ আদালতের ভাষায় কেমন করে তাহলে ‘জিরো’ হয়ে যায়! কেন এই তদন্তের দায়িত্ব অবশেষে দিতে হয় র‌্যাবকে, যে প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধেই রয়েছে তদন্ত ‘গুম’ করার বা সাজানোর অভিযোগ! এ দেশের ইতিহাসে বিদেশি কূটনীতিকের খুন হওয়ার কোনো নজির ছিল না। সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের কিছুদিন পর রাজধানীর সবচেয়ে নিরাপদ জায়গায় খুন হন একজন পদস্থ সৌদি কূটনীতিক। কেন প্রায় দুই মাস পরও এমন একটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর খুনের তদন্তে কোনো অগ্রগতি নেই? কেন দেশকাঁপানো এমন দুটো ঘটনায় একজনকে আজও গ্রেপ্তার করতে পারল না পুলিশ? মিডিয়ার এত জিজ্ঞাসা সত্ত্বেও কোথায় গায়েব হয়ে গেল সুরঞ্জিতের ঘুষ কেলেঙ্কারির ঘটনা, যার কারণে উদ্ঘাটিত হয়নি সেই গাড়িচালক আলী আজম?
সবশেষে কেমন করে রাজধানীর সবচেয়ে প্রটেকটেড একটি রাস্তা থেকে উধাও হলেন বিরোধী দলের একজন প্রথম সারির নেতা? এ ঘটনার পর বিএনপি, এমনকি আওয়ামী লীগের নেতাদের সাবধানে চলাফেরার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে খবর প্রকাশিত হয়েছে প্রথম আলোতে। বড় রাজনীতিবিদদের গানম্যান আছে, সঙ্গী-সাথি আছে, খবর নেওয়ার নেটওয়ার্ক আছে। তাঁরা সাবধানে থাকতে হয়তো সমর্থ। কিন্তু আমাদের মতো সাধারণ মানুষের কী হবে? প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, বেডরুমে নিরাপত্তা দিতে পারবেন না। আবার আমরা দেখছি, রাজপথ থেকেও উধাও হয়ে যেতে পারে কোনো মানুষ। আইন-আদালত কোথাও নিষ্পত্তি হচ্ছে না কারও দায়দায়িত্ব! 
এ পরিস্থিতি, বিশেষ করে সরকারের সঙ্গে ভিন্ন মত পোষণকারীদের জন্য অশনিসংকেত। এ পরিস্থিতি মানুষের প্রতিবাদ করার অধিকারের জন্য ভয়ংকর। এ পরিস্থিতি কখনোই গণতন্ত্র নয়, বরং গণতন্ত্রের মোড়কে ভয়াবহ ফ্যাসিবাদের ইঙ্গিতবাহী।

২.
প্রত্যক্ষদর্শীর জবানিতে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় যে বর্ণনা আমরা পেয়েছি, তাতে এটি সন্দেহ করার কারণ রয়েছে, সরকারের কোনো সংস্থার লোকেরা ইলিয়াসকে তুলে নিয়ে গেছে। যে নিখুঁত পরিকল্পনায় তাঁর গাড়িকে পেছন থেকে ধাক্কা দিয়ে তাঁকে নেমে আসতে বাধ্য করা হয়, যেভাবে সেখানে মাইক্রোবাসে তাঁকে তোলা হয় এবং ঘটনাস্থলে সাইরেন বাজানো যানের যে বর্ণনা আমরা পাই, তাতে এ ধারণা যে কারও জন্মাতে পারে।
প্রধানমন্ত্রী অবশ্য বলেছেন, ইলিয়াস লুকিয়ে থাকতে পারেন আন্দোলনের ইস্যু তৈরি করার জন্য। সোহরাব হাসান তাঁর লেখায় ব্যাখ্যা করেছেন কতটা অবাস্তব এটি। আমি মনে করি, যে সরকারের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস, দুর্নীতি, দলীয়করণ আর ভারত-তোষণের অভিযোগের পাহাড় জমছে, তার বিরুদ্ধে আন্দালনের আর কোনো নতুন ইস্যুর প্রয়োজন নেই; বরং খতিয়ে দেখলে মনে হবে ইলিয়াসকে উধাও করার ঘটনার পেছনে সরকারেরই মোটিভ থাকতে পারে। প্রথমত, বিএনপি অভিযোগ করেছে, রেল মন্ত্রণালয়ে নিয়োগ-বাণিজ্যের দুর্নীতি হাতেনাতে ধরা পড়ার পর তা আড়াল করার জন্য ইলিয়াসকে গুম করা হয়েছে। বাস্তবতা হচ্ছে, তোলপাড় করা সুরঞ্জিতকেন্দ্রিক এ দুর্নীতির ঘটনা আসলেই অনেকটা আড়াল পড়ে গেছে ইলিয়াস গুম হওয়ার ঘটনায়। দ্বিতীয়ত, বিএনপির একজন নেতা টিপাইমুখবিরোধী আন্দোলনে সম্প্রতি ইলিয়াসের সোচ্চার ভূমিকাকেও আরেকটি কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তৃতীয়ত, আন্দোলনের মাঠ সচল রাখার ক্ষেত্রে ইলিয়াসের রয়েছে দীর্ঘ অভিজ্ঞতা। ইলিয়াসের মতো একজন সুপরিচিত নেতা গুম হয়ে গেলে মাঠপর্যায়ে, বিশেষ করে সিলেট বিভাগে সরকারবিরোধী আন্দোলন ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, এমনকি এটি বিএনপির কিছু নেতা-কর্মীকে আতঙ্কিত এবং আন্দোলনবিমুখও করে তুলতে পারে। 
আমাদের মনে রাখতে হবে, এর আগে বিএনপির প্রায় দুই ডজন নেতাসহ শতাধিক মানুষ গুমের শিকার হয়েছে। কারও ক্ষেত্রেই তদন্তের কোনো সুরাহা হয়নি। দুই বছরে সরকার আমাদের কিছুই জানাতে পারেনি যে চৌধুরী আলম কোথায়, তাঁকে কে উধাও করেছে, তিনি মারা গেলে তাঁর লাশ কোথায়?
সরকারের সাংবিধানিক দায়িত্ব যেকোনো নাগরিকের জীবনের নিরাপত্তা দেওয়া। কোনো মানুষ উধাও বা খুন হলে দোষীদের গ্রেপ্তার করা এবং বিচারের জন্য সোপর্দ করা। সরকার যদি এটি করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে দুটো অনুসিদ্ধান্তই কেবল নেওয়া সম্ভব। এক. সরকার নিজে তা করেছে বলে বিচার করতে অনিচ্ছুক। দুই. সরকার অপরাধী শনাক্ত করতে বা অপরাধটির বিচার করতে অক্ষম বা অসমর্থ। যদি এর একটিও সত্যি হয়, তাহলে সেই সরকারের ক্ষমতায় থাকার নৈতিক অধিকার কোথায় থাকে? মানুষের নিরাপত্তা ও জীবন যদি রাষ্ট্রযন্ত্র কেড়ে নেয় বা তা কেড়ে নেওয়া মেনে নেয়, তাহলে সে রাষ্ট্রে গণতন্ত্র, মানবাধিকার আর আইনের শাসন কোথায় থাকে? 

৩. 
আমাদের কিছু উদ্বেগ এখনো দূর হয়ে যেতে পারে ইলিয়াস জীবিত অবস্থায় ফেরত এলে। কিন্তু তিনি কি বেঁচে আছেন এখনো? আমি জানি, যাঁরা প্রকৃত রাজনীতিক, যাঁরা দেশকে ভালোবাসেন, গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেন, তাঁরা মনেপ্রাণে চাইবেন তিনি বেঁচে থাকুন। আওয়ামী লীগের মতো সুদীর্ঘকালের গণতান্ত্রিক দলে এমন বহু নেতা-কর্মী আছেন, যাঁরা ইলিয়াসের ঘটনায় উদ্বিগ্ন। তাঁর অন্তর্ধানের প্রথম দিনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীর কথাবার্তায় তাঁদের উদ্বিগ্ন ও বিব্রত মনে হয়েছে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর কিছু দুর্ভাগ্যজনক মন্তব্যের পর আওয়ামী লীগের দু-একজন নেতাকে তাঁর মতো করে কথা বলতে হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী যেহেতু বলেছেন, ইলিয়াসকে খালেদা জিয়াই লুকিয়ে থাকতে বলে নাটক সাজিয়েছেন, তাঁকে ভুল প্রমাণ করার জন্য নিশ্চয়ই পুলিশ-গোয়েন্দা কাজ করবে না। অন্য বহু তদন্তের মতো সময়ক্ষেপণের মাধ্যমে এটিও ঝুলিয়ে দেওয়া হতে পারে তাই। সরকারের কাজের যা প্যাটার্ন, এ ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার জন্য আরও ভয়াবহ কোনো ঘটনাও হয়তো ঘটানো হতে পারে বাংলাদেশে।
আমি জানি, দেশজুড়ে গুজব আছে ইলিয়াসকে ফেরত দেওয়া হতে পারে জীবিতাবস্থায়। কিন্তু এটি বিশ্বাস করা কষ্টকর। যেখানে কোনো তদন্তের আগে প্রধানমন্ত্রী বলেন যে এটি বিরোধী দলের নেত্রীর সাজানো নাটক, সেখানে ইলিয়াস এমন একটি বিবরণ নিজে থেকে দিতে রাজি হলেই কেবল তাঁকে জীবিত ফেরত দেওয়া সম্ভব। নিজের জীবন রক্ষার্থে এবং সন্তানের মুখের দিকে চেয়ে ইলিয়াস হয়তো সাময়িকভাবে রাজি হতে পারেন এতে। কিন্তু তাতে এই হীন অপরাধের জন্য দায়ী ব্যক্তিরা রক্ষা পাবে, প্রকৃত ঘটনা নিয়ে কুৎসিত কাদা ছোড়াছুড়ি অব্যাহত থাকবে, দেশবাসী আরও বিভ্রান্তিতে পড়বে।
আমরা তবু চাই, ইলিয়াস ফেরত আসুন। কারণ, শাহ্দীন মালিকের গতকালের অসাধারণ লেখা থেকেই বলছি, ‘এভাবে চলতে থাকলে দেশে রাজনীতি আর রাজনীতিবিদদের আকাল পড়বে। বহাল তবিয়তে থাকবে শুধু র‌্যাব।’ 
যত দূর মনে করতে পারি, প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি একটি অনুষ্ঠানে র‌্যাবের দিকে ইঙ্গিত করে বিরোধী দলকে বলছেন, আপনাদের সৃষ্টি করা বাহিনীই আপনাদের খাবে! বিএনপির কি এখন বোধোদয় হচ্ছে, কী ভয়ংকর আগুন নিয়ে খেলেছিল তারা র‌্যাবের মাধ্যমে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড শুরু করে? আর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি কি বুঝতে পারছেন, আপনার আমলে গুম-সংস্কৃতি বিস্তার হওয়ায় কোন দাবানল তৈরি হচ্ছে দেশে? গুম হওয়া যদি স্বাভাবিক হয়ে পড়ে, তাহলে কে জানে গণতন্ত্রই এক দিন গুম হয়ে যায় নাকি এ দেশে! 
আমরা সত্যিই আশঙ্কিত! 

পাদটীকা: এই লেখা যখন লিখছি, দেশে তখন হরতাল চলছে বিরোধী দলের আহ্বানে। হরতালের দিন এবং আগের দিন সহিংসতায় নিহত হয়েছেন দুজন, আহত হয়েছেন অনেকে, বেশ কিছু যানবাহনে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। আমরা হরতালের অধিকারে বিশ্বাসী, কিন্তু হরতালে নিহত-আহত হওয়ার ঘটনা আর ধ্বংসযজ্ঞ এই অধিকারের আওতায় পড়ে না। আমরা এর তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি।
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

শুক্রবার, ১৩ এপ্রিল, ২০১২

দুই যোগ দুই চার



আসিফ নজরুল | তারিখ: ১৩-০৪-২০১২

রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত আমার প্রিয় একজন রাজনীতিক ছিলেন। কারণ, তিনি মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। কারণ এটিও যে, আমি গণপরিষদ বিতর্ক আদ্যোপান্ত পড়েছি। তিনি তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সংসদ এবং পরে এরশাদবিরোধী আন্দোলনেও অসামান্য ভূমিকা রেখেছিলেন। তিনি সেসব বিরলপ্রায় রাজনীতিবিদদের একজন, যিনি প্রকৃত অর্থে জ্ঞানী একজন মানুষ। তাঁর রসাত্মক তির্যক মন্তব্য করার ক্ষমতাও অসাধারণ।
আমরা যারা সরকারের ‘ভুল ধরা’ পার্টি, তারা তাই তিনি মন্ত্রিসভায় নেই কেন এ নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সমালোচনা করেছি। তিনি ও ওবায়দুল কাদের মন্ত্রী হওয়ার পর উচ্ছ্বসিত হয়েছি এবং এই আশাবাদ ব্যক্ত করেছি যে তাঁরা ভালো কিছু উদাহরণ তৈরি করবেন। শেয়ারবাজার ঠিক করার জন্য যখন সবচেয়ে সন্দেহভাজন ব্যক্তিটি দায়িত্ব পেল, তিনি তখন ‘শুঁটকির মার্কেটে বিড়াল চৌকিদার’ মন্তব্য করেছিলেন। রেলওয়েতে দুর্নীতির কালো বিড়ালকে ধরার সাহসী মন্তব্য করেও তিনি প্রশংসিত হয়েছিলেন।
তাঁর মতো মানুষ কোনো নোংরা বিতর্কে জড়িয়ে পড়বেন না—এই প্রত্যয় অনেকের ছিল। ১০ এপ্রিল সুরঞ্জিতের এপিএসের গাড়িতে ৭০ লাখ টাকা উদ্ধারের ঘটনায় তাই আমাদের দুঃখ পাওয়ার কারণ আছে। বাংলাদেশের বহু নাগরিকের মতো আমাদের কিছু যৌক্তিক প্রশ্ন তোলারও অধিকার রয়েছে।

২.
১০ এপ্রিলের প্রতিটি ঘটনা অত্যন্ত রহস্যপূর্ণ এবং স্পস্টভাবে দুর্নীতির ইঙ্গিতবাহী। প্রথমত, ৭০ লাখ টাকা নিয়ে মধ্যরাতে মন্ত্রীর এপিএস রেলওয়ের জিএম (পূর্ব) এবং নিরাপত্তা কর্মকর্তাকে নিয়ে মন্ত্রীর বাড়িতে যাচ্ছিলেন। এই টাকা কার? মন্ত্রীর এপিএস বলেছেন, তাঁর শ্যালকের টাকা এটি। শ্যালকের যদি হয়, তিনি এই টাকা কোথায় পেলেন, এটি নিয়ে এপিএস মন্ত্রীর বাড়িতে কেন যাচ্ছিলেন? মধ্যরাতে কোনো ব্যাংকের শাখা টাকা জমা নেওয়ার জন্য খোলা থাকে না, কোনো দোকানপাট, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান খোলা থাকে না। এই টাকা স্পষ্টতই একজনের কাছে থেকে আরেকজনের কাছে স্থানান্তরের জন্য নেওয়া। গাড়ির গন্তব্য যদি মন্ত্রীর বাড়ি হয়, তাহলে সেই আরেকজন কি তিনিই নন?
দ্বিতীয়ত, মন্ত্রীর এপিএসের ড্রাইভার হঠাৎ গাড়ি বিজিবির জিগাতলা গেটে ঢুকিয়ে গাড়িতে অবৈধ টাকা আছে বলে শোরগোল তোলেন। বিজিবি গাড়ি তল্লাশি করে টাকা পায়। এরপর বিজিবি কেন শুধু ড্রাইভারকে আটক রেখে বাকিদের ছেড়ে দিল, বাকিদের ছেড়ে দেওয়ার নির্দেশ বা অনুরোধ কে করেছিল? বিজিবি কেন এত বড় একটি ঘটনা পুলিশের কাছে রিপোর্ট করল না, কেন এই ঘটনায় কোনো মামলা হলো না? সারা দেশ যখন এই টাকা উদ্ধারের ঘটনা জেনে গেল, তখন বিজিবির প্রধান কী করে সাংবাদিকদের বলেন, টাকার ব্যাপারে তিনি কিছু জানেন না? ডিসিপ্লিনারি ফোর্স হিসেবে বিজিবির প্রবেশদ্বারে এত বড় একটি ঘটনা ঘটার পর তিনি কেন এটি একটি ভুল-বোঝাবুঝি বলে এড়িয়ে যেতে চাইলেন। খুব ক্ষমতাধর কোনো ব্যক্তির নির্দেশ ছাড়া বিজিবির প্রধান কি এ রকম ধামাচাপা দেওয়া কথা বলতে পারেন?
তৃতীয়ত এবং সবচেয়ে মারাত্মক যেটি তা হলো, কোনো তদন্ত ছাড়াই এপিএসের পক্ষে মন্ত্রীর সাফাই এবং ড্রাইভারের বিরুদ্ধে উদ্ভট অভিযোগ তোলা। এপিএসের কাছে এত টাকা কোথা থেকে এল, সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছিলেন, ‘এটি তার ব্যক্তিগত টাকা।’ অথচ এপিএস বহু পত্রিকায় দেওয়া সাক্ষাৎকারে দাবি করেছেন, এটি তাঁর প্রবাসী শ্যালকের টাকা। সুরঞ্জিতের মতে, ব্যক্তিগত টাকা নিয়ে চলাফেরার অধিকার সবার আছে। ‘ব্যক্তিগত টাকা নিয়ে’ এই চলাফেরা ছিল তাঁর বাড়ির উদ্দেশে, সাংবাদিকেরা পরের দিন এই প্রশ্ন করলে তিনি মরিয়াভাবে তা অস্বীকার করেছেন। অথচ টাকা বহনকারী গাড়ির তিনজন যাত্রীই বলেছেন, তাঁরা মন্ত্রীর বাড়িতে যাচ্ছিলেন।
সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের সবচেয়ে বিতর্কিত মন্তব্য হচ্ছে এটি যে, তাঁর এপিএসকে ব্ল্যাকমেইল ও হাইজ্যাক করার জন্য গাড়িচালক বিজিবির সদর দপ্তরে ঢুকে পড়ে। তিনি যদি প্রথম আলোর অনলাইন সংস্করণে পাঠকদের মতামত পড়তেন, তাহলে খুবই লজ্জিত হতেন এমন আষাঢ়ে গল্প ফাঁদার জন্য। প্রথম আলোর বহু পাঠক এ প্রশ্ন করেছেন যে ব্ল্যাকমেইল ও হাইজ্যাক করার জন্য কোনো নিরস্ত্র গাড়িচালক তিনজন ক্ষমতাশালী ব্যক্তিকে নিয়ে সশস্ত্র অবস্থায় থাকা সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদর দপ্তরে কেন ঢুকে পড়বে? আমি নিজে অবাক হয়ে ভেবেছি কতটা বিচলিত ও কিংকর্তব্যবিমূঢ় হলে বাকচাতুর্যে অনন্য একজন ব্যক্তি এমন আবোল-তাবোল কথা বলতে পারেন। দুর্নীতি বা নিয়োগ-বাণিজ্যে যদি অন্যরা জড়িত হন, তাহলে তিনি তা জানার চেষ্টা করবেন, তাঁদের বিরুদ্ধে তদন্ত সাপেক্ষে কঠিন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলবেন। তিনি তা না করে তাঁদের রক্ষার জন্য একজন সাধারণ ড্রাইভারকে কেন অভিযুক্ত করবেন?
সুরঞ্জিতের এপিএস রাজনৈতিকভাবে নিয়োগ পাওয়া। এসব পদে মন্ত্রীর ইচ্ছায় তাঁর একান্ত অনুগত ব্যক্তিদের নিয়োগ দেওয়া হয়। ১০ এপ্রিলের ঘটনা সম্পর্কে তিনি বিভিন্ন গণমাধ্যমে যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা চরম স্ববিরোধিতাপূর্ণ। তাঁর বক্তব্যের সঙ্গে রেলওয়ের জিএম এবং নিরাপত্তা কর্মকর্তার বক্তব্যেও প্রচুর গরমিল রয়েছে। এই মিথ্যাচারী এবং পত্রপত্রিকার রিপোর্ট অনুসারে হঠাৎ বিত্তশালী ব্যক্তিকে রক্ষার দায় তিনি কেন অনুভব করেছিলেন?
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে, গাড়িচালকের পরিণতি। অভিযুক্ত ব্যক্তিদের ছেড়ে দিয়ে অভিযোগকারী এই ব্যক্তিকে এখন পর্যন্ত আটক করে রাখা হয়েছে। তাঁকে যদি আটক না করা হয়, তাহলে তিনি কোথায় আছেন এখন? প্রথম আলোর কিছু পাঠক অভিযোগ করেছেন, তাঁকে হয়তো ‘জজ মিয়া’ বানানোর চেষ্টা হবে একসময়। আমার আশঙ্কা, তাঁকে হয়তো একসময় সাংবাদিকদের সামনে এনে স্বীকার করানো হবে, অন্য কারও কোনো দোষ নেই, তিনিই মাথা গরম করে এই কাজটি করেছিলেন। কিংবা আরও বহু ঘটনার মতো এখানেও তদন্তের নামে সময়ক্ষেপণ করা হবে। একসময় হয়তো বলা হবে, এটিও সরকারের বিরুদ্ধে বিরোধী দলের একটি যড়যন্ত্র চক্রান্ত!
এসবই আমাদের আশঙ্কা। কিন্তু প্রমাণিত খুনিদের ক্ষমা, গণহারে নিজেদের বিরুদ্ধে সব দুর্নীতির মামলা প্রত্যাহার, খুনের ঘটনায় সবচেয়ে সন্দেহভাজনকে আসামি না করা, শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির নায়কদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নেওয়া, সন্দেহজনক কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র সম্পর্কে আগে থেকেই দায়মুক্তি আইন গ্রহণসহ বর্তমান সরকার বিভিন্নভাবে নিজেদের যে দায়মুক্তির ধারা সৃষ্টি করেছে, তাতে এমন সন্দেহ হওয়া কি স্বাভাবিক নয়?

৩.
সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের এপিএসের গাড়িতে টাকা উদ্ধারের ঘটনার পর অধিকাংশ পত্রপত্রিকায় যেসব তথ্য এসেছে, তা একত্র করলে সকল সন্দেহের তির মন্ত্রীর দিকে যাবে। এই মন্ত্রণালয়ে দুর্নীতি আছে, মন্ত্রী একাধিকবার এটি বলেছেন, সাড়ে সাত হাজার পদে নিয়োগের জন্য সাধারণ মানুষের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা নিয়োগ-বাণিজ্য হয়েছে, এই অভিযোগ করেছেন স্বয়ং সরকারি দলের সাংসদসহ বহু মহল, নিয়োগ-বাণিজ্যে টাকা তোলার জন্য যাকে দায়ী করা হচ্ছে, সেই রেলওয়ের জিএম (পূর্ব) যে ঘুষখোর, তাঁর রেকর্ডকৃত বর্ণনা প্রথম আলো কালকে ছেপে দিয়েছে, এপিএস নিজে যে আরেক দুর্নীতিবাজ, তা পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর হঠাৎ করে বিশাল সম্পদশালী হওয়ার বিবরণ থেকে আঁচ করা যায়, এই দুজন দুর্নীতিবাজ ব্যক্তি নিয়োগ-বাণিজ্যের সময়টিতেই ৭০ লাখ টাকা নিয়ে মধ্যরাতে রেলমন্ত্রীর বাড়িতে যাচ্ছিলেন, টাকা পরিবহনের সুবিধার জন্য সংসদ সদস্যের স্টিকার লাগানো গাড়িটি ব্যবহার করা হচ্ছিল, রেলমন্ত্রী বিজিবি অফিস থেকে তাঁদের ছেড়ে দেওয়ার জন্য প্রভাব খাটিয়েছেন এবং এত বড় একটি ঘটনার জন্য এখনো কোনো মামলা করা হয়নি। এসব তথ্যে যা প্রতীয়মান হয়, তাতে পৃথিবীর যেকোনো প্রকৃত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে অভিযুক্ত মন্ত্রী পদত্যাগ করতে বাধ্য হতেন (এমনকি সরকারকেই হয়তো পদত্যাগ করতে বাধ্য হতে হতো) এবং তাঁকে বিচারের সম্মুখীন হতে হতো।
আমাদের দেশে কি তা হবে? হবে না। এই ঘটনার কি সুষ্ঠু তদন্ত হবে? সেটিও খুব সম্ভবত হবে না। এই ঘটনার তদন্তের জন্য রেলমন্ত্রী হাস্যকর দুটো তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন। বিরোধী দল তা প্রত্যাখ্যান করে দাবি করছে বিচার বিভাগীয় তদন্ত। দুদক বলছে তারা এটি তদন্ত করে দেখবে। আমাদের অভিজ্ঞতা বলে, এ দেশে ৪০ বছরে নানা ধরনের সরকার এসেছে। সরকারকে জবাবদিহির সম্মুখীন করার ক্ষমতা আছে এমন কোনো প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে (যেমন: আদালত, সংসদীয় কমিটি, দুদক, এনবিআর, মহাহিসাব নিরীক্ষক) ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় সরকারের কোনো মন্ত্রীর দুর্নীতি উন্মোচিত হয়েছে, এমন নজির বাংলাদেশে নেই। এমন বহু নজির ভারতে আছে, বর্তমানে পাকিস্তানেও উচ্চ আদালত ক্ষমতাসীন সরকারের দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করেছেন। বাংলাদেশে এসব ঘটে না। ক্ষমতায় থাকা সরকারের দুর্নীতি বা অন্যায়কে উন্মোচন করার পরিবর্তে এমন দায়িত্ব রয়েছে, এ ধরনের কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান বরং সরকারের সমালোচনাকারীদের নানাভাবে হেনস্তা করে, বিরোধী দলের ওপর খড়্গহস্ত হয়, জনগণের প্রতিবাদ করার অধিকারকে রুদ্ধ করে এবং এভাবে দুর্নীতি ও কুশাসনবান্ধব এক পরিবেশ দেশে গড়ে তোলে।

৪.
এখনো ভালো একটি নজির স্থাপন করতে পারেন স্বয়ং সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। যত বাণী তিনি এত বছর উচ্চারণ করেছেন, তা তিনি নিজে বিশ্বাস করে থাকলে তাঁর অবশ্যই পদত্যাগ করা উচিত। দুদককে তাঁরই আহ্বান করা উচিত তদন্তের জন্য, বিরোধী দলের সদস্যদের নিয়ে একটি সংসদীয় তদন্ত কমিটি গঠনের প্রস্তাব তাঁরই করা উচিত, নিজে পদত্যাগের আগে রেলওয়ের জিএমকে (পূর্ব) সাসপেন্ড করার আদেশ তাঁরই দেওয়া উচিত।
তাঁর কপাল সত্যিই খারাপ। রেলওয়ের মতো বা তার চেয়ে বড় দুর্নীতির আলামত আমরা পাই সরকারের অন্য কিছু কর্মকাণ্ডে। পদ্মা সেতু নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ করছে বিশ্বব্যাংকসহ কিছু দাতা প্রতিষ্ঠান। এ বিষয়ে তদন্তে কিছু সত্যতা পাওয়া গেছে বলে দাবি করছে কানাডা সরকার। শেয়ারবাজারে কোটি কোটি টাকা লোপাট করার প্রাথমিক প্রমাণ পেয়েছে সরকারের গঠিত কমিটি, কুইক রেন্টাল পদ্ধতিগতভাবে অস্বচ্ছ এবং দুর্নীতিবান্ধব এমন কথা বলছেন অনেকেই, কোটি কোটি টাকার নতুন ব্যাংক ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার অনুমতি পাচ্ছে সরকারের লোকজন কোনো জ্ঞাত আয়ের যথেষ্ট উৎস ছাড়াই।
কোনটি সত্যি দুর্নীতি, কোনটি নয়, তা জানার মতো পরিস্থিতি দেশে নেই। তবে দুর্নীতির বহুল প্রচলিত সংজ্ঞা হচ্ছে অত্যন্ত ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের কোনো জবাবদিহি না থাকলে দুর্নীতি হবেই। দুই যোগ দুই চারের মতোই সরল অঙ্ক এটি। যত দিন পর্যন্ত অমিত ক্ষমতাশালী ব্যক্তিদের জবাবদিহি প্রতিষ্ঠিত করার কাজটি উল্লিখিত প্রতিষ্ঠানগুলো না সম্পন্ন করবে, তত দিন পর্যন্ত তাঁরা দুর্নীতি করছেন না, এটি বিশ্বাস করার কারণ নেই।
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

বুধবার, ৪ এপ্রিল, ২০১২

আদালতের মর্যাদা কীভাবে রক্ষিত হবে



আসিফ নজরুল
১৪ সেপ্টেম্বর একটি ছবি ছাপানো হয়েছে দৈনিক নয়া দিগন্ত পত্রিকায়। ছবিটি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে প্রধান বিচারপতি ও অন্য কয়েকজন বিচারপতির। প্রধানমন্ত্রীকে ঈদের শুভেচ্ছা জানাতে গত শনিবার তাঁরা গণভবনে গিয়েছিলেন। ছবিটির উৎস সরকারের একটি দপ্তর, প্রেস ইনফরমেশন ডিপার্টমেন্ট।
প্রধানমন্ত্রীকে তাঁর বাসভবনে গিয়ে প্রধান বিচারপতির শুভেচ্ছা জানানোর নজির আমার জানামতে আর নেই। এই ঘটনা সর্বোচ্চ আদালতের জন্য মর্যাদাহানিকরও মনে হতে পারে কারও কারও কাছে। সর্বোচ্চ আদালতে বিচারাধীন মামলাগুলোতে (বিশেষ করে সাংবিধানিক, ফৌজদারি, ট্যাক্স-সংক্রান্ত) সরকার একটি পক্ষ হিসেবে জড়িত থাকে। সরকার বলতে এখানে নির্বাহী বিভাগকেই বোঝানো হয়। সেই নির্বাহী বিভাগের প্রধান হচ্ছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে এ ধরনের সামাজিক মেলামেশা সে জন্য মানুষকে ভুল ইঙ্গিত দিতে পারে। সম্ভবত এই বিবেচনা থেকেই আমরা বিচারপতিদের কোনো সরকারপ্রধানের কাছে গিয়ে শুভেচ্ছা জানাতে আগে কখনো দেখিনি। 
এর আগে কাছাকাছি একটি ঘটনা ঘটেছিল বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে। তখন তৎকালীন প্রধান বিচারপতি মাহমুদূল আমীন চৌধুরী প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে বিচারপতিদের কিছু সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়েছিলেন। তিনি বিনা কাজে সেখানে যাননি, অন্য বিচারপতিদের সঙ্গে করেও নিয়ে যাননি। তার পরও তখন এই ঘটনার জন্য বিভিন্ন মহল থেকে সমালোচনা করা হয়েছিল। বর্তমান প্রধান বিচারপতির সে ঘটনা ভুলে যাওয়ার কথা নয়। তাঁর সঙ্গে যেসব বিচারপতি গিয়েছেন তাঁদেরও নিকট-অতীতের এই ঘটনা ভুলে যাওয়ার কথা নয়। প্রধান বিচারপতি যদি তাঁদের বলেও থাকেন, তাহলেও সামাজিক কোনো অনুষ্ঠানে যাওয়ার বাধ্যবাধকতা তাঁদের ছিল না। 
প্রধান বিচারপতির আচরণ নিয়ে অতীতেও প্রশ্ন উঠেছে। তিনি প্রধান বিচারপতি হওয়ার পর চট্টগ্রাম সমিতি, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় আইন সমিতি বা বাংলাদেশ আইন সমিতির মতো সংগঠনের অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন। বিচারপতিদের আচরণবিধির সঙ্গে এগুলো কতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ, তা নিয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশ্যে সংশয় প্রকাশ করা হয়েছে। তিনি তার পরও থামেননি। মাত্র মাসখানেক আগেই তিনি একটি লিটল ম্যাগাজিন আয়োজিত পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানে গিয়েছেন। 
প্রধান বিচারপতিকে নিয়ে এসব প্রশ্ন উদ্রেককারী ঘটনা এমন এক সময়ে ঘটছে যখন আদালতের মর্যাদা রক্ষার দায়িত্ব উচ্চ আদালতই অন্যদের বিভিন্নভাবে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন। প্রধান বিচারপতি নিজেও এ ক্ষেত্রে কঠোর ভূমিকা নিচ্ছেন। তিনি এবং আপিল বিভাগের বিচারপতিরা আদালত অবমাননার দায়ে মাহমুদূর রহমানকে নজিরবিহীনভাবে দণ্ডিত করেছেন। উচ্চ আদালত আরও কিছু ক্ষেত্রে তাঁর মর্যাদা রক্ষার প্রশ্নে সাধারণ নাগরিকদের বিভিন্নভাবে তিরস্কৃত বা শাস্তিদান করেছে।
উচ্চ আদালতের মর্যাদা রক্ষা করা অবশ্যই সবার দায়িত্ব। কিন্তু চূড়ান্ত বিচারে এই মর্যাদা সবচেয়ে বেশি রক্ষিত হতে পারে বিচারপতিদের আচরণ ও কাজের মধ্য দিয়েই। বিচারপতিদের কেউ যদি এসব বিষয়ে দৃষ্টিযোগ্যভাবে সচেতন না থাকেন, আবার কেউ যদি আদালতের সম্মান রক্ষার কথা বলে সমালোচকদের নজিরবিহীন শাস্তি দেন, তাহলে তা সবার কাছে মানানসই মনে হবে না। আদালতের রায়ে কোনো রকম অসংগতি থাকলেও তা আদালতের মর্যাদা বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে না।

২. 
আদালত অবমাননার দায়ে আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমান এবং এর একজন প্রতিবেদকের শাস্তি প্রদানের ঘটনা সাম্প্রতিক। এই রায় নিয়ে আইরিন খান, আতাউস সামাদ, মিজানুর রহমান খানসহ অনেকের লেখা ছাপা হয়েছে, বহু ব্লগে পাঠকেরা নানা মন্তব্য করেছেন। আমি খুব কম লেখা ও মন্তব্যে এই রায়ের প্রতি সমর্থন লক্ষ করেছি। আইনশাস্ত্রে একটি বহুল প্রচলিত নীতি হচ্ছে, ন্যায়বিচার শুধু করলেই হবে না, ন্যায়বিচার যে হয়েছে তা প্রতীয়মান হতে হবে। মাহমুদুর রহমানের রায়ের ক্ষেত্রে তা কোনো কোনো স্থানে প্রতীয়মান হয়নি। ন্যায়বিচারের অন্যতম শর্ত হচ্ছে, অন্তত একটি আপিল করার অধিকার প্রদান। খুনি, ধর্ষণকারী এমনকি যুদ্ধাপরাধীরা পর্যন্ত এই অধিকার বাংলাদেশ এবং অন্য সব দেশে পেয়ে থাকেন। এই অধিকার নিশ্চিত করার জন্য পৃথিবীর বহু দেশে আপিল বিভাগ বা সর্বোচ্চ বিচারিক প্রতিষ্ঠানকে নিজে নিজে বিচার করার ক্ষমতা (অর্থাৎ আদি এখতিয়ার) প্রদান করা হয়নি। আপিল বিভাগের আদি এখতিয়ার আছে, বাংলাদেশের সংবিধানেও তা বলা নেই। সংবিধান সুস্পষ্টভাবে আদি এখতিয়ার প্রদান করেছে হাইকোর্ট বিভাগকে, যাতে তার রায়ের ভুল-বিচ্যুতি উচ্চতর বিভাগ হিসেবে আপিল বিভাগ আপিল চলাকালে পরীক্ষা করে দেখতে পারেন। কিন্তু মাহমুদুর রহমানকে নজিরবিহীনভাবে বিচার করে শাস্তি প্রদান করেছে আপিল বিভাগ নিজে। এখন বাংলাদেশে তিনি এবং তাঁর প্রতিবেদকই হচ্ছেন সম্ভবত একমাত্র মানুষ, যাঁদের কোনো আপিলের অধিকার নেই। আমাদের সংবিধানে বর্ণিত আইনের দৃষ্টিতে সমতার নীতি এতে রক্ষিত হলো কি?
তাঁকে যে মেয়াদে শাস্তি দেওয়া হয়েছে, তার সঙ্গেও আপিল বিভাগের একজন কর্মরত বিচারক এবং সাবেক বিচারপতি গোলাম রাব্বানীসহ কেউ কেউ ভিন্নমত পোষণ করেছেন। আদালত অবমাননা আইন, ১৯২৬ অনুসারে আদালত অবমাননার সর্বোচ্চ শাস্তি হচ্ছে ছয় মাসের কারাদণ্ড এবং/অথবা দুই হাজার টাকা জরিমানা। আইনে এও বলা আছে যে অন্য কোনো আইনে যা কিছুই লেখা থাক না কেন, হাইকোর্ট এর চেয়ে বেশি কোনো শাস্তি দিতে পারবে না। আইনে এ কথা জোরের সঙ্গে বলার কারণ এই যে আগে আদালত অবমাননার শাস্তি নির্ধারণে বিচারকদের ক্ষমতা ছিল অবারিত এবং অতীতে এর বহু বিতর্কিত প্রয়োগ হয়েছে। আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি অনুসারে অপরাধের শাস্তি নির্ধারণ করে আইন প্রণয়নের ক্ষমতা কেবল সংসদের। আমাদের সংবিধানে সুপ্রিম কোর্টকে এবং আপিল বিভাগের বিধিমালায় আপিল বিভাগকে আইনসাপেক্ষে বা আইন অনুসারে আদালত অবমাননার শাস্তি প্রদানের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। আদালত অবমাননার জন্য আপিল বিভাগ সর্বোচ্চ কত শাস্তি দিতে পারবে, এটি নির্ধারণ করে কোনো আইন আজ পর্যন্ত প্রণীত হয়নি। আপিল বিভাগ এ ক্ষেত্রে অন্তত ১৯২৬ সালের আইনের সীমারেখার মধ্যে থাকতে পারতেন। তাঁরা যে মাহমুদুর রহমানকে অতিরিক্ত শাস্তি দিলেন, তা একটি খারাপ নজির হয়ে থাকবে। কারণ এর তাত্ত্বিক মানে হচ্ছে, ভবিষ্যতে উল্লিখিত আইন না হওয়া পর্যন্ত যেকোনো মেয়াদে শাস্তি দেওয়ার ক্ষমতা আপিল বিভাগ নিজে নিজেকে প্রদান করেছেন। এই ক্ষমতা বিশেষ করে অনির্বাচিত সরকারের আমলে বিভিন্ন মহল কর্তৃক অপব্যবহারের চেষ্টা করা হতে পারে।
১৯২৬ সালের আইনের নির্দিষ্ট দণ্ডের বিষয়টি অনুসরণ না করলেও এই আইন থেকে উদ্ভূত যে সেকেলে দৃষ্টিভঙ্গি সেটা কিন্তু ঠিকই অনুসরণ করেছেন আপিল বিভাগ। তাঁরা আদালত সম্পর্কে মাহমুদুর রহমানের অবমাননাকর মন্তব্যগুলো সত্য ছিল কি না, তা পরীক্ষা করে দেখেননি। পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে সত্যপ্রকাশকে আদালত অবমাননা হিসেবে গণ্য করা হয় না। ভারতে ২০০৬ সালের আইনে সত্যপ্রকাশকে আদালত অবমাননার দায় থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। পাকিস্তানের আইনে বিদ্বেষপ্রসূত কোনো উদ্দেশ্য না থাকলে এমনকি বিকৃত তথ্য প্রকাশ করলেও তা আদালত অবমাননা হবে না। আমাদের দেশেও অতীতে সত্যপ্রকাশের জন্য আদালত অবমাননা হয়নি, এ ধরনের নজির আছে (যেমন মানবজমিন মামলা)। সত্য প্রকাশ করা হয়েছিল বলেই অতীতে আমরা দুর্নীতিপরায়ণ বা মিথ্যে সার্টিফিকেট প্রদানকারী বিচারপতিকে হাইকোর্ট ত্যাগ করতে বাধ্য হতে দেখেছি। এখন আপিল বিভাগের রায়ের ভিত্তিতে ভবিষ্যতে যদি এ ধরনের কোনো বিচারপতি আদালত অবমাননার দণ্ড দিয়ে দেন, তা কি শুভকর হবে?
আদালত অবমাননা আইনের মূল লক্ষ্য হচ্ছে, আদালত নামক মহান প্রতিষ্ঠানের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধাবোধ রক্ষা করা। এর উদ্দেশ্য সমালোচকদের ঢালাওভাবে ভীতসন্ত্রস্ত করা নয়। ঔপনিবেশিক আমলে ১৯২৬ সালের আইনটি খুব সৎ উদ্দেশ্যে করা হয়নি। উচ্চ আদালত বহু ক্ষেত্রে, বিশেষ করে জনস্বার্থ মামলায় আইন ও সংবিধানের প্রগতিশীল ব্যাখ্যা দান করে প্রশংসিত হয়েছেন। মাহমুদুর রহমানের মামলায় ১৯২৬ সালের আইনটির প্রগতিশীল ব্যাখ্যা করার সুযোগ উচ্চ আদালতের ছিল। তাঁরা তা করলেই বরং উচ্চ আদালতের মর্যাদা আরও বৃদ্ধি পেত। 

৩. 
উচ্চ আদালতের মর্যাদা বিশেষভাবে সম্পর্কিত সংবিধানসংক্রান্ত রায়গুলোর সঙ্গে। এসব রায়ে রাজনৈতিক ইতিহাসের আইনগত পর্যালোচনার সুযোগ থাকে। বাংলাদেশের মতো তীব্রভাবে বিভাজিত একটি রাজনৈতিক সমাজে সেই রায় তাই পড়া হয় নানা প্রত্যাশা এবং একই সঙ্গে সন্দেহ নিয়ে। 
সম্প্রতি উচ্চ আদালত পঞ্চম ও সপ্তম সংশোধনী-সংক্রান্ত রায় দিয়েছেন। আমার বিশ্বাস, এসব রায় জনমনে প্রবল আগ্রহের সৃষ্টি করেছে। এসব রায়ে প্রত্যাশিতভাবেই সামরিক শাসনকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে বলে বহু বিশ্লেষক প্রশংসা করেছেন। কিন্তু তাই বলে রায়গুলো বিতর্কমুক্ত থাকেনি। যেমন: পঞ্চম সংশোধনী মামলার রায়ে বঙ্গবন্ধুর আমলে কৃত চতুর্থ সংশোধনীর সঙ্গে সাংঘর্ষিক ক্ষেত্রগুলোতে পঞ্চম সংশোধনীর বিধানগুলো বহাল রাখা হয়েছে। কেন একটি বৈধ সংশোধনীর (চতুর্থ) তুলনায় অবৈধ সংশোধনী (পঞ্চম) প্রাধান্য পেল, তার সম্পূর্ণ ব্যাখ্যা করতে হলে চতুর্থ সংশোধনীর অগণতান্ত্রিক দিকগুলো আলোচনা করা প্রয়োজন ছিল। রায়ে তা অনেকাংশে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। আবার একই রায়ে বঙ্গবন্ধু সরকারের আমলে কৃত সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদের পরিবর্তনকে মাইনর চেঞ্জেস (ছোটখাটো পরিবর্তন) হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। অথচ এই পরিবর্তনের মাধ্যমেই সংবিধানে মৌলিক অধিকার-পরিপন্থী বিধান সংযোজনের পথ সুগম হয়েছে।
সপ্তম সংশোধনী মামলার পূর্ণাঙ্গ রায় আমরা পাইনি এখনো। তবে এই রায়ের সংক্ষিপ্ত আদেশে কেবল ১৯৮২ থেকে ১৯৮৬ পর্যন্ত এরশাদের শাসনকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে। এর মানে হচ্ছে, বাকি সময়ে তাঁর শাসনামল বৈধ ছিল। এরশাদ এখন বলার সুযোগ পাবেন যে ১৯৮৭ ও ১৯৯০ সালের গণ-অভ্যুত্থান ছিল একটি বৈধ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন (নাকি যড়যন্ত্র?)। তিন জোটের যে দলিলে এরশাদকে অবৈধ শাসক বলা হয়েছে, সেই দলিলও কি তাহলে এখন অবৈধ বা মানহানিকর হয়ে গেল না? জয়নাল, দীপালি সাহা, সেলিম, দেলোয়ার, বসুনিয়া, নূর হোসেন তাহলে রক্ত দিয়েছিলেন একজন বৈধ শাসককে উৎখাত করতে গিয়ে? হাইকোর্টের আদেশের এমন অপব্যাখ্যা করার সুযোগ কি আদেশের মধ্যেই রয়ে গেল না? পূর্ণাঙ্গ রায়ে এর কোনো সন্তোষজনক ব্যাখ্যা না থাকলে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের জন্য তা শুভকর হবে না।

৪. 
বাংলাদেশের মতো দুর্বল গণতান্ত্রিক দেশে মানুষের শেষ ভরসার স্থল হচ্ছে আদালত। এখানে নির্বাহী বিভাগের আচরণ লুটেরা ও অত্যাচারীর মতো। সংসদ থাকে নির্বাহী বিভাগের তল্পিবাহক হয়ে। দুর্নীতি দমন কমিশন, তথ্য কমিশন বা মানবাধিকার কমিশন কাজ করে বা বসে থাকে সরকারের ডিকটেশনে। সরকারকে জবাবদিহির মধ্যে রাখার ভূমিকা অপর্যাপ্তভাবে হলেও পালন করে কেবল গণমাধ্যম বা উচ্চ আদালত। এই দুটো প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা, স্বাতন্ত্র্য ও নিরপেক্ষতা নিয়ে তাই সচেতন নাগরিক সমাজ সব সময়ই উচ্চকিত। তবে তাঁদের কারও কারও মন্তব্য বা আচরণে বাড়াবাড়ি থাকে না, তা নয়। কিন্তু আদালত অতীতে অধিকাংশ সময়ে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে তা দেখেছেন। অন্যদিকে, আদালতের স্বাধীনতা ও ক্ষমতায়নের প্রতিও মানুষ অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়েছে।
শাসক বনাম শোষিতের স্বার্থের দ্বন্দ্বে আইনগত পরিসীমার মধ্যে থেকে আদালত যখনই শোষিতের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন, তাঁর মর্যাদা তখনই বেড়েছে। আইনের শাসন, মানবাধিকার আর সংবিধানকে রক্ষা করতে গিয়ে উচ্চ আদালত যত বেশি বিদ্যমান সরকারের প্রতিপক্ষ হয়েছে, তাঁর সম্মান ততই প্রসারিত হয়েছে। 
আমরা আদালতের এমন ভূমিকা প্রত্যাশা করি। আমরা এও মনে করি, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, মিথ্যা ও অবমাননাকর আক্রমণ থেকে আদালতকে অবশ্যই মুক্ত রাখতে হবে। একটি যুগোপযোগী ও সুস্পষ্ট আদালত অবমাননা আইন, বিচারপতিদের আচরণবিধি তদারকিতে উচ্চ আদালত কর্তৃক বিধি প্রণয়ন করে সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি নির্ধারণ, বিচারকদের নিয়োগপদ্ধতি উন্নতকরণ, ১৯৭২ সালের সংবিধানের আলোকে তাঁদের অবসর-পরবর্তী নিয়োগ নিষিদ্ধকরণ এবং তাঁদের চাকরিকালীন সুযোগ-সুবিধা আরও বৃদ্ধির মাধ্যমে এগুলো করা সম্ভব। উচ্চ আদালত কিছু বিষয়ে নিজেই বিভিন্নভাবে উদ্যোগী ভূমিকা নিতে পারেন।
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

‘তাহারা’ সাধু, আমরাই শয়তান

নতুন একটি টিভি চ্যানেল চব্বিশ ঘণ্টা খবর প্রচার করছে। সেখানে গোপন ক্যামেরায় পুলিশের ঘুষ গ্রহণের ছবি দেখানো হচ্ছে। এমন ছবি আমরা পত্রিকায়ও দেখছি বহু আগে থেকে। এরা ছিঁচকে ধরনের চোর, এমন চোর অবশ্যই আছে বাংলাদেশে। তবে দেশের হর্তাকর্তাদের কেউই এমন নন। তাঁরা ছিঁচকেও না, সিঁধেল চোরও না। তাঁরা নিষ্কলুষ। তাঁদের কাউকে হাতেনাতে ধরা হয় না টিভিতে-পত্রিকায়। ধরা সম্ভব না। কারণ তাঁরা সাধুপুরুষ। স্বয়ং উচ্চ আদালতেও তা প্রমাণ হয়েছে, হচ্ছে। 
মাঝখানে ঝামেলা শুরু করেছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার। ধুমধাড়াক্কা আয়োজনের মধ্য দিয়ে সাধুদের বিরুদ্ধে মামলা করা হলো সেই সরকারের আমলে! ভয়াবহ সব তথ্য উদ্ঘাটিত হলো, অকাট্য সব প্রমাণ দাখিল করা হলো। আসলে এ সবই ছিল যড়যন্ত্র! দেশে গণতন্ত্রের জোয়ার বওয়ামাত্র এই যড়যন্ত্র খড়কুটোর মতো ভেসে গেল। গণতান্ত্রিক সরকারের আমলে গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সম্মান ফিরে এল, তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহার হলো। তাঁরা সরকারের লোক। সরকারের লোক দুর্নীতি করেন না বাংলাদেশে, দুর্নীতি করে বিরোধী দল! কাজেই তাঁদের মামলা তো প্রত্যাহার হবেই! এর মধ্যে দোষের কিছু নেই। থাকলে গোটা দেশ চুপ করে থাকত না এ ঘটনায়!
মামলা প্রত্যাহার হয়নি বিরোধী দলের। সরকারের দু-একজন বিচারিক আদালতে সাজাপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। তাই তাঁদেরও মামলা প্রত্যাহার করা যায়নি। আসলে তাঁরাও ছিলেন সাধুপুরুষ। উচ্চ আদালতে তাঁদের সাজা মাফ হয়েছে, হচ্ছে। এমনকি বিরোধী দলের যেসব মহাপুরুষের দুর্নীতির খবরে ঢি-ঢি পড়ে গিয়েছিল সারা দেশে, তাঁদের সাজাও একে একে বাতিল হচ্ছে উচ্চ আদালতে। 
উচ্চ আদালতের দোষ নেই। দুর্নীতি প্রমাণ করার দায়িত্ব আদালতের নয়। এই দায়িত্ব সরকারি আইনজীবীদের। তাঁদেরও দোষ নেই। মামলা ঠিকমতো দায়ের না হলে, দুর্নীতির প্রমাণ না থাকলে তাঁরা কী করবেন? দোষ যে তদন্তকারীদের তাও নয়। আইনে যেভাবে আছে, নির্দেশ যেভাবে ছিল, তাঁরা সেভাবেই মামলা করেছিলেন। আইন যাঁরা বানিয়েছিলেন, নির্দেশ যাঁদের ছিল, তাহলে কি তাঁদের দোষ? তাই বা বলি কী করে! তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সেই অগ্নিপুরুষদের সততা আর যোগ্যতা প্রশ্নাতীত। দুই সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে তাঁরা হিড়হিড় করে টেনে নিয়েছেন আদালতে, নির্জনবাস করিয়েছেন মাসের পর মাস, এমনকি খাবারে বিষ মিশিয়ে মেরে ফেলার চেষ্টাও নাকি করেছেন! পর্বতসম সততা আর নৈতিক মনোবল ছিল বলেই না এসব অভিযোগে কেশাগ্র স্পর্শ করা হয়নি তাঁদের! 
দোষ তাঁদের কারও নেই, ছিলও না। কারণ বাংলাদেশে ছিঁচকে চোর আছে, বড় দুর্নীতিবাজ কেউ নেই। ছিঁচকে চোরদের দিয়ে দেশের দুর্নীতির পরিমাপ হয় না। কাজেই যারা বাংলাদেশকে এত দিন দুর্নীতিতে প্রথম করেছে তারা ছিল যড়যন্ত্রকারী! বাংলাদেশে বড় সব যড়যন্ত্রে বিদেশিদের হাত থাকে। এখানেও নিশ্চয়ই ছিল। এমনও হতে পারে যে, যড়যন্ত্রকারীরা ছিল ভারতের দালাল, না হলে পাকিস্তানের দালাল! 
২.
কালো টাকা আর পেশিশক্তিমুক্ত নির্বাচনের কথা বলত ষড়যন্ত্রকারীরা। নেতারা কেউই যে কালো টাকার মালিক না তা তো প্রমাণিত হচ্ছেই। তাঁরা এমনকি সন্ত্রাসীও না। এসব কথা গণতন্ত্র না থাকলে বোঝা যায় না। গত গণতন্ত্রের আমলে আমরা দেখেছি, ২১ আগস্টের ঘটনায় কেউ দায়ী ছিল না। দায়ী ছিল শুধু বিদেশি শক্তি। স্বয়ং উচ্চ আদালতের একজন বিচারক তদন্ত করে তাই জানিয়েছিলেন। স্বজাতিদের সম্মান রক্ষায় জানপ্রাণ এই বিচারপতির মূল্যায়ন হয়নি দেশে। এক/এগারো না হলে হয়তো তিনি সম্মানিত হতেন, প্রধান বিচারপতিও নাকি হওয়ার কথা ছিল তাঁর। অথচ নতুন গণতন্ত্রের যুগে তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির তদন্ত হচ্ছে। তবে আমরা নিশ্চিত থাকতে পারি, তাঁরও শেষরক্ষা হবে। এ দেশে বড় মানুষেরা দুর্নীতি করে না। 
দুর্নীতি করে ট্রাফিক সার্জেন্ট বা কেরানির মতো ছোট মানুষেরা। সন্ত্রাস করে জজ মিয়ারা। নতুন গণতন্ত্রের আমলেও তার কত প্রমাণ দেখছি আমরা! এই তো সেদিন এমপির গাড়িতে নাকি গুলিবিদ্ধ হয়েছেন ইব্রাহিম মিয়া। পুলিশ সঙ্গে সঙ্গেই বুঝতে পেরেছে, দোষ আসলে ইব্রাহিমেরই। এমপিরা দার্শনিক প্রজাতির মানুষ, লাইসেন্স করা অস্ত্র যেখানে-সেখানে ফেলে যেতেই পারেন। সেই অস্ত্র নিয়ে তুই ব্যাটা নাড়াচড়া করে মরলে এমপির কী দোষ! দোষ হলে হবে বড়জোর এমপির গাড়িচালক আর চামচাদের। তারা সাধারণ মানুষ। সাধারণ মানুষেরা খুব খারাপ এ দেশে। পুলিশ তাই এদের গ্রেপ্তার করেছে, এমপিকে নয়। 
ইব্রাহিমের বউ এখন আবোল-তাবোল বললেও এমপির কিছু হবে না! এমপিরা এ দেশে কখনো কোনো হত্যাকাণ্ড ঘটাননি। আজ পর্যন্ত কোনো আদালত তার প্রমাণ দিতে পারবেন না। যত দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী হোন না কেন, এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর তাঁরা যাদুবলে সাধুপুরুষ হয়ে যান। এখন যদি কেউ প্রশ্ন তোলে, পিস্তলে এমপির হাতের ছাপ ছিল কি না, বুঝতে হবে, সেও যড়যন্ত্রকারী। কিংবা যুদ্ধাপরাধীর দোসর! 
এমপিরা মাঝেমধ্যে চড়-থাপড় দেন বটে, ওসি-ডিসি, কন্ট্রাক্টর-ব্যবসায়ী এমনকি শিক্ষকদের গায়েও হাত তোলেন তাঁরা মাঝে মধ্যে। কিন্তু বুঝতে হবে, এটি দেশের ভালোর জন্যই। এমপিদের সঙ্গে বেয়াদবি করে, তাদের কোনো নির্দেশ না মেনে দেশের উন্নতি হবে কী করে! কারা খুনি, কোন মামলা নিতে হবে, কোন ব্যবসায়ী কাজ পাবে, প্রশাসন কীভাবে চালাতে হয় তা এমপিদের চেয়ে ভালো কেউ বোঝে নাকি? যদি বুঝত তাহলে তারাই তো এমপি হতো! ঠিক কি না? তো এসব যারা বুঝবে না তারা যে সামান্য চড়-থাপড়ে পার পাচ্ছে এটাও তো অনেক! 
এমপিরা মহাজ্ঞানীও। সরকারি দলের এমপিরা আরও জ্ঞানী। তাঁরা আইনবেত্তার চেয়ে ভালো আইন বোঝেন, চিকিত্সকের চেয়ে বেশি চিকিৎসা বোঝেন, ইতিহাসবিদদের চেয়ে বেশি ইতিহাস বোঝেন, আমলাদের চেয়ে বেশি প্রশাসন বোঝেন। তাঁরা সর্বজ্ঞানী! তবে তাঁদের চেয়ে বড় জ্ঞানী কেউ নেই তা নয়। প্রধানমন্ত্রী আছেন। বিরোধী দলের এমপিদের জন্য বিরোধী দলের নেত্রী আছেন। তাঁদের কোনো কথার সামান্য নড়চড় করেন না তাই এমপিরা! আমরা সাধারণ মানুষ, আমাদের কথা শোনার মতো বোকা নন তাঁরা। 
এমপি-মন্ত্রী-হর্তাকর্তারা সব গুণে গুণী। সব দোষের ঊর্ধ্বে তাঁরা। এমন পোড়া দেশে এই অসামান্য সত্য বুঝতে না পারলে দোষ আমাদেরই। 

৩. 
আমরা সাধারণ মানুষ। আমাদের আরও দোষ আছে। সামান্য ট্রাফিক জ্যামে দুই-তিন ঘণ্টা দেরি হলে আমরা অধৈর্য হয়ে উঠি। মানুষে মানুষে কিলবিল করা আমাদের দেশ! যারা রাস্তাঘাট-গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানি কিছুই পাচ্ছে না তারা তো কোনো চেঁচামেচি করে না? সুবোধ বালকের মতো তারা অন্ধকারে রাত কাটায়, ‘বায়োগ্যাসে’ রান্না করে, পচা পানি খেয়ে হজম করে। তারা ভোটের দিন ভোট দেয়, দলবেঁধে জনসভায় যায়, মনের সুখে প্রজননচর্চা করে, অসুখ হলে শান্তভাবে ইন্তেকাল করে। 
সমস্যা আমাদের শহরের সাধারণ মানুষদের। আমরা গ্রামের মানুষের মতো সুনাগরিক হতে পারি না, রথী-মহারথীদের মতো সুশীলও হতে পারি না। ট্রাফিক জ্যামে ল্যাপটপ খুলে গাড়িতে অফিস করার যোগ্যতা নেই আমাদের। জেনারেটর কিনে বিদ্যুৎ সমস্যা দূর করার সামর্থ্য নেই, গ্যাস যায় না এমন জায়গায় থাকার ক্ষমতা নেই, দ্রব্যমূল্য বাড়লে বেশি দামে দ্রব্য কেনার বুদ্ধি নেই। শহরে ভিড় বাড়লে প্যারিস-লন্ডন এমনকি ব্যাংককে যাওয়ার মুরোদ নেই! আমাদের সব চাওয়া কেবল সরকারের কাছে। সেখানে একটা হেরফের হলে আমরা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠি, ভাঙচুর শুরু করে দিই। আরে, দ্রব্যমূল্য-বিদ্যুৎ-গ্যাসের সমস্যা তো আগের সরকারের তৈরি! আগের সরকারের আমলেরটা তার আগের সরকারের তৈরি। এই সামান্য সত্যটা বুঝতে পারি না আমরা। রেগে গিয়ে একবার একে আরেকবার ওকে ক্ষমতায় বসাই আমরা। কারও ভিশন-মিশন বোঝার ধৈর্য পর্যন্ত নেই আমাদের। 
আমাদের সবচেয়ে বড় অযোগ্যতা বোঝার ক্ষেত্রে। আমরা বুঝতে চাই না গ্যাস-বিদ্যুৎ-দ্রব্যমূল্য কিংবা কোমলমতিদের খুনোখুনি নিয়ে সরকারকে পড়ে থাকলে চলে না। বাঙালি জাতিকে উদ্ধারে কার কী অবদান, কোন চেতনা কীভাবে পুনরুদ্ধার করা যায়, কোন দেশের দালালদের কীভাবে ঠেকানো যায়, দেশ রক্ষার্থে কাকে হামলা, কার বিরুদ্ধে মামলা করা যায়, এ ধরনের কত উঁচুমার্গীয় চিন্তায় দিন কাটে আমাদের রথী-মহারথীদের! আমরা ছাপোষা মানুষ। এসব না বুঝে খামাখাই সরকারের ওপর রুষ্ট হই আমরা। 
আমরা খানিকটা ইতর প্রজাতিরও। আমাদের উদ্ধারের চিন্তায় সারা শহর নিশ্চল করে দিয়ে দামি গাড়িবহরে ছুটে বেড়ান হর্তা-কর্তা মহাজনেরা। তবু কেন রাগে মাথা খারাপ হয় আমাদের, মনের মুখে ফোটে অশ্রাব্য শব্দাবলি? 
আমাদের আসলে বুঝতে হবে, তারা সাধু, আমরাই শয়তান। 
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।