পৃষ্ঠাসমূহ

শুক্রবার, ১৮ মে, ২০১২

শিক্ষকের বেত পুলিশের লাঠি

ক্লাস শেষ করে ফিরছি আমার রুমে। সায়েন্স এনেক্সের নিচতলার লম্বা করিডর ধরে এগোচ্ছি। দেখি ওপরে যাওয়ার সিঁড়ির কাছে মেঝেতে বসে আছেন চারজন মানুষ। দীনহীন, ক্লান্ত শরীর, জরাজীর্ণ পোশাক-আশাক। হাতের পলিথিনের পোঁটলা খুলে চিড়া আর গুড় বের করছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের করিডর দুপুরের খাওয়ার জায়গা না। তাই হয়তো ভীতসন্ত্রস্ত চোখে দেখছেন চারদিক। তাঁদের পাশ কাটিয়ে এগোই। হঠাৎ আমার সন্দেহ হয়। একটু পিছিয়ে এসে বলি, আপনারা শিক্ষক? তাঁরা মাথা নাড়েন। শহীদ মিনারে প্রখর রোদে বসে আন্দোলন করছেন তাঁরা দুই দিন ধরে। এখানে একটু ছায়া কিংবা দেয়ালঘেরা জায়গা দেখে খেতে এসেছেন। খোলা একটা ক্লাসরুমে দেখিয়ে তাঁদের অনুনয় করি: প্লিজ, আপনারা ওখানে বসে খান। তাঁরা যতটা খুশি হন, তারচেয়ে বেশি দ্বিধান্বিত। নিজের পরিচয় দিই, বলি কেউ আপনাদের কিছু বলবে না, ওখানে বসে খান।
তাঁরা উঠে দাঁড়ান, আমি পালিয়ে বাঁচি! চিড়া-গুড় খেয়ে, রোদে পুড়ে, খোলা জায়গায় শুয়ে তাঁরা কত দিন আন্দোলন করবেন? প্রতিবছর এই সময়টাতে তাঁদের দেখি শহীদ মিনারে। কোনো বছরই তাঁদের আর্তনাদ পৌঁছায় না কারও কাছে। কখনো বক্তৃতা, কখনো গান গেয়ে প্রধানমন্ত্রীকে কত কিছু স্মরণ করাতে চান তাঁরা। তিনি জাতির জনকের কন্যা, তিনি শিক্ষকদের দাবি পূরণের ওয়াদা করেছিলেন, তিনিও কেমন করে ভুলে যান তাঁদের! গানের কথা ছাপিয়ে যায় কান্নার জলোচ্ছ্বাসে। হায়রে! এই দেশে প্রধানমন্ত্রীদের কানে কেউ পৌঁছায় দেয় না এসব?
আমি রিকশায় করে পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় দেখি তাঁদের। একজন মাথায় কম চুলের তৈয়ব স্যার। একজন ঘুম-ঘুম চোখের মজিদ স্যার। ঘন-কালো চুলের ফিরোজ স্যার, লম্বা দাড়ির ইসলামিয়াত স্যার। সবাই আছেন এখানে। ৪০ বছর আগে সাভার প্রাইমারি স্কুলে যাঁরা আমাকে পড়তে শিখিয়েছেন, সে রকম শত শত তৈয়ব স্যার, মজিদ স্যারদের দেখি। বেতন-ভাতা নিয়মিত করানোর জন্য, সামান্য কিছুটা বাড়ানোর জন্য কত বছর ধরে তাঁরা দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে আসেন শহীদ মিনারে। রাজা যায়, রাজা আসে। বাজারে আগুন লাগে, তাঁদের অভাবের সংসার ক্রমেই ছাই হতে থাকে। কারও কানে পৌঁছায় না তাঁদের আর্তনাদ। 
তাই হয়তো শিক্ষকেরা অবশেষে রওনা হন প্রধানমন্ত্রীর অফিসের দিকে। তাঁরা শেয়ারবাজার লুট করেননি, মানুষের টাকা মেরে দেননি, কাউকে গুম করেননি, কারও স্বপ্ন খুন করেননি। তাঁরা বিএনপি না, তাঁরা জামায়াতও না। তাঁদের হাতে ককটেল নেই, লগি-বৈঠা নেই, বাহুতে ঢিল মারার শক্তিও নেই। তাঁরা আগুন দিতে যাননি, গালি দিতে যাননি, এমনকি স্লোগান দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর অফিসের শান্তিও নষ্ট করতে যাননি। তাঁরা শুধু তাঁদের অভাব-অভিযোগের কথা লেখা একটি কাগজ প্রধানমন্ত্রীর অফিসে পৌঁছে দিতে চেয়েছিলেন।
পুলিশ তাতেই দানব হয়ে ওঠে। ১৫ মে ২০১২। শাহবাগে জলকামানের তোড়ে রাস্তায় উল্টে পড়েন বৃদ্ধ, শীর্ণ কিংবা ক্লান্ত শিক্ষক। মোটা লাঠি হাতে পিটিয়ে রক্তাক্ত করা হয় কয়েকজনকে। ঘাড় ধরে কংক্রিটের রাস্তায় টেনেহিঁচড়ে তোলা হয় পুলিশের গাড়িতে। তাঁরা আমাদের প্রথম শিক্ষক, তাঁরা আমাদের শিখিয়েছেন বর্ণমালা, ধারাপাত কিংবা মানুষ হওয়ার মন্ত্র। সেই মন্ত্র নিশ্চয়ই আমরা মনে রাখিনি। আমাদেরই কেউ কেউ বরং বড় হয়ে রাষ্ট্রের কাছে শিখেছে পুলিশ কিংবা পুলিশদের মন্ত্রী হওয়ার মন্ত্র! পুলিশের প্রধান কাজ ক্ষুব্ধ মানুষের হাত থেকে সরকারকে রক্ষা করা। পুলিশের দ্বিতীয় প্রধান কাজ এসব মানুষকে চিৎকার এমনকি আর্তনাদও না করতে দেওয়া। পুলিশের তৃতীয় প্রধান কাজ এঁদের হাড্ডি গুঁড়ো করে দেওয়া। জিরো টলারেন্স! 
পুলিশের মার খেয়ে আহত হয়েছেন কয়েকজন। হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরে মারা গেছেন লাঞ্ছিত একজন শিক্ষক। এই শিক্ষক মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। ৪১ বছর আগে দেশকে স্বাধীন করার জন্য তিনি যুদ্ধ করেছেন। ৪১ বছর পর তাঁরই গড়া স্বাধীন দেশের পুলিশের হাতে লাঞ্ছিত হয়েছেন তিনি। এই দুঃসহ গ্লানি বহন করা হয়তো সম্ভব ছিল না তাঁর! তিনি চলে গেছেন অন্য এক ভুবনে। 
নিশ্চয়ই তাঁর এভাবে মরে যাওয়া উচিত হয়নি, ভুখানাঙা শিক্ষকদের সঙ্গে থাকাও উচিত হয়নি। তাঁর থাকা উচিত ছিল সমুদ্রজয়ের সমাবেশে কিংবা হরতালবিরোধী মিছিলে! তাই তাঁর মৃত্যুতে কোনো মন্ত্রী দুঃখ প্রকাশ করেননি, বুদ্ধিজীবীরা বিবৃতি দেননি, কেউ আদালতে রুল চাইতে যাননি! তিনি যখন হাসপাতালে, এমনকি আমাদের ‘প্রলেতারিয়েত’ শিক্ষামন্ত্রী তাঁকে দেখতেও যাননি। 
এই ‘বোকা’ শিক্ষককে নিয়ে আর কিছু লেখার মতো নেই! আমার বরং ছোটবেলার স্যারদের কথা মনে পড়ছে বেশি। পড়াশোনা না করলে, দুষ্টুমি করলে রাগে কাঁপতে থাকতেন তাঁদের কেউ কেউ। বাংলাদেশে তখনো সুশীল সমাজের জন্ম হয়নি। রেগে গেলে তাই শিক্ষকেরা পেটাতে পারতেন আমাদের। বেত দিয়ে পেটানোর সময় তৈয়ব স্যার গর্জে উঠতেন বারবার: মানুষ হবি না তোরা, মানুষ হবি না! 
শিক্ষকদের মার খেয়ে চামড়া জ্বলে উঠত। মাঝেমধ্যে একটু রাগ হতো। এত মারার কারণও বুঝতে পারতাম না। বহু বছর পর এখন মনে হচ্ছে, আমাদের সবাইকে আরও ভালো করে পেটানো উচিত ছিল তাঁদের! আরও গর্জে উঠে বলা উচিত ছিল: মানুষ হবি না? 
পুলিশের লাঠির চেয়ে শিক্ষকের বেত অনেক মহৎ। কিন্তু এই রাষ্ট্র কেমন করে যেন বদলে গেছে। শিক্ষকের বেত উঠে যাচ্ছে, পুলিশের লাঠি বাড়ছে! সেই লাঠি পড়ছে তাদেরই একসময়ের শিক্ষকদের ওপর! 
 আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন