পৃষ্ঠাসমূহ

মঙ্গলবার, ৬ নভেম্বর, ২০১২

বিএনপির আসল চ্যালেঞ্জ

 আসিফ নজরুল | তারিখ: ০৭-১১-২০১২

বিএনপি সম্পর্কে বিদেশিদের আপত্তি প্রধানত দুটো। এক. বিএনপির আমলে জঙ্গিবাদী রাজনীতির প্রসার ঘটে। দুই. বিএনপির শেষ আমলে ভারতীয় বিভিন্ন বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীকে প্রশ্রয় দেওয়া হয়েছিল। প্রথম কারণে বিএনপির প্রতি রুষ্ট ছিল আমেরিকা, ইউরোপ আর ভারত। দ্বিতীয় কারণে প্রধানত ভারত। গত আমলে বিএনপির সরকার কোনো এক বিচিত্র কারণে তাইওয়ানের একটি বাণিজ্যিক অফিস খোলার অনুমতি দিলে বিএনপির ‘ন্যাচারাল এলাই’ চীনও রুষ্ট হয়ে ওঠে। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার সম্পর্ক অটুট রাখতে পেরেছিল কেবল পাকিস্তান, সৌদি আরবসহ মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে, আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক অঙ্গনে যাদের প্রভাব ক্রমেই ক্ষীয়মাণ। বিএনপি তাই এখন মরিয়া হয়ে উঠেছে প্রভাবশালী আন্তর্জাতিক মহলের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের জন্য। ভবিষ্যতে ক্ষমতায় যেতে হলে শুধু জনসমর্থন যথেষ্ট নয়, এদের সহায়তাও লাগবে, এটা বিএনপির উপলব্ধি না করার কথা নয়।
শক্তিশালী প্রতিবেশী ও মুরব্বিদের উপেক্ষা করে এই যুগে ক্ষমতায় থাকার বা ক্ষমতায় আসার নজির কম। ইরানে আহমাদিনেজাদ আর উত্তর কোরিয়ার কিম ইল সুংয়ের পরিবার তা পারছেন শক্ত জাতীয় ঐক্য, আদর্শবাদ আর মোটামুটি স্বনির্ভর অর্থনীতির কারণে। ভেনেজুয়েলায় হুগো চাভেজ পারছেন গোটা লাতিন আমেরিকায় মার্কিন সাম্রাজ্যবাদবিরোধী মনোভাব এবং তেলনির্ভর অর্থনীতির শক্তির কারণে। কিউবা টিকে আছে মূলত ফিদেল কাস্ত্রোর ব্যক্তিত্ব আর কিউবাবাসীর কৃচ্ছ্রমূলক আত্মত্যাগের কারণে। এই দেশগুলোর ওপরও খবরদারির চেষ্টা চলছে নিরাপত্তার নানা অজুহাতে। পারমাণবিক অস্ত্র থাকার কারণে উত্তর কোরিয়া তা উপেক্ষা করে চললেও অন্যদের পক্ষে সেটি আরও বহু বছর পর্যন্ত হয়তো সম্ভব হবে না।
আগে একটা সময় ছিল যখন আন্তর্জাতিক আধিপত্যবাদের মূল কারণ ছিল অর্থনৈতিক—জ্বালানি, অস্ত্র, অবকাঠামোভিত্তিক ব্যবসা আর আন্তর্জাতিক পুঁজির আধিপত্য বিস্তার। সোভিয়েত যুগে রাজনৈতিক আদর্শের আধিপত্যের লড়াইও জোরদার ছিল। এখন নাইন-ইলেভেনের পর আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অন্যতম নির্ণায়ক হয়ে উঠেছে নিরাপত্তা ইস্যু। জাতীয়, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক নিরাপত্তা একই সূত্রে গাঁথা, এই তত্ত্ব দুর্বল দেশগুলোতে আন্তর্জাতিক খবরদারির একধরনের নৈতিক যৌক্তিকতা সৃষ্টি করেছে। বিএনপির সরকারের আমলে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ বা ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের প্রশ্রয় প্রদান বাংলাদেশের রাজনীতিতে আন্তর্জাতিক খবরদারির সুযোগকে আরও প্রসারিত করেছে এবং একই সঙ্গে বিএনপিকে মিত্র হিসেবে অগ্রহণযোগ্য করে তুলেছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে খালেদা জিয়ার জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে বিএনপিকে উদার না হোক, অন্তত মধ্যপন্থী গণতান্ত্রিক দল হিসেবে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলা।
খালেদা জিয়ার গত বছরের আমেরিকা সফর এ ক্ষেত্রে তেমন কোনো সাফল্য বয়ে আনতে পারেনি। তিনি প্রভাবশালী কোনো মার্কিন নেতার সাক্ষাৎ পর্যন্ত লাভ করতে পারেননি। কিন্তু ২০১২ একটি ভিন্ন বছর হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে বাংলাদেশের রাজনীতিতে। এ বছর বিএনপির বিভিন্ন কর্মসূচিতে বিশাল জনসমাগম, দুর্নীতি, আইনশৃঙ্খলা ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সরকারের একের পর এক ব্যর্থতা, ভারত বাদে বাকি প্রায় সব প্রভাবশালী আন্তর্জাতিক মহলের সঙ্গে সরকারের সম্পর্কের অবনতিসহ বিভিন্ন কারণে আন্তর্জাতিক বিশ্বে দুই দলের গ্রহণযোগ্যতা কিছুটা হলেও পরিবর্তিত হয়েছে। এ বছর প্রণব মুখার্জির সফরের সময় ভারত কোনো দলের সঙ্গে নয়, বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্বে বিশ্বাসী—এই মন্তব্য ছিল তার একটি বড় প্রমাণ। খালেদা জিয়া ভারত সফরের আমন্ত্রণ পেয়েছিলেন তখনই। ভারতে যাওয়ার আগে তিনি চীন সফর করলেন, এটা কৌশলগতভাবে ভুল কি না, তা নিয়েও আলোচনা ছিল।
খালেদা জিয়ার চীন সফর অবশ্য অসফল হয়নি। চীন বিএনপির সরকারের আমলে সড়ক, সেতু এবং বিভিন্ন অবকাঠামো উন্নয়নে লক্ষণীয় ভূমিকা রেখেছিল। বিএনপির নেত্রী ভবিষ্যতে যে চারটি ক্ষেত্রে চীনের অর্থনৈতিক ও কারিগরি সহায়তা চেয়েছেন, তা জাতীয় প্রবৃদ্ধির জন্য আরও গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। প্রথম পদ্মা সেতুর অনিশ্চয়তার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি দ্বিতীয় পদ্মা সেতু নির্মাণ, সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ, মিয়ানমারের ভেতর দিয়ে চীনের কুনমিংয়ের সঙ্গে সড়ক ও রেল-যোগাযোগ এবং দেশের ভেতরের সড়ক কাঠামোর সার্বিক ও সমন্বিত উন্নয়নের জন্য চীনা সহযোগিতার আশ্বাস পেয়েছেন। সহযোগিতার সঠিক ক্ষেত্র নির্ধারণ এবং তাতে চীনা আশ্বাসপ্রাপ্তিই আপাতত তাঁর বড়
সাফল্য। তবে তাঁর চীন সফর ভারত কী চোখে দেখছে, তা পর্যবেক্ষক মহলের কাছে ছিল কৌতূহলের বিষয়।
আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, ভারত স্বতন্ত্রভাবেই খালেদা জিয়ার সফরকে মূল্যায়ন করেছে। ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ‘আর কখনো’ বাংলাদেশের মাটি ব্যবহার করতে না দেওয়া-সংক্রান্ত খালেদা জিয়ার ঘোষণা ভারতীয় নীতিনির্ধারকদের জন্য সবচেয়ে আশাপ্রদ বিষয় বলে বিবেচিত হচ্ছে। খালেদা জিয়ার এই ঘোষণায় প্রচ্ছন্নভাবে হলেও ভুলের স্বীকারোক্তি আছে বলে তা আন্তরিক বলে অনেকে মনে করছেন। ভারতীয় শিক্ষাবিদ ও নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে আমার সামান্য আলোচনার অভিজ্ঞতা থেকে জানি, বাংলাদেশের কাছে ভারতের সবচেয়ে বড় প্রত্যাশা এটিই। বিচ্ছিন্নতাবাদ শুধু ভারতের অখণ্ডতার জন্য হুমকি নয়, এটি ভারতের সামরিক ব্যয় এবং কৌশলগত অনিশ্চয়তাও বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়। ভারত নিজেও একসময় বাংলাদেশের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের প্রশ্রয় দিয়েছিল। শেখ হাসিনার প্রথম আমলে পার্বত্য চুক্তির পর অবস্থা পরিবর্তন হলেও পরের বিএনপির আমলে কেন এই সর্বনাশা খেলায় বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার মেতে উঠেছিল, কারা এতে জড়িত ছিল, তা বিএনপির নেত্রীর গভীরভাবে খতিয়ে দেখা উচিত। পুনরায় ক্ষমতায় এলে ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদী এবং জঙ্গিদের উত্থানের পেছনে বিএনপি বা জামায়াতের যে অংশের মদদ ছিল, তাদের ক্ষমতাবলয় থেকে দূরে রাখা এবং প্রয়োজনে কঠোরভাবে দমন করার মতো দৃঢ়তা তাঁর অবশ্যই থাকা উচিত।
ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের এই বিষফোড়ার সমাধান কঠিন কাজ নয়। এ জন্য স্রেফ আন্তরিকতাই যথেষ্ট। দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে অন্যান্য ইস্যুর সমাধান বরং অনেক জটিলতাপূর্ণ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার সর্বোচ্চ আন্তরিকতা সত্ত্বেও সীমান্তে হত্যাকাণ্ড, অভিন্ন নদীর পানি ভাগাভাগি এবং ট্রানজিট সমস্যার সমাধান করতে পারেনি। সম্ভবত তাঁর সরকারের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা ছিল একতরফাভাবে প্রথমেই প্রায় সবকিছু প্রদান করা, ব্যক্তি সম্পর্ক আর রাষ্ট্রীয় সম্পর্কের বিস্তর ব্যবধান বোঝার অক্ষমতা এবং অন্য প্রভাবশালী আন্তর্জাতিক মহলগুলোর সঙ্গে সম্পর্কের গুরুত্বকে খাটো করে দেখা। প্রশ্ন হচ্ছে, তুলনামূলকভাবে অগভীর মৈত্রী সম্পর্ক নিয়ে বিএনপির সরকার কি পারবে এসব ক্ষেত্রে দেশের স্বার্থ রক্ষা করতে? এসব ইস্যুতে আওয়ামী লীগ সরকারের নিরন্তর সমালোচনার পর ভারতের কাছ থেকে শ্রেয়তর কোনো সমাধান অর্জনের কর্মকৌশল কি রয়েছে বিএনপির? একই সঙ্গে দেশের স্বার্থ এবং ভারতের সঙ্গে সত্যিকারের বন্ধুত্ব রক্ষা করার ক্ষেত্রে আজ পর্যন্ত বাংলাদেশের কোনো
সরকার উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করতে পারেনি। বিএনপি কেন তা পারবে, সেটি পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করতে না পারলে ভারত ও ভোটার—দুই পক্ষই সন্দিহান থাকবে তাদের প্রতি।
তার আগে বিএনপিকে নিশ্চিত করতে হবে যে আগামী নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এ জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার না হলেও অন্তত গ্রহণযোগ্য কাঠামোর একটি সর্বদলীয় সরকার এবং নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের দাবি বিএনপিকে আদায় করতে হবে। অবস্থাদৃষ্টে এটি পরিষ্কার যে রাজপথে তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলে সরকারকে বাধ্য না করাতে পারলে এই দাবিগুলো আদায় করা যাবে না। জনমত এখন বিএনপির পক্ষে হয়তো রয়েছে, কিন্তু তাকে যৌক্তিক পরিণতির দিকে নিয়ে যাওয়ার মতো সাংগঠনিক ও নেতৃত্বের দৃঢ়তা বিএনপির আছে কি? ২১ নভেম্বর সমাবেশের পর থেকে আন্দোলন তীব্রতর করার দিকে বিএনপি এগোতে থাকলে মামলা-হামলাসহ নানা ধরনের দমনমূলক পদক্ষেপ সরকার গ্রহণ করতে পারে। বিএনপিকে কোনোভাবেই ক্ষমতায় আসতে না দিতে সরকার মরিয়া হয়ে উঠলে রাজপথে অরাজকতামূলক পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। আশঙ্কা রয়েছে যে এমন অবস্থায় গণতন্ত্র এবং আগামী নির্বাচন পর্যন্ত বিপন্ন হতে পারে।
যতই ঝুঁকি থাক, জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠানের দাবি আদায়ের জন্য আগামী কয়েক মাসই সম্ভবত শেষ সুযোগ বিএনপির জন্য। এ সময় সরকার বসে থাকবে না। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন করে, ভারতের সঙ্গে তিস্তা চুক্তি সম্পাদন করে, শেয়ারবাজার চাঙা করে এবং কিছু দুর্নীতির বিষয়ে ব্যবস্থা নিয়ে শেষ সময়ে জনসমর্থন পুনরুদ্ধারের চেষ্টা সরকার করবে। একই সঙ্গে ১০ ট্রাক অস্ত্র, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা ও জিয়া অরফানেজ মামলায় কিছু বিচারিক পদক্ষেপ গ্রহণ করে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বকে চাপে ফেলার চিন্তাও সরকারের থাকবে।
‘ভারত জয়’ মানেই তাই ক্ষমতায় চলে আসা নয়। আমেরিকার আশীর্বাদ মানেও ক্ষমতার কাছাকাছি চলে যাওয়া নয়। বিএনপি নির্বাচনে জিতে এসে এ দুটো দেশের প্রতি হুমকিস্বরূপ কোনো কাজ করবে না, এই নিশ্চয়তা সৃষ্টি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের একটি শর্ত মাত্র। কিন্তু এটি সম্ভব করার আসল কাজটি করতে হবে দেশের জনগণকে সঙ্গে নিয়ে। বিএনপি যদি আগামী কয়েক মাসে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তুলতে পারে, বিএনপি ও তার জোটের মৌলবাদী ও হঠকারী গোষ্ঠীকে যদি খালেদা জিয়া কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেন, সরকারের পরিবর্তন হলে আগের আমলের ভুলগুলোর পুনরাবৃত্তি হবে না—এমন বিশ্বাস যদি তিনি মানুষের মনে স্থাপন করতে পারেন, তা হলেই কেবল বিএনপি পুনরায় ক্ষমতায় আসতে পারে। তা না হলে খালেদা জিয়ার বিদেশ সফরের সাফল্য কাগুজে সাফল্য হিসেবেই থেকে যাবে।
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

শুক্রবার, ৬ জুলাই, ২০১২

সেতু নয়, আগে মানসম্মান বাঁচান



আসিফ নজরুল

আশির দশকে বিশ্বকাপে ম্যারাডোনার লাল কার্ড প্রাপ্তিতে ক্ষুব্ধ ফুটবলপাগল দর্শক ঢাকার রাস্তায় স্লোগান দিয়েছিল—ফিফার চামড়া তুলে নেব আমরা। সে তুলনায় বিশ্বব্যাংক কর্তৃক পদ্মা সেতুর অর্থায়ন বাতিল আরও ভয়ংকর বিষয়। আগের সংস্কৃতি অব্যাহত থাকলে বিশ্বব্যাংকের চামড়া তুলে ফেলার স্লোগান তাই হয়তো শোনা যেত ছাত্রলীগ বা যুবলীগের মিছিলে। তাদের ‘অমার্জনীয় ব্যর্থতা’ অবশ্য কিছুটা পুষিয়ে দিয়েছেন মতিয়া চৌধুরীসহ আমাদের কয়েকজন মন্ত্রী এবং কিছু বিশ্লেষক। তাঁদের বক্তব্য, বিশ্বব্যাংকের নিজের কার্যক্রমই প্রশ্নবিদ্ধ, অস্বচ্ছ ও দুর্নীতিগ্রস্ত। পদ্মা সেতু প্রকল্পে ঋণচুক্তি বাতিল করে ১৬ কোটি মানুষকে অপমান করেছে বলে বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে বরং সোচ্চার হওয়া উচিত আমাদের। ৪ জুলাই প্রধানমন্ত্রী নিজেও বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তুলেছেন।
এমন কথা সিপিবি, বদরুদ্দীন উমর বা আনু মুহাম্মদ বললে তা আদর্শিক অবস্থান থেকে বলা ধরে নিতে হবে। অন্য অনেকে এসব বলেন সম্ভবত দলকানা হওয়ার কারণে, কিংবা বিশ্বব্যাংক আর সরকারের পারস্পরিক মাপ বোঝার অক্ষমতার কারণে বা নিজেদের অপরাধ ঢাকার জন্য। তাঁদের বক্তব্য অসত্য নয়, কিন্তু এসব বক্তব্যের কার্যকরণের মধ্যে সমস্যা রয়েছে। বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে যে তারা পছন্দসই প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়ার জন্য লবিং করে থাকে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে ব্যাংকের কেউ দুর্নীতি করে থাকতে পারে, বিশ্বব্যাংকের পরিচালনা কাঠামো অগণতান্ত্রিক ও অস্বচ্ছ, বিশ্বব্যাংক দেশের সম্পদকে আন্তর্জাতিক পুঁজির অধীন করে ফেলে, উন্নয়ন সাহায্যের নানা শর্ত জুড়ে দেয়, তাদের শর্ত (বিশেষ করে ভর্তুকি প্রত্যাহার ও পরিবেশবিরোধী বড় অবকাঠামো নির্মাণ) পালন করতে গিয়ে দক্ষিণ আমেরিকা ও আফ্রিকার অনেক দেশকে বিপদে পড়তে হয়েছে।
এসব সমালোচনা সত্যি হলেও বাংলাদেশের যেসব শাসকগোষ্ঠী যুগের পর যুগ বিশ্বব্যাংক ও সমগোত্রীয়দের নির্দেশনা মেনে দেশ চালিয়েছে তাদের পক্ষ থেকে করা যৌক্তিক নয়। দুর্নীতির অভিযোগে বিশ্বব্যাংক কর্তৃক ঋণ বাতিল করার প্রতিক্রিয়া হিসেবে এসব সমালোচনা সময়োপযোগীও নয়। সরকারের পক্ষ থেকে এমন সমালোচনা আরও মারাত্মক পরিণতি বয়ে আনতে পারে। বিশ্বব্যাংক এখনো বাংলাদেশে বহু প্রকল্পে অর্থায়ন করছে, বিশ্বব্যাংকের অনুজপ্রতিম প্রতিষ্ঠান এডিবি এবং এর ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে যেসব উন্নয়ন অংশীদার প্রতিষ্ঠান কাজ করে থাকে, তাদেরও বহু প্রকল্প আছে বাংলাদেশে। একজন আবুল হোসেনের দুর্নীতি নিয়ে প্রশ্ন তোলার প্রতিক্রিয়া হিসেবে যদি ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানকে দুর্নীতির অভিযোগ শুনতে হয় স্বয়ং সরকারপ্রধানের কাছ থেকে, তাহলে দাতাগোষ্ঠীকে আরও বড়ভাবে মোকাবিলা করার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে বাংলাদেশকে।
সেই সামর্থ্য কি আছে বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের?

২.
বিশ্বব্যাংক নিয়ে বিভিন্ন আলোচনায় চীন বা ভারতের প্রসঙ্গ এসেছে। কিন্তু বাংলাদেশ চীন বা ভারত নয়। এ দুটো দেশেও দুর্নীতির অভিযোগ আছে, কিন্তু বাংলাদেশের তুলনায় তা অনেক কম। তা ছাড়া চীন বা ভারতে ক্ষমতাসীন মন্ত্রীরা পর্যন্ত দুর্নীতি প্রমাণিত হলে চাকরি হারান, বিচারের সম্মুখীন হন, বাংলাদেশে তা কখনো হয় না। চীন-ভারতের অর্থনীতি, সরকারি ব্যবস্থাপনা, প্রযুক্তিগত এবং কৌশলগত সক্ষমতা বাংলাদেশের চেয়ে বহু গুণে মজবুত। নিজের অর্থায়নে পদ্মা সেতুর চেয়েও অনেক বড় প্রকল্প করার ক্ষমতা আছে তাদের। এরা বিশ্বব্যাংককে ঋণচুক্তি বাতিল করার হুমকি দিয়ে ঋণের শর্তাবলি পরিবর্তন করার ক্ষমতা রাখে। চীন বা ভারতের তুলনায় বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে দর-কষাকষির ক্ষমতা নগণ্য বাংলাদেশের।
বাংলাদেশের যদি পর্যাপ্তভাবে এই ক্ষমতা থাকত কিংবা সরকার যদি পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের খবরদারি অগ্রহণযোগ্য বলে জনগণের কাছে প্রমাণ করতে পারত, তাহলে সরকার ব্যাংকটির সমালোচনায় মুখর হলে তা মানানসই হতো। কিন্তু সে ক্ষমতা বাংলাদেশের নেই। সরকার বিশ্বব্যাংকের সমালোচনায়ও নেমেছে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর। আমাদের প্রধানমন্ত্রী নিজে সমালোচনা করছেন দুর্নীতিকে প্রকারান্তরে প্রশ্রয় দেওয়ার জন্য বিশ্বব্যাংক কর্তৃক অভিযুক্ত হওয়ার পর। কাজেই এখন বিশ্বব্যাংকের সমালোচনা করে নায়কোচিত কোনো ইমেজ গড়ে তোলা দূরের কথা, দেশে এবং বিদেশে নিজের সম্মান বাঁচানোই কঠিন হবে সরকারের জন্য।
বিশ্বব্যাংক ঋণচুক্তি বাতিলের আগেই সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন ও অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত করলে সরকারের এমন সম্মানহানি হতো না। এ ধরনের তদন্ত যে হয়নি তার বিভিন্ন আলামত রয়েছে। তদন্ত চলাকালে সরকারের কর্তাব্যক্তিদের কর্তৃক দুর্নীতি হয়নি বলে হাঁকডাক প্রদান, তড়িঘড়ি তদন্ত করে দুদক কর্তৃক মন্ত্রীকে দুর্নীতিমুক্ত সার্টিফিকেট প্রদান, বিশ্বব্যাংক কর্তৃক আরও তথ্য প্রদানের পর নজিরবিহীনভাবে দুদকে সাংবাদিকদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করে তথ্য গোপনের চেষ্টা, ঘুষ গ্রহণের প্রস্তাব কোনো অপরাধ নয় বলে অসত্য প্রচারণা (পেনাল কোডের ১৬২ ও ১৬৩ ধারায় এটি শাস্তিযোগ্য ফৌজদারি অপরাধ) পদ্মা সেতু প্রকল্পে তদন্তের বিশ্বাসযোগ্যতা ক্ষুণ্ন করেছে।
তা ছাড়া আমাদের মনে রাখতে হবে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে বর্তমান সরকারের কমিটমেন্ট নিয়ে এমনিতেই সন্দেহ পোষণ করার নানা কারণ রয়েছে। সরকার ও সরকারি দলের নেতাদের বিরুদ্ধে আগের আমলে করা দুর্নীতির অসংখ্য মামলা ঢালাওভাবে প্রত্যাহার, প্রতিশ্রুতি থাকা সত্ত্বেও মন্ত্রী ও সাংসদদের সম্পত্তির বার্ষিক বিবরণী প্রকাশ না করা, শেয়ার মার্কেটে লুটপাট ঘটনায় একজন মন্ত্রীর পরিবার ও সরকারি দলের কয়েকজন নেতার সংশ্লিষ্টতার অভিযোগের বিচার না করা, কুইক রেন্টাল পদ্ধতিতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে দুর্নীতির দায়মুক্তি আইন পাস করা, প্রকিউরমেন্ট রুল সংশোধন করে বিনা বিবেচনায় দুই কোটি টাকা পর্যন্ত প্রকল্পের কাজ পাওয়ার ব্যবস্থা করা, প্রতিবছর বাজেটে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দিয়ে দুর্নীতির মাধ্যমে উপার্জিত অর্থ আড়াল করার সুযোগ দেওয়া, দুদককে ক্রমাগতভাবে দুর্বল ও পরাধীন করার প্রচেষ্টাসহ নানা দুর্নীতিবান্ধব পদক্ষেপ বর্তমান সরকার গ্রহণ করেছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে সৈয়দ আবুল হোসেনের মতো একজন প্রভাবশালী মন্ত্রীর বিরুদ্ধে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে উত্থাপিত দুর্নীতির অভিযোগ সরকার নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করবে, তা বিশ্বাস করাই ছিল কষ্টকর। সরকার সেই বিশ্বাস পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে পারেনি।

৩.
সৈয়দ আবুল হোসেনের মতো একজন অতিবিতর্কিত ব্যক্তিকে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব প্রদানও দুর্নীতিবান্ধব পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচনা করার কারণ রয়েছে। দ্বিতীয় শ্রেণীর একজন কর্মচারী থেকে আবুল হোসেন প্রায় রাতারাতি অর্থের পাহাড় গড়েছেন, অসাধুতার কারণে শেখ হাসিনার প্রথম আমলে তাঁকে মন্ত্রিত্ব থেকে বিতাড়িত হতে হয়েছিল, সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত মরিয়ার্টির গোপন তারবার্তায় সরকারি কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে তাঁর সততা প্রশ্নবিদ্ধ বলে বর্ণনা করা হয়েছিল। এমন একজন দুর্নীতিবাজ হিসেবে ধারণাকৃত ব্যক্তিকে কেন হাজার কোটি টাকা প্রকল্পের কাজ হবে এমন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, কেন এসব প্রকল্প ব্যবস্থাপনার সঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলের আত্মস্বীকৃত দুর্নীতিবাজদের সংশ্লিষ্ট রাখা হয়েছিল, স্বার্থসংঘাত (কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট) রয়েছে সাকো ইন্টারন্যাশনাল নামের সেই প্রতিষ্ঠান তার পরিবারের মালিকানাধীন থাকা অবস্থায় কীভাবে তিনি যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করতে পারেন, এ নিয়ে নানা প্রশ্ন আগে থেকেই ছিল। পরে তাঁকে বিজ্ঞান এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়ার পর বেশি অর্থ রয়েছে, এমন একটি খাতের (টেলিযোগাযোগ খাত) সঙ্গে যুক্ত করার উদ্যোগও ছিল সন্দেহজনক।
সরকার তাঁর বিভিন্ন সন্দেহজনক কর্মকাণ্ড আড়াল করার জন্য বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে একধরনের সমালোচনার জিহাদে নেমেছে এবং একই সঙ্গে জাতীয়তাবাদী চেতনা উসকে দিয়ে প্রয়োজনে নিজের অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের আবেগকম্পিত ঘোষণা দিচ্ছে। ৩২ কোটি হাত দিয়ে বা এক বেলা বাজার করার অর্থ বাঁচিয়ে পদ্মা সেতু নির্মাণ করার কথা বলা হচ্ছে। এসব আহ্বান দিচ্ছেন এমন সব মন্ত্রী বা নেতা, জনগণের কাছে যাঁদের নিজস্ব সততাই প্রশ্নবিদ্ধ। নানা কারণে দেশে-বিদেশে সমালোচিত সরকারের একচ্ছত্র নেতা হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অবস্থানও আগের তুলনায় অনেক দুর্বল এখন।
সবকিছু মিলিয়ে আমার মনে হয় না, সরকারের আহ্বানে এই প্রকল্প বাস্তবায়নে দেশের জনগণ বা প্রবাসীরা অংশ নিতে ঝাঁপিয়ে পড়বে এই অবস্থা রয়েছে দেশে। পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন দূরের কথা, দুর্নীতির অভিযোগে ক্ষতবিক্ষত সরকারের মানসম্মান বাঁচানোই বরং কঠিন হয়ে পড়ছে এখন। বিশেষ করে, আবুল হোসেনের মতো প্রশ্নবিদ্ধ একজন ব্যক্তি কেন এত অপরিহার্য এবং মূল্যবান সরকারের কাছে—এই অমোঘ প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না সরকারের পক্ষে। তাঁর মতো একজন ব্যক্তি তখনই অপরিহার্য হতে পারে, যদি তাঁর অপসারণ আরও বড় দুর্নীতিবাজদের ভিত নাড়িয়ে দিতে পারে এমন আশঙ্কা থাকে বা যদি মন্ত্রী হিসেবে তাঁর অবস্থান দুর্নীতি অব্যাহত রাখার স্বার্থে খুব প্রয়োজনীয় বলে বিবেচিত হয়।

৪.
পদ্মা সেতু প্রকল্প নিয়ে ভবিষ্যতে আরও বহু অস্বস্তিকর তথ্য ও বিশ্লেষণ আমরা পেতে পারি। বিশ্বব্যাংক, এডিবি, জাইকা, কানাডা সরকারসহ আন্তর্জাতিক মহল জড়িত হয়ে পড়ায় এই প্রকল্প নিয়ে তথ্য গোপন করা সম্ভব হবে না কারও পক্ষে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত হওয়ার পর বিশ্বব্যাংকও তার শক্তিশালী প্রচারণা কাঠামোকে থামিয়ে রাখবে বলে মনে হয় না। পরিস্থিতি খুব কঠিন হয়ে যাওয়ার আগে সরকারকে ধীরস্থিরভাবে বাস্তবতা বিবেচনা করতে হবে। আবুল হোসেনকে নিজে থেকে পদত্যাগ করার মেসেজ দিয়ে সরকার নিজের ইমেজ পুনরুদ্ধারের জন্য একটি ইতিবাচক সূচনা করতে পারে।
সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ এখন নিজেকে দুর্নীতিমুক্ত প্রমাণ করা এবং এভাবে নিজের মানসম্মান পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা। সেটি করা সম্ভব হলে বিশ্বব্যাংক না থাকলেও পদ্মা সেতু নির্মাণে সমস্যা হবে না। সরকারকে বুঝতে হবে, এই চ্যালেঞ্জ এড়িয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই আর।
 আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

শনিবার, ২৩ জুন, ২০১২

মন্ত্রীরা কখনো দুর্নীতি করেন না!


বিষয়বুদ্ধির তোড়ে আমরা তাদের তাড়িয়ে দিতে পারলাম। এই দুঃখ রাখি কোথায়?
বিষয়বুদ্ধির তোড়ে আমরা তাদের তাড়িয়ে দিতে পারলাম। এই দুঃখ রাখি কোথায়?
আসিফ নজরুল

বাংলাদেশে গালভরা নামের কিছু প্রতিষ্ঠান আগেও ছিল। এখন এর সংখ্যা বেড়েছে। এ দেশে মানবাধিকার কমিশন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তার কিছুদিনের মধ্যে ক্রসফায়ারের পরিবর্তে গুমের তাণ্ডব শুরু হয়েছে। তথ্য কমিশন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সরকারের তথ্য গোপনের সংস্কৃতি জোরদার হয়েছে। দুর্নীতি দমন ব্যুরো প্রায় এক যুগ হলো দুর্নীতি দমন কমিশনে পরিণত হয়েছে। সেই কমিশন সবচেয়ে বেশি আলোচিত হচ্ছে দুর্নীতি হয়নি এই সার্টিফিকেট দেওয়ার জন্য। যাকে-তাকে নয়, এই সার্টিফিকেট দেওয়া হয়েছে সেই মন্ত্রীদের, যাঁরা দুর্নীতি করেননি—এ কথা বিশ্বাস করার মতো লোক খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।
মানবাধিকার আর তথ্য কমিশন শৈশব অবস্থা অতিক্রম করছে। কিন্তু দুর্নীতি দমন কমিশন বা দুদক সম্পর্কে তা বলার উপায় নেই। দুদকের ইতিহাস বহু পুরোনো, এর শিকড় ১৯৪৩ সালে ইস্ট বেঙ্গল ফুড রেশনিং ব্যবস্থায় দুর্নীতির তদন্তের জন্য গঠিত এনফোর্সমেন্ট ব্রাঞ্চ পর্যন্ত বিস্তৃত। নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে ২০০৪ সালে আইনের মাধ্যমে এটি প্রায় স্বাধীন ও উল্লেখযোগ্য ক্ষমতাসম্পন্ন একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। সরকার চাইলে দুর্নীতি দমন কমিশন কতটা কর্মতৎপর হতে পারে, তা আমরা দেখেছিলাম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে। মাত্র কয়েক মাসে দুর্নীতিবাজদের জন্য এই কমিশন ত্রাসে পরিণত হয়েছিল। এ সময়ে দুদক একাই দেড় বছরে ৩৪১টি মামলা করেছিল, যার অধিকাংশ ছিল প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে। ১৫৬টি মামলায় তখন বিচার সম্পন্ন করে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের কারাদণ্ডে দণ্ডিতও করা হয়েছিল।
দুদকের সেই হাঁকডাক আর নেই। কমিশনের প্রধান নিজেই এই কমিশনকে দন্তহীন বাঘের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। ক্যাবিনেট কমিটি ২০১০ সালে কিছু আইনগত সংশোধনীর পক্ষে মত দিলে দুদক নামের বাঘের নখরও খসে পড়বে—এই আশঙ্কা ব্যক্ত করা হয়েছিল। সেই সংশোধনী আইনসভায় পাস হবে কি হবে না, এই দোলাচলে দুদক দীর্ঘদিন প্রায় স্থবির হয়ে ছিল। এর মধ্যে দুদকের নতুন সদস্যরা এসেছেন, কর্মকর্তা পর্যায়েও এমন কাউকে কাউকে নিয়ে আসা হয়েছে, যাঁদের সঙ্গে সরকারের ঘনিষ্ঠতার অভিযোগ রয়েছে। বড় দুর্নীতিবাজ দূরের কথা, পুলিশের সাধারণ কর্মচারীদের বিরুদ্ধে দুদকের তদন্ত এখন শেষ হয় না বছর পেরোলেও।

২.
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলের পরাক্রমশালী একটি প্রতিষ্ঠান এভাবে মুখ থুবড়ে পড়ল কেন? এর নানা ব্যাখ্যা নানাজন দিয়েছেন। আসলে পতনের বীজ রোপিত হয়েছিল এর উত্তরণকালেই। অভিযোগ আছে যে এক-এগারোর নেপথ্য নায়কেরা দুদক ও বিশেষ আদালতের মাধ্যমে যতটা দুর্নীতি দমনে আন্তরিক ছিলেন, তার চেয়ে বেশি আগ্রহী ছিলেন ঢালাওভাবে রাজনীতিবিদদের হেয় করতে। পদ্ধতি না মেনে তড়িঘড়ি মামলা দায়ের, আগ্রাসী তদন্ত, ঢালাওভাবে জামিন নাকচ, বিচারকালে অনিয়ম, রাজনীতিবিদের সন্তানদের নির্বিচারে গ্রেপ্তার ইত্যাদি ঘটনার মধ্য দিয়ে দুর্নীতিবিরোধী কার্যক্রম তখনই অনেকটা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে। এর পুরোপুরি সুযোগ গ্রহণ করেন মূলত সেই সব রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও আমলা, যাঁরা গত নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতার লাগাম হাতে ফিরে পান।
এক-এগারোর পর ক্ষমতায় এসে সরকার যেসব প্রতিষ্ঠানকে দুর্বল করার পদক্ষেপ গ্রহণ করে, সেসবের মধ্যে দুদক ছিল অন্যতম। ক্ষমতার প্রথম দুই বছরে সরকারের মন্ত্রীদের দুর্নীতির বড় কোনো খবর পত্রিকায় প্রকাশিত হয়নি। দুদকের শক্তি হ্রাস নিয়ে তাই তখন ব্যাপক উৎকণ্ঠা প্রকাশ করা হয়নি। কিন্তু গত এক বছরে দুর্নীতির কিছু অভিযোগ দেশে-বিদেশে আলোড়ন তোলার পর দুদকের ভূমিকা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন উত্থাপিত হচ্ছে। বিশেষ করে, দুর্নীতির দায়ে ব্যাপকভাবে অভিযুক্ত মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের বিষয়ে বিশ্বব্যাংক নির্দিষ্ট কিছু তথ্য দেওয়ার পর দুদকের কাছে এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ তার তলানিতে ঠেকানো ইমেজকে রক্ষা করা। দুদক কি পারবে তা? নাকি পূর্বসূরিদের মতো দুদকও এটিই প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করবে যে বাংলাদেশে বিদ্যমান সরকারের মন্ত্রীরা কখনো দুর্নীতি করেন না? দুদকও কি বলবে যে আগের সরকারের সবাই চোর হতে পারে, কিন্তু বর্তমান সরকারের সবাই সাধু!

৩. 
বর্তমান সরকারের মন্ত্রীদের মধ্যে প্রথম দুর্নীতির অভিযোগ আসে সম্ভবত মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রীর বিরুদ্ধে। অভিযোগকারী ছিলেন মন্ত্রণালয়েরই একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। তারপর পাটমন্ত্রী, তৎকালীন বাণিজ্যমন্ত্রী, নৌপরিবহনমন্ত্রী, জ্বালানি উপদেষ্টা, শিল্পমন্ত্রী, সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী, সাবেক রেলমন্ত্রীসহ বিভিন্ন মন্ত্রীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে বিভিন্ন পদক্ষেপ বা বিচ্যুতির মাধ্যমে দুর্নীতিবান্ধব একটি পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয়।
এমন পরিস্থিতির কিছু উদাহরণ দিই। প্রথমত, সরকারপ্রধান নির্বাচন চলাকালীন মন্ত্রী ও সাংসদদের সম্পত্তির বার্ষিক বিবরণী দেওয়ার ঘোষণা দেওয়ার পরও এ থেকে তাঁরা বিরত থাকেন। দ্বিতীয়ত, শেয়ারবাজারে লুটপাটের ঘটনায় একজন মন্ত্রীর পরিবার ও সরকারি দলের কয়েকজন নেতার সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ সরকারের গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে আসার পরও তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণে সরকার বিরত থাকে। তৃতীয়ত, বিনা টেন্ডারে বহুল বিতর্কিত কুইক রেন্টাল পদ্ধতিতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের কাজ সরকারের কাছের লোকজনকে প্রদান করার সন্দেহজনক কার্যক্রমকে তদন্তের ঊর্ধ্বে রাখার জন্য আগেই দায়মুক্তি আইন পাস করা হয়। চতুর্থত, প্রকিউরমেন্ট রুল সংশোধন করে বিনা অভিজ্ঞতা ও বিনা দক্ষতায় দুই কোটি টাকা পর্যন্ত প্রকল্পের কাজ পাওয়ার ব্যবস্থা করে সরকার তার লোকজনকে অবাধে কাজ পাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়। পঞ্চমত, টেলিকমিউনিকেশন অ্যাক্ট, ২০১০-এর মাধ্যমে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসির ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে মন্ত্রণালয়কে দিয়ে দেওয়া হয়। এর পরপরই দেশে অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসার হিড়িক পড়ার সংবাদ প্রকাশিত হতে থাকে, এর সঙ্গে অত্যন্ত প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ ওঠে। ষষ্ঠত, প্রতিবছর বাজেটে কালোটাকা সাদা করা এবং অবাধে বিনিয়োগ করার সুযোগ দিয়ে দুর্নীতির মাধ্যমে উপার্জিত অর্থ আড়াল করার বিশাল সুযোগ সৃষ্টি করা হয়।
রাষ্ট্রের যেসব প্রতিষ্ঠান দুর্নীতি নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারবে, সেখানেও চলে নানা হস্তক্ষেপ। যেমন, উচ্চ আদালতে নিয়োগ এবং নিম্ন আদালতে পোস্টিংয়ে দলীয়করণের ব্যাপক অভিযোগ ওঠে। সংসদের সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক কমিটির (যেমন, পাবলিক অ্যাকাউন্ট কমিটি বা অর্থ মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি) দায়িত্ব দেওয়া হয় দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের।
প্রতিষ্ঠান হিসেবে দুর্নীতি দমনে সবচেয়ে প্রত্যক্ষ প্রতিষ্ঠান দুদকের শক্তিও খর্ব করা হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে কমিশনের স্বাধীনতা ও তদন্তকালীন সক্ষমতা বৃদ্ধি করে এবং এর এখতিয়ার বাড়িয়ে (যেমন, মানি-লন্ডারিং অ্যাক্টের অধীনে অপরাধ তদন্ত করার ক্ষমতা) দুটো সংশোধনী অর্ডিন্যান্স আকারে গ্রহণ করা হয়। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসে সেগুলো নাকচ করে দেয়। এমনকি সরকার এমন কিছু সংশোধনীর উদ্যোগ নেয়, যা কার্যকর হলে দুদকের দুর্নীতি দমন অভিযান ম্রিয়মাণ হতে বাধ্য। যেমন, সংশোধনীতে প্রস্তাব করা হয় যে সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতির তদন্তের জন্য কমিশনকে সরকারের পূর্বানুমোদন নিতে হবে। এ ছাড়া প্রস্তাবিত সংশোধনীতে কমিশনের চেয়ারম্যানের কিছু ক্ষমতা সরকার কর্তৃক নিয়োগ পাওয়া সচিবকে অর্পণ, রাষ্ট্রপতির (আসলে প্রধানমন্ত্রী) কাছে কমিশনের জবাবদিহি ও দুর্নীতির মামলা মিথ্যা হলে উল্টো অভিযোগকারীকে কারাদণ্ডের বিধানের কথা বলা হয়। নাগরিক সমাজের চাপের মুখে পূর্বানুমোদনের বিধানটি প্রত্যাহার করা হলেও বাকি আপত্তিকর বিষয়গুলোতে সরকারের অবস্থান এখনো পরিষ্কার নয়। 
দুদককে হেয় ও দর্শনগতভাবে দুর্বল করার সবচেয়ে বড় পদক্ষেপটি নেওয়া হয় ঢালাওভাবে ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে সব দুর্নীতির মামলা প্রত্যাহার করে। এর মধ্যে কিছু হয়রানিমূলক মামলা হয়তো ছিল, কিন্তু কিছু মামলা, বিশেষ করে জ্ঞাত উৎসবহির্ভূত সম্পত্তিসংক্রান্ত মামলাগুলো ছিল অত্যন্ত বিশ্বাসযোগ্য। সরকার তার লোকদের বিরুদ্ধে তত্ত্বাবধায়কের আমলে দায়ের করা এসব মামলা নির্বিচারে প্রত্যাহার করলেও বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে সব মামলা জারি রাখে। আর এর মাধ্যমেই সম্ভবত দুদককে কীভাবে কাজ করতে হবে, তার একটি অলিখিত নির্দেশনা সরকার দিয়ে দেয়। দুদক সেই নির্দেশনা ভালোভাবেই পড়তে পেরেছে মনে হয়। গত তিন বছরে কোনো মন্ত্রী বা এই সরকারের আমলের প্রভাবশালী আমলা ও বড় ব্যবসায়ীর দুর্নীতির কোনো হদিস তারা পায়নি; বরং সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বা আবুল হোসেনের মতো মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে পারিপার্শ্বিক প্রমাণ বা সুনির্দিষ্ট তথ্য থাকার পরও দুদককে দেখা গেছে এদের নির্দোষ হিসেবে তুলে ধরার প্রচেষ্টায় অবদান রাখতে।

৪. 
পদ্মা সেতু প্রকল্পে সৈয়দ আবুল হোসেন এবং প্রভাবশালী দুজন আমলার বিরুদ্ধে ঘুষ দাবি করার প্রস্তাব-সংক্রান্ত কানাডার পুলিশের দেওয়া তথ্য বিশ্বব্যাংক দুদককে দিয়েছে। দুদক কি সঠিকভাবে তদন্ত করবে এসব? সেই ক্ষমতা, সৎসাহস ও স্বাধীনতা কি আছে তাদের? ইতিমধ্যে দুদক ঘুষ-প্রস্তাব বিষয়ে কানাডা ও বাংলাদেশের আইনের দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য এবং অভিযুক্ত ব্যক্তিদের নাম প্রকাশ না করার পক্ষে যেসব বক্তব্য রাখছে, তাতে আশঙ্কা প্রকাশ করার কারণ আছে—এই তদন্ত সঠিকভাবে হবে না। ক্ষমতাসীন সরকারের মন্ত্রীরা দুর্নীতি করেন—এই বার্তা দুদকের পূর্বসূরিরা যেমন কখনো দিতে পারেনি, বর্তমান দুদক এর ব্যতিক্রম হবে বলে বিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই।
যদি তাই হয়, তাহলে আমাদের দেশে দুর্নীতির প্রকোপ কখনোই কমবে না। আওয়ামী লীগ সরকারের আগের আমলে আমরা দুর্নীতিতে প্রথমবারের মতো বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়েছিলাম। পরের বিএনপি সরকার সেই কুখ্যাতি পর পর চার বছর ধরে রেখে ব্যাপকভাবে নিন্দিত হয়েছিল। এখন আমরা দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন না হলেও শীর্ষস্থানীয়। তবে দুদককে যেভাবে চালিত করা হচ্ছে এবং একই সঙ্গে রাষ্ট্রের অন্যান্য জবাবদিহির প্রতিষ্ঠান যেভাবে কাজ করছে, তাতে অচিরেই এই চ্যম্পিয়নশিপের কুখ্যাতি আবার এই জাতির ঘাড়ে নেমে আসতে পারে!
 আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

রবিবার, ১০ জুন, ২০১২

আমাদের রক্ষা করবে কে


আসিফ নজরুল

অধিকাংশ বাঙালির মতো আমি বলতে ভালোবাসি। কিন্তু আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারের সামনে গেলে আমার শুধু শুনতে ইচ্ছে করে। তিনি কেতাবের কথা বলেন, তার চেয়ে অনেক বেশি বলেন নিজস্ব দর্শনের কথা। নিজের মতো চিন্তা করতে পারা এবং কঠিন বিষয় হাস্যরসের মাধ্যমে সহজ করে বলতে পারার দুটি দুর্লভ ক্ষমতা তাঁর রয়েছে। তার আরেকটি অসাধারণ গুণ হলো অগ্নিগর্ভ বিষয়েও অতি মার্জিতভাবে কথা বলতে পারা।
স্যারের সঙ্গে আমার ভালো করে আলাপ হয় না অনেক দিন। টেলিভিশনের একটি অনুষ্ঠানে অংশ নিতে গিয়ে শুনি, তিনি নাকি সাংসদদের আচরণকে চোর-ডাকাতের সঙ্গে তুলনা করেছেন। আমার উচিত ছিল প্রথমেই এতে সন্দেহ পোষণ করা। কারণ, এ ধরনের কথা বলার মতো মানুষ তিনি কখনোই না। এ ধরনের বক্তব্য দূরের কথা, কোনো তীব্র কথা এমনকি শোনার মানসিকতাও তাঁর নেই। কিন্তু তাঁর ‘বক্তব্য’ নিয়ে সংসদে আলোচনা হয়েছে। যে ভদ্রলোক সেদিন স্পিকারের দায়িত্ব পালন করেছেন, তিনি পর্যন্ত বলেছেন তাঁকে এ জন্য সংসদে তলব করা হবে এবং দাঁড়িয়ে ক্ষমা চাইতে হবে।
পরে আমরা প্রমাণ পেলাম তাঁর বয়ানে সম্পূর্ণ মিথ্যা বক্তব্য একটি পত্রিকা ছেপেছিল এবং কিছু সাংসদ সেই পত্রিকার সংবাদের ভিত্তিতে তাঁর প্রতি নিষ্ঠুর এবং অবমাননাকর মন্তব্য করেছেন। সাংসদ শেখ সেলিম, যিনি একসময় তাঁরই ছাত্র ছিলেন, তিনি তাঁর আর্থিক সততা নিয়ে পর্যন্ত প্রশ্ন তুলেছেন। সায়ীদ স্যার কোনো দিন আমাদেরও যা বলেননি, তা-ই জানিয়ে দিলেন বাধ্য হয়ে: এই বিশ্বখ্যাত মানুষটি থাকেন দুই কামরার বাসায় এবং ম্যাগসাইসাই পুরস্কার না পেলে তাঁর হয়তো চিকির‌্যাসাও করা হতো না ঠিকমতো।
আমাদের সাংসদদের উচিত ছিল সংসদের কার্যবিবরণী থেকে তাঁদের অন্যায় ও অসত্য বক্তব্যগুলো বাদ দেওয়া, সায়ীদ স্যারের কাছে দুঃখ প্রকাশ করা এবং যে পত্রিকা মিথ্যা খবর ছেপেছে, ওই পত্রিকার বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া। সংসদ তা এখনো করেনি, এমনকি সায়ীদ স্যারের একসময়ের ছাত্র শেখ সেলিম পর্যন্ত তাঁর কাছে ক্ষমা চাননি। বাংলাদেশে সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে সম্মানিত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কুর‌্যাসা রটনা, বিষোদ্গার কিংবা অশ্রদ্ধামূলক মন্তব্যের যে প্রবণতা আমরা লক্ষ করছি, সাম্প্রতিক সময়ে তাই যেন স্বাভাবিক চিত্র হতে চলেছে দেশে। 
আমাদের কারও প্রতি কারও শ্রদ্ধা নেই, কেউ কাউকে সম্মান জানাতে রাজি নয়, বাক্যসন্ত্রাসের এক অমানিশা যেন গ্রাস করছে আমাদের জীবন আর জগর‌্যা। বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ, বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, ড. মুহাম্মদ ইউনূস, ড. কামাল হোসেন, সবশেষে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ—আলোকবর্তিকার মতো যে মানুষদের আদর্শে জীবন গড়া উচিত আমাদের তরুণ প্রজন্মের, তাঁদের পর্যন্ত খাটো করে তোলার জন্য কুর‌্যাসা রটনা হয়েছে। কারও কারও বিরুদ্ধে সমালোচনা করা হয়েছে জাতীয় সংসদে।
বিশেষ অধিকারবলে সংসদ ‘ফ্রি স্টাইল’ কথা বলার জায়গা, এখানে কমবেশি কিছু বাক্যবাণ হয়তো মেনে নেওয়া যায়। কিন্তু আমরা দেখেছি সমাজের সম্মানিত ও দায়িত্বশীল মানুষ অপদস্থ হয়েছেন এমনকি উচ্চ আদালতের মতো প্রতিষ্ঠানে, যেখানে বিচারকদের অন্যতম দায়িত্ব হচ্ছে বাকসংযম, নিরপেক্ষতা এবং উচ্চ আদালতের সুমহান প্রাতিষ্ঠানিক মর্যাদা বজায় রাখা।
এখন আমরা স্বয়ং সংসদ ও উচ্চ আদালত কর্তৃক একে অপরকে আক্রমণ করতে দেখছি। স্পিকারকে অজ্ঞ ও অল্প বিদ্যা ভয়ংকরী বলা হয়েছে, তাঁর একটি বক্তব্যকে রাষ্ট্রদ্রোহের শামিল বলা হচ্ছে। যে বিচারক এটি বলেছেন, তাঁকে মানসিক বিকারগ্রস্ত ও স্যাডিস্ট বলা হয়েছে সংসদে। সংবিধান লঙ্ঘনকারী হিসেবে তাঁর অভিশংসনের দাবি উঠেছে সংসদে।
এই পরিস্থিতি যেকোনো নাগরিককে হতাশ করার মতো। এর মধ্য দিয়ে জনগণের কাছে দুটি প্রতিষ্ঠানেরই মর্যাদাহানি হয়েছে। প্রধান বিচারপতি এবং স্পিকার উদ্যোগ নিয়ে হয়তো এই বিশেষ পরিস্থিতি সামাল দিতে পারবেন। দুটি শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান নিজেদের স্বার্থেই হয়তো পারস্পরিক সংঘাত এড়াতে পারবেন। কিন্তু সাধারণ নাগরিকদের, বিশেষ করে স্বাধীন মত প্রকাশের মাধ্যমে বা কর্মগুণে যাঁরা মানুষের কাছে শ্রদ্ধার আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছেন, অশালীন কিংবা অসম্মানজনক বাক্যবাণ থেকে তাঁদের রক্ষা করবে কে?

২. 
আমরা ভুলে যাই যে শালীনতা, সৌজন্যবোধ এবং মার্জিত ব্যবহারের বাধ্যবাধকতা রয়েছে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সব প্রতিষ্ঠানের জন্য। সাংসদেরা তাঁদের অবাধ বাক্স্বাধীনতা-সংক্রান্ত বিশেষ অধিকারের কথা বলেন। ব্রিটিশ পার্লামেন্টে গৃহীত ১৬৬৯ সালের বিল অব রাইটসের ৯ম অনুচ্ছেদ অনুসারে অধিকাংশ দেশের মতো বাংলাদেশেও সাংসদদের অবাধ বাক্স্বাধীনতার অধিকার রয়েছে। তবে আমাদের মনে রাখতে হবে বিল অব রাইটসের সেই অনুচ্ছেদেও বলা হয়েছিল যে স্বয়ং পার্লামেন্টে এ বিষয়ে প্রশ্ন তোলা বা বাধা সৃষ্টি করা যাবে।
আমাদের জাতীয় সংসদ পরিচালনা-সংক্রান্ত কার্যপ্রণালি বিধির বিভিন্ন জায়গায়ও সাংসদদের বাক্স্বাধীনতার ক্ষেত্রে কিছু সীমারেখা টানা হয়েছে। যেমন, আইন-আদালতে বিচারাধীন বিষয়ে মন্তব্য থেকে শুরু করে যে কারও সম্পর্কে আক্রমণাত্মক, কটু বা অশ্লীল ভাষা ব্যবহার না করার দায়িত্ব রয়েছে সাংসদদের। কার্যপ্রণালি বিধি অনুসারে স্পিকার বাকসংযমে ব্যর্থতার জন্য কোনো সাংসদকে সতর্ক করতে পারেন, তাঁর মাইক বন্ধ করে দিতে পারেন, কার্যপ্রণালি বিধি থেকে তাঁর বক্তব্য বাতিল করে দিতে পারেন, এমনকি ১৫ বিধি অনুসারে বিশৃঙ্খল আচরণের জন্য তাঁকে সংসদ থেকে চলে যেতে আদেশ দিতে পারেন। এরস্কিন মে রচিত পার্লামেন্টারি প্র্যাকটিস বইয়ে রয়েছে, ব্রিটিশ পার্লামেন্টে অতীতে আপত্তিকর বক্তব্যের জন্য বহু সাংসদকে নানা শাস্তি (যেমন: তিরস্কার, আটকে রাখা, বহিষ্কার) দেওয়ার নজির রয়েছে।
এমন নজির আমরা আমাদের সংসদে খুবই কম দেখি। এই সংসদে কারও ‘কোলে ওঠার’ অশ্লীল বাক্যবিনিময় হয়েছে, একজন প্রয়াত নেতার মৃতদেহ নিয়ে অত্যন্ত অরুচিকর বক্তব্য দেওয়া হয়েছে, সংসদে অনুপস্থিত ব্যক্তি সম্পর্কে চরম অসত্য বিষোদ্গার করা হয়েছে। কখনো আমরা তিরস্কার বা মাইক বন্ধের মতো মৃদু শাস্তি দেখেছি, কিন্তু যেসব বক্তব্য ফৌজদারি অপরাধতুল্য (যেমন, মানহানিকার), সেসব ক্ষেত্রেও আমরা স্পিকার কর্তৃক কাউকে সংসদ থেকে বহিষ্কার করতে দেখিনি।

৩. 
সৌজন্যতার বাধ্যবাধকতা আছে উচ্চ আদালতের বিচারকদের ক্ষেত্রেও। অভিযুক্ত ব্যক্তিকে ভুলভাবে শাস্তি না দেওয়ার তাগিদ ইংলিশ জুরিস্ট উইলিয়াম ব্লাকস্টোনের মৌলিক নীতিতে ছিল। পরবর্তী সময়ে সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা এবং নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার-সংক্রান্ত ১৯৬৬ সালের আন্তর্জাতিক চুক্তিতে ‘প্রিসাম্পশন অব ইনোসেন্স’-এর নীতি গৃহীত হয়। কমনওয়েলথ হিউম্যান রাইটস্ ইনিশিয়েটিভসের ফেয়ার ট্রায়াল ম্যানুয়াল অনুসারে বিচার সম্পন্ন হওয়ার আগে যেহেতু কাউকে দোষী বলা যায় না, তাই বিচারকদের কর্তৃক যেকোনো অভিযু্ক্ত ব্যক্তির সঙ্গে সম্মানজনক আচরণ করা বাঞ্ছনীয়। ১৯৮৫ সালের জাতিসংঘের প্রিন্সিপাল অব ইনডিপেনডেন্স অব জুডিশিয়ারির ১১ নম্বর গাইডলাইন অনুসারে একজন বিচারকের তাঁর সম্মুখে উত্থাপিত বিষয়ে কোনো রকম পূর্ব ধারণা পোষণ না করারও কঠোর বাধ্যবাধকতার কথা বলা হয়েছে। উচ্চ আদালতে রিট পিটিশনের শুনানির আগে যেহেতু ফৌজদারি অপরাধের মতো তদন্ত, চার্জশিট দাখিল ও চার্জ গঠন করা হয় না, তাই সেখানে বিবাদী বা রেসপোনডেন্টকে শুনানিকালে নির্দোষ ধরে নিয়ে তাঁর সঙ্গে সৌজন্যমূলক আচরণ করার বাধ্যবাধকতা আরও বেশি রয়েছে বলা যায়।
এ দেশে উচ্চ আদালতের একটি বেঞ্চে আমরা অন্যরকম আচরণ দেখি। পিটিশনের শুনানি চলাকালে রেসপোনডেন্টদের বিরুদ্ধে নাজিমুদ্দিন রোড (জেলখানা) বা পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেওয়ার হুমকি আমরা সেই বেঞ্চ থেকে শুনেছি। শুনানি সম্পন্ন হওয়ার আগে ঢালাওভাবে ‘চোর’ বলা হয়েছে, এটিও পত্রপত্রিকায় এসেছে। কেউ দোষ করেছেন কি না, সে সম্পর্কে প্রাথমিক শুনানিকালে তাঁকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড় করিয়ে রাখার বহু ঘটনা ঘটেছে। এগুলো কোনোভাবেই বিচারের আন্তর্জাতিক নর্ম বা মানদণ্ডের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
উচ্চ আদালতের বিচারকেরা আমাদের জাতির ক্রান্তিলগ্নে অনেক সময় প্রত্যাশিত ভূমিকা রেখেছেন। মানবাধিকার ও পরিবেশ রক্ষা করার ক্ষেত্রে বর্তমানেও উচ্চ আদালত থেকে আমরা অনেক সময় জনমুখী রায় পেয়ে থাকি। কিন্তু উচ্চ আদালতের একজন বিচারকও যদি আইন ও রীতি লঙ্ঘন করেন বা এজলাসে কারও প্রতি সংবিধানের ৩৫(৫) লঙ্ঘনতুল্য লাঞ্ছনাকর ব্যবহার করেন, তার প্রতিকার বিচার বিভাগের মর্যাদা ও সম্মান রক্ষার স্বার্থে হলেও করতে হবে।
উচ্চ আদালতের বিচারকদের জবাবদিহি আমাদের সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ অনুসারে প্রণীত কোড অব কনডাক্ট কর্তৃক সুনির্দিষ্ট। আচরণবিধিতে বলা হয়েছে যে একজন বিচারক মামলার পক্ষগণ এবং আইনজীবীদের প্রতি ধৈর্যশীল, মর্যাদাপূর্ণ, সশ্রদ্ধ এবং ভদ্র আচরণ করবেন। এতে আরও বলা আছে যে একজন বিচারক কোনো অবস্থাতেই প্রকাশ্য বিতর্কে জড়াবেন না বা রাজনৈতিক বিষয়ে প্রকাশ্য কোনো মতামত ব্যক্ত করবেন না কিংবা তাঁর বিচারাধীন কোনো মামলার বিষয়ে কোনো মন্তব্য করবেন না। আচরণবিধির উপসংহারে বলা হয়েছে যে এই আচরণবিধির ১৪টি বিধি কেবল সুনির্দিষ্ট উদাহরণ হিসেবে উপস্থাপিত হলো, এর বাইরে একজন বিচারক এমন কিছু করবেন না, যা উচ্চ আদালতের আস্থাযোগ্যতা ও স্বাধীনতাকে ক্ষুণ্ন করে।
আচরণবিধির লঙ্ঘন গুরুতর অসদাচরণ হলে প্রধান বিচারপতি ও আপিলেট ডিভিশনের দুজন সিনিয়র বিচারপতির সমন্বয়ে গঠিত সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল রাষ্ট্রপতির কাছে বিষয়টি জানিয়ে তাঁকে অভিশংসনের প্রক্রিয়া শুরু করতে পারেন। এ ছাড়া সুপ্রিম কোর্ট রুলস অনুসারে প্রধান বিচারপতি কর্তৃক কোনো বিচারপতির বেঞ্চ ভেঙে দেওয়া, তাঁকে কিছু সময়ের জন্য ছুটি প্রদান করা বা তাঁকে সংশোধনমূলক পরামর্শ দেওয়ার বহু সুযোগ রয়েছে।
দু-একজন বিচারকের আচরণ ও উচ্চ আদালতের মর্যাদা নিয়ে বিচলিত হওয়ার মতো বহু সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত হলেও আমরা সর্বোচ্চ বিচার প্রশাসনকে কোনো প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে দেখিনি। আমার মনে হয় না এ ধরনের ব্যবস্থা আগে গ্রহণ করলে আজকের বিপর্যয়কর পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো।

৪. 
জাতি হিসেবে আমাদের শালীনতাবোধ নিয়ে গভীরভাবে আত্মসমালোচনা করার সময় এসেছে। রাষ্ট্রকাঠামোতে অধিষ্টিত সর্বোচ্চ ব্যক্তিরা যখন নিজেরাই সৌজন্য ও শালীনতার চর্চা ভুলে যান বা তাঁদের এখতিয়ারভুক্ত ব্যক্তিদের কর্তৃক অসৌজন্যমূলক ও ভব্যতাহীন আচরণ নিয়ন্ত্রণে অপারগ থাকেন, তখন আমাদের কপাল খুবই মন্দ বলতে হবে। এসব অব্যাহত থাকলে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম কী শিখবে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারক ও নীতি প্রয়োগকারীদের কাছে থেকে? কীভাবে তাঁরা গর্বিত ও সম্মানিত বোধ করবেন এই রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে?
মানুষের আচার-আচরণ নাকি বংশের পরিচয়। তেমনি রাষ্ট্রের কর্ণধারদের আচার-আচরণও জাতি হিসেবে আমাদের ভব্যতা ও সভ্যতার পরিচায়ক। তাঁদের কেউ কেউ সে বিষয়ে সচেতন আছেন কি না, তা নিয়ে আমাদের আমজনতার অবশ্যই উদ্বেগ রয়েছে।
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

শুক্রবার, ১৮ মে, ২০১২

শিক্ষকের বেত পুলিশের লাঠি

ক্লাস শেষ করে ফিরছি আমার রুমে। সায়েন্স এনেক্সের নিচতলার লম্বা করিডর ধরে এগোচ্ছি। দেখি ওপরে যাওয়ার সিঁড়ির কাছে মেঝেতে বসে আছেন চারজন মানুষ। দীনহীন, ক্লান্ত শরীর, জরাজীর্ণ পোশাক-আশাক। হাতের পলিথিনের পোঁটলা খুলে চিড়া আর গুড় বের করছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের করিডর দুপুরের খাওয়ার জায়গা না। তাই হয়তো ভীতসন্ত্রস্ত চোখে দেখছেন চারদিক। তাঁদের পাশ কাটিয়ে এগোই। হঠাৎ আমার সন্দেহ হয়। একটু পিছিয়ে এসে বলি, আপনারা শিক্ষক? তাঁরা মাথা নাড়েন। শহীদ মিনারে প্রখর রোদে বসে আন্দোলন করছেন তাঁরা দুই দিন ধরে। এখানে একটু ছায়া কিংবা দেয়ালঘেরা জায়গা দেখে খেতে এসেছেন। খোলা একটা ক্লাসরুমে দেখিয়ে তাঁদের অনুনয় করি: প্লিজ, আপনারা ওখানে বসে খান। তাঁরা যতটা খুশি হন, তারচেয়ে বেশি দ্বিধান্বিত। নিজের পরিচয় দিই, বলি কেউ আপনাদের কিছু বলবে না, ওখানে বসে খান।
তাঁরা উঠে দাঁড়ান, আমি পালিয়ে বাঁচি! চিড়া-গুড় খেয়ে, রোদে পুড়ে, খোলা জায়গায় শুয়ে তাঁরা কত দিন আন্দোলন করবেন? প্রতিবছর এই সময়টাতে তাঁদের দেখি শহীদ মিনারে। কোনো বছরই তাঁদের আর্তনাদ পৌঁছায় না কারও কাছে। কখনো বক্তৃতা, কখনো গান গেয়ে প্রধানমন্ত্রীকে কত কিছু স্মরণ করাতে চান তাঁরা। তিনি জাতির জনকের কন্যা, তিনি শিক্ষকদের দাবি পূরণের ওয়াদা করেছিলেন, তিনিও কেমন করে ভুলে যান তাঁদের! গানের কথা ছাপিয়ে যায় কান্নার জলোচ্ছ্বাসে। হায়রে! এই দেশে প্রধানমন্ত্রীদের কানে কেউ পৌঁছায় দেয় না এসব?
আমি রিকশায় করে পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় দেখি তাঁদের। একজন মাথায় কম চুলের তৈয়ব স্যার। একজন ঘুম-ঘুম চোখের মজিদ স্যার। ঘন-কালো চুলের ফিরোজ স্যার, লম্বা দাড়ির ইসলামিয়াত স্যার। সবাই আছেন এখানে। ৪০ বছর আগে সাভার প্রাইমারি স্কুলে যাঁরা আমাকে পড়তে শিখিয়েছেন, সে রকম শত শত তৈয়ব স্যার, মজিদ স্যারদের দেখি। বেতন-ভাতা নিয়মিত করানোর জন্য, সামান্য কিছুটা বাড়ানোর জন্য কত বছর ধরে তাঁরা দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে আসেন শহীদ মিনারে। রাজা যায়, রাজা আসে। বাজারে আগুন লাগে, তাঁদের অভাবের সংসার ক্রমেই ছাই হতে থাকে। কারও কানে পৌঁছায় না তাঁদের আর্তনাদ। 
তাই হয়তো শিক্ষকেরা অবশেষে রওনা হন প্রধানমন্ত্রীর অফিসের দিকে। তাঁরা শেয়ারবাজার লুট করেননি, মানুষের টাকা মেরে দেননি, কাউকে গুম করেননি, কারও স্বপ্ন খুন করেননি। তাঁরা বিএনপি না, তাঁরা জামায়াতও না। তাঁদের হাতে ককটেল নেই, লগি-বৈঠা নেই, বাহুতে ঢিল মারার শক্তিও নেই। তাঁরা আগুন দিতে যাননি, গালি দিতে যাননি, এমনকি স্লোগান দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর অফিসের শান্তিও নষ্ট করতে যাননি। তাঁরা শুধু তাঁদের অভাব-অভিযোগের কথা লেখা একটি কাগজ প্রধানমন্ত্রীর অফিসে পৌঁছে দিতে চেয়েছিলেন।
পুলিশ তাতেই দানব হয়ে ওঠে। ১৫ মে ২০১২। শাহবাগে জলকামানের তোড়ে রাস্তায় উল্টে পড়েন বৃদ্ধ, শীর্ণ কিংবা ক্লান্ত শিক্ষক। মোটা লাঠি হাতে পিটিয়ে রক্তাক্ত করা হয় কয়েকজনকে। ঘাড় ধরে কংক্রিটের রাস্তায় টেনেহিঁচড়ে তোলা হয় পুলিশের গাড়িতে। তাঁরা আমাদের প্রথম শিক্ষক, তাঁরা আমাদের শিখিয়েছেন বর্ণমালা, ধারাপাত কিংবা মানুষ হওয়ার মন্ত্র। সেই মন্ত্র নিশ্চয়ই আমরা মনে রাখিনি। আমাদেরই কেউ কেউ বরং বড় হয়ে রাষ্ট্রের কাছে শিখেছে পুলিশ কিংবা পুলিশদের মন্ত্রী হওয়ার মন্ত্র! পুলিশের প্রধান কাজ ক্ষুব্ধ মানুষের হাত থেকে সরকারকে রক্ষা করা। পুলিশের দ্বিতীয় প্রধান কাজ এসব মানুষকে চিৎকার এমনকি আর্তনাদও না করতে দেওয়া। পুলিশের তৃতীয় প্রধান কাজ এঁদের হাড্ডি গুঁড়ো করে দেওয়া। জিরো টলারেন্স! 
পুলিশের মার খেয়ে আহত হয়েছেন কয়েকজন। হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরে মারা গেছেন লাঞ্ছিত একজন শিক্ষক। এই শিক্ষক মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। ৪১ বছর আগে দেশকে স্বাধীন করার জন্য তিনি যুদ্ধ করেছেন। ৪১ বছর পর তাঁরই গড়া স্বাধীন দেশের পুলিশের হাতে লাঞ্ছিত হয়েছেন তিনি। এই দুঃসহ গ্লানি বহন করা হয়তো সম্ভব ছিল না তাঁর! তিনি চলে গেছেন অন্য এক ভুবনে। 
নিশ্চয়ই তাঁর এভাবে মরে যাওয়া উচিত হয়নি, ভুখানাঙা শিক্ষকদের সঙ্গে থাকাও উচিত হয়নি। তাঁর থাকা উচিত ছিল সমুদ্রজয়ের সমাবেশে কিংবা হরতালবিরোধী মিছিলে! তাই তাঁর মৃত্যুতে কোনো মন্ত্রী দুঃখ প্রকাশ করেননি, বুদ্ধিজীবীরা বিবৃতি দেননি, কেউ আদালতে রুল চাইতে যাননি! তিনি যখন হাসপাতালে, এমনকি আমাদের ‘প্রলেতারিয়েত’ শিক্ষামন্ত্রী তাঁকে দেখতেও যাননি। 
এই ‘বোকা’ শিক্ষককে নিয়ে আর কিছু লেখার মতো নেই! আমার বরং ছোটবেলার স্যারদের কথা মনে পড়ছে বেশি। পড়াশোনা না করলে, দুষ্টুমি করলে রাগে কাঁপতে থাকতেন তাঁদের কেউ কেউ। বাংলাদেশে তখনো সুশীল সমাজের জন্ম হয়নি। রেগে গেলে তাই শিক্ষকেরা পেটাতে পারতেন আমাদের। বেত দিয়ে পেটানোর সময় তৈয়ব স্যার গর্জে উঠতেন বারবার: মানুষ হবি না তোরা, মানুষ হবি না! 
শিক্ষকদের মার খেয়ে চামড়া জ্বলে উঠত। মাঝেমধ্যে একটু রাগ হতো। এত মারার কারণও বুঝতে পারতাম না। বহু বছর পর এখন মনে হচ্ছে, আমাদের সবাইকে আরও ভালো করে পেটানো উচিত ছিল তাঁদের! আরও গর্জে উঠে বলা উচিত ছিল: মানুষ হবি না? 
পুলিশের লাঠির চেয়ে শিক্ষকের বেত অনেক মহৎ। কিন্তু এই রাষ্ট্র কেমন করে যেন বদলে গেছে। শিক্ষকের বেত উঠে যাচ্ছে, পুলিশের লাঠি বাড়ছে! সেই লাঠি পড়ছে তাদেরই একসময়ের শিক্ষকদের ওপর! 
 আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

বৃহস্পতিবার, ১০ মে, ২০১২

তিস্তা চুক্তি নিয়ে সংশয়



আ সি ফ ন জ রুল

 লঅবশেষে ভারতীয়রা আমাদের জানিয়ে দিল, তিস্তা চুক্তি অচিরেই হ”েছ না। হ”েছ না যে তার বড় কারণ বাংলাদেশের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর অব¯’ান ভারতের কাছে অধিক গুর“ত্ব পেয়েছে। ভারতীয় বি”িছন্নতাবাদীদের দমন, বাণিজ্য সুবিধা, ট্রানজিট, বিনা আপত্তিতে টিপাইমুখ মেনে নেয়ার মতো বহু কিছুতে ভারতের স্বার্থ রক্ষার পর ভারতের এই মনোভাব অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। এটি সরকারের একপেশে ভারতনীতির ব্যর্থতার একটি বড় উদাহরণও। তিস্তা নদীর পানি প্রধানত সেচকাজে ব্যবহারের জন্য ভারত জলপাইগুড়িতে গজলডোবায় এবং বাংলাদেশ লালমনিরহাটে তিস্তা (দালিয়া) ব্যারেজ নির্মাণ করেছে বহু বছর আগে। উজানের দেশ হওয়ায় ভারত আগেই ব্যারেজ ও সেচখালের মাধ্যমে পানি সরিয়ে ফেলায় বাংলাদেশের ব্যারেজটি শুষ্ক মৌসুমে অকার্যকর ও মূল্যহীন হয়ে পড়ে। আবার বর্ষা মৌসুমে এই পানি ভারত পুরোপুরি ছেড়ে দেয়ায় বাংলাদেশে বন্যা ও নদীভাঙনেরও সৃষ্টি হয়। দেশের উত্তরাঞ্চলের দারিদ্র্যদশা ঘোচানোর একটি বড় শর্ত হ”েছ তাই তিস্তায় ন্যায্য পানি প্রাপ্তি নিশ্চিত করা। তিস্তা নদী নিয়ে স্বাধীনতার পরপর আলোচনা শুর“ হলেও ১৯৮৩ সালে প্রথম একটি সমঝোতা হয়। এই সমঝোতা অনুসারে তিস্তার পানির ৩৯ শতাংশ ভারত ও ৩৬ শতাংশ বাংলাদেশের পাওয়ার কথা ছিল। বাকি ২৫ শতাংশের কতটুকু বাংলাদেশে ব্রহ্মপুত্র পর্যন্ত তিস্তার গতিপথকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য প্রয়োজন এবং এটি কিভাবে ভাগাভাগি হবে, তা নিয়ে পরে আরও আলোচনার কথা ছিল। এ আলোচনা কখনও আর সুসম্পন্ন হয়নি। ১৯৮৬ সালে জয়েন্ট কমিটি অব এক্সপার্টের সভায় বাংলাদেশ নদীর পানি ভাগাভাগির একটি সার্বিক রূপরেখা প্রদান করে। এতে বাংলাদেশ ব্রহ্মপুত্র নদের ৭৫ শতাংশ এবং তিস্তাসহ আটটি নদীর পানির ৫০ শতাংশ পানি দাবি করে। পরে বাংলাদেশ নির্দিষ্টভাবে ২০ শতাংশ পানি তিস্তার নাব্যতার জন্য রেখে দিয়ে বাকি ৮০ শতাংশ সমান ভাগে ভাগ করার প্রস্তাব দেয়। ভারত এটি মেনে নেয়নি। ভারতের কোন কোন মহল থেকে এ সময় ভারতের অধিক পরিমাণ কৃষিভূমি ইতিমধ্যে সেচ সুবিধা ব্যবহার করছেÑ এই যুক্তিতে তিস্তার সিংহভাগ পানি দাবি করে বসে। যেমনÑ পশ্চিমবঙ্গ থেকে নির্বাচিত ক্ষমতাসীন কংগ্রেস দলীয় সংসদ সদস্য গত বছর ১ সেপ্টেম্বর বিবিসিকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, বর্তমানে তিস্তার ৩৯ শতাংশ পানি পেলেও তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষরিত হলে ভারত পাবে ৭৫ শতাংশ! ভারতের পক্ষে আলোচনাকারী দেশটির নিরাপত্তা উপদেষ্টা শিবশংকর মেনন তাকে এ তথ্য দিয়েছেন বলে তিনি বিবিসিকে জানিয়েছিলেন। আমার ধারণা, তিস্তায় বেশি পানি দাবি করার ক্ষেত্রে ভারত এর পানির বর্তমান ব্যবহারকে (এগ্জিস্টিং ইউটিলাইজেশন) যুক্তি হিসেবে দাঁড় করাতে চা”েছ। এটি অত্যন্ত অসঙ্গত এ কারণে যে, উজানের দেশ হওয়ায় ভারত একতরফাভাবে বেশি পানি ব্যবহার করার ভৌগোলিক সুযোগ পেয়ে প্রথমেই বাংলাদেশকে পানি ব্যবহারের সুযোগ থেকে অনেকাংশে বঞ্চিত করে ফেলে। এ বঞ্চনা আন্তর্জাতিক আইনে স্বীকৃত নয়, তাই এটি নদীর পানি ভাগাভাগির ভিত্তি হতে পারে না। বাংলাদেশের যে পরিমাণ জমিকে সেচসুবিধা দেয়ার লক্ষ্য নিয়ে তিস্তা ব্যারেজ নির্মাণ করা হয়েছিল, তাতে সেচ সুবিধা দেয়ার বিষয়টি অবশ্যই তাই তিস্তা চুক্তি সম্পাদনে বিবেচনায় নিতে হবে। সেক্ষেত্রে ২৫ শতাংশ তো প্রশ্নই আসে না, তিস্তার ৫০ শতাংশ পানি পেলেও তা বাংলাদেশের জন্য যথেষ্ট হবে না। আমার ধারণা, ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্বের এত ঢাকঢোল পেটানোর পর ২৫ শতাংশ পানিতে রাজি হওয়া কোনভাবেই সম্ভব নয় বাংলাদেশের পক্ষে। অন্যদিকে এর বেশি পানি দেয়া সম্ভব নয়, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী রাজি ননÑ এ ধরনের কথা বলে চুক্তি ঝুলিয়ে রাখলে ভারতের কোন ক্ষতি নেই। কারণ উজানের দেশ হিসেবে তিস্তার পানি ব্যবহারের জন্য ভাটির দেশ বাংলাদেশের সঙ্গে কোন চুক্তির অপেক্ষা তাদের করতে হয় না। তাছাড়া আরও উজানে তিস্তার যে দীর্ঘ গতিপথ ভারতের সিকিমের ভেতরে এবং সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গের সীমানায় প্রবাহিত হ”েছ, সেখান থেকে ভারত যে পানি প্রত্যাহার করছে বা জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র করছে, চুক্তি হলেও তাতেও ঝামেলা বাড়তে পারে। এসব বিষয় বিবেচনায় নিলে তিস্তা চুক্তি আদৌ কখনও হবে কিনা বা বাংলাদেশ এ নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা কখনও পাবে কিনা, তা নিয়ে সন্দিহান হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। ড. আসিফ নজর“ল : আন্তর্জাতিক নদী আইন বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক

সরকারের তাহলে ভয় কিসের


ভারতের অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জি এক নতুন সম্ভাবনার ইঙ্গিত দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে বন্ধুত্ব চায়, কোনো বিশেষ দলের সঙ্গে নয়। তিনি বিরোধী দলের নেত্রী খালেদা জিয়াকে ভারত সফরেরও আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। প্রণবের প্রথম বাংলাদেশ সফরকালে যে শীতল মনোভাব বিএনপির প্রতি দেখানো হয়েছিল, তার পরিপ্রেক্ষিতে এসব পরিবর্তন তাৎপর্যপূর্ণ।
প্রণব, হিলারি এবং সবশেষে ইউরোপীয় ইউনিয়ন আগামী নির্বাচন প্রসঙ্গে দুটো বিষয়ের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছে। এক. রাজনৈতিক সমঝোতা এবং দুই. সবার অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। দুটো বিষয়ের মূল লক্ষ্য অভিন্ন: তা হচ্ছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠান। বাংলাদেশে এখন যত রকম রাজনৈতিক হানাহানি হচ্ছে, তার মূলেও রয়েছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাখা না-রাখা নিয়ে বিরোধ।
অশক্ত গণতন্ত্রের একটি দেশ হিসেবে এই বিরোধ অস্বাভাবিক নয়। এ ধরনের দেশে শাসকগোষ্ঠী ‘অলটেরোকেসি’ বা ক্ষমতার পরিবর্তনে বিশ্বাস করে না। নির্বাচনে কারচুপি যতভাবে করা সম্ভব, তার মাধ্যমে জনগণের রায়কে ছিনতাই করার চেষ্টা এসব দেশে থাকে। বাংলাদেশে এটি চরম পর্যায়ে চলে গিয়েছিল বলে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্ব অরাজনৈতিক কিছু নাগরিকের কাছে প্রদান করার জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের রাজনৈতিক সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সেই সমঝোতাকে অগ্রাহ্য করার চেষ্টা সম্ভবত সফল হবে না। আন্তর্জাতিক মহলও সে রকম ইঙ্গিত দিয়ে যাচ্ছে এখন পর্যন্ত।

২.
গণতন্ত্র মানে যদি হয় জনগণের ম্যান্ডেট, সে ম্যান্ডেট তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে এখনো রয়েছে। জাতীয় পার্টি ছাড়া বাংলাদেশের প্রতিটি বড় রাজনৈতিক দল এই সরকারব্যবস্থার পক্ষে ছিল। জাতীয় পার্টির নেতারা ১৯৯১ সালে অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে সংগত কারণে এর বিরুদ্ধে কথা বলেছিলেন। সেই দলের নেতা এরশাদ পর্যন্ত জনগণ চাচ্ছে বলে তাঁর দল তত্ত্বাবধায়ক সরকারে রাজি আছে বলেছেন সাম্প্রতিক কালে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে দেশে এত সংঘাত হওয়ারও কথা ছিল না। সরকারে থাকা অবস্থায় ২০১০ সালে সংসদীয় কমিটির সঙ্গে সংলাপে স্বয়ং শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সংস্কার সাপেক্ষে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে মতামত জানিয়েছে। শেখ হাসিনা নিজে ১৯৯১ সালের নির্দলীয় সরকার, পরের দুটো তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং ২০০৭ সালের ‘অস্বাভাবিক’ তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার পেছনে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিলেন। তাঁর এই অবস্থানে পরে বিচ্যুতি না ঘটলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকবে কি থাকবে না তা নিয়ে দেশে কোনো সংঘাত সৃষ্টির কারণ হয়তো থাকত না।
প্রশ্ন হচ্ছে, আওয়ামী লীগ কেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারে এখন রাজি নয়? এর সহজ উত্তর হতে পারে নির্বাচনে হেরে যাওয়ার প্রবল ভীতি। বিদেশি ‘বন্ধুরা’ সামনের সময়ে হয়তো আরও স্পষ্ট করে বলবেন, দেশে এখনি ড. কামাল হোসেন, ড. ইউনূস, ড. আবেদের মতো বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তি থেকে অধিকাংশ সাধারণ মানুষ (প্রথম আলোর ৯ মের জরিপ অনুসারে ৯০ দশমিক ১৯ শতাংশ) বলছেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে। সুপ্রিম কোর্টের যে আদেশের খণ্ডিত ও একপেশে প্রয়োগ করে সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিলোপকে যৌক্তিক করতে চায়, সেখানেও জনগণ এবং রাষ্ট্রের নিরাপত্তার স্বার্থে আগামী দুটো নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত করার নির্দেশনা দেওয়া আছে। আওয়ামী লীগ তবু রাজি নয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারে। সর্বশেষ যা খবর, এ নিয়ে এমনকি কোনো সংলাপে বসতেও রাজি নয় দলটি।
সরকারি দলের কেন এই অনড় অবস্থান? একটি সফল সরকারের তো সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রতি ভীতি থাকার কথা নয়। আমরা পত্রিকায় দেখি, সরকারের মন্ত্রীরা সবাই নিজেকে সফল ভাবেন। প্রধানমন্ত্রী নিজেই বলেন, চালচলনে সবাই স্যুটেড-বুটেড না হলেও তাঁর সব মন্ত্রীই সফল। আজকের পত্রিকায় দেখি, দেশে এমন এক গুম আতঙ্কে গুমোট সময়ে সাহারা খাতুন বললেন: তিনি অবশ্যই সফল!
আবারও বলি, এত সফল একটি সরকারের তো নিরপেক্ষ নির্বাচনে ভয় পাওয়ার কথা নয়! তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে এর আগে মহাব্যর্থ কিছু সরকার অংশ নিয়েছিল। তারা প্রত্যেকেই পরাজিত হয়েছিল। গত বিএনপি সরকারের ভরাডুবিই ঘটেছিল ২০০৮ এর নির্বাচনে। আওয়ামী লীগ কি নিজেদের ব্যর্থতার কারণে এমন পরিণতির আশঙ্কা করছে? একমাত্র এই আশঙ্কা থাকলেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে তাদের প্রবল বিরোধিতা আমাদের কাছে বোধগম্য হতো।
কিন্তু আমরা প্রকাশ্যে তাদের কোনো ব্যর্থতা স্বীকার করতে দেখি না। এ জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিরোধিতার ক্ষেত্রে তাদের মনস্তত্ত্ব আরও দুর্বোধ্য হয়ে পড়ছে।

৩.
প্রকাশ্যে আমরা আওয়ামী লীগকে বলতে শুনি শুধু তাদের সফলতার কথা। এর কারণ হতে পারে এই যে, সাধারণ মানুষ যেভাবে সফলতার মানে বোঝে, তার চেয়ে সরকারি দলগুলোর বোঝাটার ভঙ্গিটি ভিন্ন ধরনের। যেমন: আমরা যখন ইলিয়াসের গুম হওয়া নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছি, সরকারের লোকজন হয়তো ভাবছেন ড. কিবরিয়া বা আহসানউল্লাহ মাস্টারের হত্যাকাণ্ডের তুলনায় এটি তেমন কোনো বিষয় নয়। আমরা যখন ড. ইউনূসের অপমানে দেশের মর্যাদা ক্ষুণ্ন হয়েছে ভাবি, তাঁরা হয়তো ভাবেন প্রধানমন্ত্রীর শান্তির মডেল উত্থাপন বাংলাদেশকে নিয়ে গেছে নতুন উচ্চতায়! আমরা যখন নদী শুকিয়ে যাচ্ছে বলে হাহাকার করে উঠি, তাঁরা হয়তো ভাবেন সমুদ্রজয়ের পানি দিয়ে সমাধান হয়ে যাবে সব সমস্যার। আমরা যখন কর্মসংস্থান বা বিনিয়োগ-পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন হই, তাঁরা তখন শুধু জিডিপির গতি দেখেই তৃপ্ত থাকেন।
আমাদের চেয়ে তাঁদের দেখার চোখ ভিন্ন। দলীয়করণকে তাঁরা হয়তো ভাবেন ‘মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের’ লোকের মূল্যায়ন, দুর্নীতিকে ভাবেন দেশসেবার কারণে অর্জিত অধিকার বা ধনতন্ত্রের জন্য মূলধন পুঞ্জীভূতকরণ, রাজনৈতিক সন্ত্রাসকে ভাবেন মহৎ প্রতিশোধ, শেয়ারবাজার লুট করাকে ভাবেন চতুর মানুষের অর্জন, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি মানে ভাবেন বাজার অর্থনীতি!
সরকারি দল নির্বাচনী ম্যানিফেস্টো করে শুধু নির্বাচনে জেতার জন্য, আমরা ভুল করে ভাবি তা বাস্তবায়নের জন্য। সরকারি দল দিনবদল মানে ভাবে শাসকগোষ্ঠী আর তার অনুগতদের দিনবদল, আমরা ভাবি সবার জন্য দিনবদল। সরকার ভাবে দেশটা সরকারি দলের, আমরা ভাবি জনগণের। সরকার ভাবে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক মানে ভারত, আমরা ভাবি অন্যরাও।
বোঝার ক্ষেত্রে এই মনস্তাত্ত্বিক পার্থক্য সত্যি না হলে সরকার আর আমাদের মূল্যায়ন এত ভিন্ন হওয়ার কারণ নেই। আমার কথা হচ্ছে, সরকারের আত্মমূল্যায়ন সঠিক হলে সুষ্ঠু আর অবাধ নির্বাচনে তাদের ভয় পাওয়ার কারণ নেই। আর এমন নির্বাচন কেবল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই হওয়া সম্ভব।

৪.
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রতি অনীহার একটি কারণ আমরা সরকারের নীতিনির্ধারকদের মুখে শুনি। তাঁরা ১/১১ পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রসঙ্গ টেনে সে সময় রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও আমলাদের প্রতি নিপীড়নের কথা বলেন। এই অভিযোগ অমূলক নয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকার যে সংবিধান-বহির্ভূতভাবে বহুদিন ক্ষমতায় ছিল, এটিও সত্যি। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে, সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছিল একটি অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে অস্বাভাবিকভাবে সৃষ্ট একটি সরকার। এ ধরনের পরিস্থিতির মূল কারণ ছিল বিএনপি কর্তৃক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মোড়কে একটি অনুগত নির্বাচন প্রশাসন ও নির্বাচনী প্রক্রিয়া স্থাপনের চেষ্টা। সেই চেষ্টা সহিংসভাবে ঠেকাতে গিয়েছিল তৎকালীন বিরোধী দল, এর পরিণতিতে সৃষ্ট অস্বাভাবিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে সদলবলে অভিনন্দিত করেছিলেন দলটির সভানেত্রী। একইভাবে বর্তমান সরকারি দলও কারসাজির নির্বাচন করতে গেলে তা যেকোনো মূল্যে বর্তমান বিরোধী দল প্রতিহত করার চেষ্টা করবে, এটাই স্বাভাবিক।
এই অনিবার্য সংঘাত এড়ানোর একমাত্র সমাধান হচ্ছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন (এবং ২০০৬ সালের মতো তা টেম্পারিং করার চেষ্টা না করা)। এ জন্য দেশি-বিদেশি বিভিন্ন মহল সংলাপের প্রয়োজনীয়তার কথা বলছে। কিন্তু আমার মতে, সরকার নিজে থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিলে সংলাপেরও তেমন প্রয়োজন নেই। এই উদ্যোগের ভিত্তিতে সংসদে বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের যে ত্রুটিগুলো রয়েছে (যেমন: এর গঠন, কার্যকাল এবং ক্ষমতাসংক্রান্ত), তা দূর করে সর্বমহলে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনকালীন একটি সরকার প্রতিষ্ঠা করা অসম্ভব নয়।
এ জন্য অতিকেন্দ্রীভূত বর্তমান সরকারব্যবস্থায় সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সরকারপ্রধানের সদিচ্ছা। এই সদিচ্ছার অভাব ছিল বলে অতীতে সংলাপের মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের কোনো নজির আমরা পাইনি। গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শেষ দিকে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কিছু সফল সংলাপ হয়েছিল। কিন্তু ৯০-পরবর্তী গণতন্ত্র পুনরুত্থানের যুগে সংলাপের মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের নজির সম্ভবত আর নেই। বর্তমান সরকারের আমলে সংবিধান সংশোধনী সংক্রান্ত সংলাপে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রয়োজনীয়তাসহ বহু বিষয়ে মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সরকার সেই মতৈক্যের গুরুত্ব অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রদান করেনি। এটি প্রমাণ করে, সরকারপ্রধান না চাইলে রাজনৈতিক সংলাপের মাধ্যমে প্রকৃত সমাধানের সম্ভাবনা তেমন নেই বাংলাদেশে।
আমরা সেই সদিচ্ছার প্রত্যাশা করি। দলীয় সরকারের মাধ্যমে একতরফা নির্বাচন বাংলাদেশে অতীতে হয়েছে। আমাদের অভিজ্ঞতা বলে, এমন নির্বাচনগুলো হয়েছে জনগণ কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হওয়ার ভয় থেকে। আগামী নির্বাচনও এভাবে করার উদ্যোগ নিলে মানুষ সেই ভয়ের গন্ধ পাবে। আমার মনে হয় না, জনগণকে ভয় পেয়ে বা ভয় দেখিয়ে বাংলাদেশে ক্ষমতায় টিকে থাকা যায়।
জনগণের সঙ্গে এমন ভয়ের সম্পর্ক যদি না থাকে, তাহলে জনগণের প্রত্যাশা অনুসারে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনঃপ্রবর্তনে সরকারের রাজি হওয়া উচিত। সেটি যত তাড়াতাড়ি হবে, ততই মঙ্গলজনক।

আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।