আসিফ নজরুল | তারিখ: ০৭-১১-২০১২
বিএনপি
সম্পর্কে বিদেশিদের আপত্তি প্রধানত দুটো। এক. বিএনপির আমলে জঙ্গিবাদী
রাজনীতির প্রসার ঘটে। দুই. বিএনপির শেষ আমলে ভারতীয় বিভিন্ন
বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীকে প্রশ্রয় দেওয়া হয়েছিল। প্রথম কারণে বিএনপির প্রতি
রুষ্ট ছিল আমেরিকা, ইউরোপ আর ভারত। দ্বিতীয় কারণে প্রধানত ভারত। গত আমলে
বিএনপির সরকার কোনো এক বিচিত্র কারণে তাইওয়ানের একটি বাণিজ্যিক অফিস খোলার
অনুমতি দিলে বিএনপির ‘ন্যাচারাল এলাই’ চীনও রুষ্ট হয়ে ওঠে। বিএনপি-জামায়াত
জোট সরকার সম্পর্ক অটুট রাখতে পেরেছিল কেবল পাকিস্তান, সৌদি আরবসহ মুসলিম
বিশ্বের সঙ্গে, আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক অঙ্গনে যাদের প্রভাব ক্রমেই ক্ষীয়মাণ।
বিএনপি তাই এখন মরিয়া হয়ে উঠেছে প্রভাবশালী আন্তর্জাতিক মহলের সঙ্গে
সম্পর্কোন্নয়নের জন্য। ভবিষ্যতে ক্ষমতায় যেতে হলে শুধু জনসমর্থন যথেষ্ট নয়,
এদের সহায়তাও লাগবে, এটা বিএনপির উপলব্ধি না করার কথা নয়।
শক্তিশালী প্রতিবেশী ও মুরব্বিদের উপেক্ষা করে এই যুগে ক্ষমতায় থাকার বা ক্ষমতায় আসার নজির কম। ইরানে আহমাদিনেজাদ আর উত্তর কোরিয়ার কিম ইল সুংয়ের পরিবার তা পারছেন শক্ত জাতীয় ঐক্য, আদর্শবাদ আর মোটামুটি স্বনির্ভর অর্থনীতির কারণে। ভেনেজুয়েলায় হুগো চাভেজ পারছেন গোটা লাতিন আমেরিকায় মার্কিন সাম্রাজ্যবাদবিরোধী মনোভাব এবং তেলনির্ভর অর্থনীতির শক্তির কারণে। কিউবা টিকে আছে মূলত ফিদেল কাস্ত্রোর ব্যক্তিত্ব আর কিউবাবাসীর কৃচ্ছ্রমূলক আত্মত্যাগের কারণে। এই দেশগুলোর ওপরও খবরদারির চেষ্টা চলছে নিরাপত্তার নানা অজুহাতে। পারমাণবিক অস্ত্র থাকার কারণে উত্তর কোরিয়া তা উপেক্ষা করে চললেও অন্যদের পক্ষে সেটি আরও বহু বছর পর্যন্ত হয়তো সম্ভব হবে না।
আগে একটা সময় ছিল যখন আন্তর্জাতিক আধিপত্যবাদের মূল কারণ ছিল অর্থনৈতিক—জ্বালানি, অস্ত্র, অবকাঠামোভিত্তিক ব্যবসা আর আন্তর্জাতিক পুঁজির আধিপত্য বিস্তার। সোভিয়েত যুগে রাজনৈতিক আদর্শের আধিপত্যের লড়াইও জোরদার ছিল। এখন নাইন-ইলেভেনের পর আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অন্যতম নির্ণায়ক হয়ে উঠেছে নিরাপত্তা ইস্যু। জাতীয়, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক নিরাপত্তা একই সূত্রে গাঁথা, এই তত্ত্ব দুর্বল দেশগুলোতে আন্তর্জাতিক খবরদারির একধরনের নৈতিক যৌক্তিকতা সৃষ্টি করেছে। বিএনপির সরকারের আমলে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ বা ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের প্রশ্রয় প্রদান বাংলাদেশের রাজনীতিতে আন্তর্জাতিক খবরদারির সুযোগকে আরও প্রসারিত করেছে এবং একই সঙ্গে বিএনপিকে মিত্র হিসেবে অগ্রহণযোগ্য করে তুলেছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে খালেদা জিয়ার জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে বিএনপিকে উদার না হোক, অন্তত মধ্যপন্থী গণতান্ত্রিক দল হিসেবে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলা।
খালেদা জিয়ার গত বছরের আমেরিকা সফর এ ক্ষেত্রে তেমন কোনো সাফল্য বয়ে আনতে পারেনি। তিনি প্রভাবশালী কোনো মার্কিন নেতার সাক্ষাৎ পর্যন্ত লাভ করতে পারেননি। কিন্তু ২০১২ একটি ভিন্ন বছর হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে বাংলাদেশের রাজনীতিতে। এ বছর বিএনপির বিভিন্ন কর্মসূচিতে বিশাল জনসমাগম, দুর্নীতি, আইনশৃঙ্খলা ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সরকারের একের পর এক ব্যর্থতা, ভারত বাদে বাকি প্রায় সব প্রভাবশালী আন্তর্জাতিক মহলের সঙ্গে সরকারের সম্পর্কের অবনতিসহ বিভিন্ন কারণে আন্তর্জাতিক বিশ্বে দুই দলের গ্রহণযোগ্যতা কিছুটা হলেও পরিবর্তিত হয়েছে। এ বছর প্রণব মুখার্জির সফরের সময় ভারত কোনো দলের সঙ্গে নয়, বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্বে বিশ্বাসী—এই মন্তব্য ছিল তার একটি বড় প্রমাণ। খালেদা জিয়া ভারত সফরের আমন্ত্রণ পেয়েছিলেন তখনই। ভারতে যাওয়ার আগে তিনি চীন সফর করলেন, এটা কৌশলগতভাবে ভুল কি না, তা নিয়েও আলোচনা ছিল।
খালেদা জিয়ার চীন সফর অবশ্য অসফল হয়নি। চীন বিএনপির সরকারের আমলে সড়ক, সেতু এবং বিভিন্ন অবকাঠামো উন্নয়নে লক্ষণীয় ভূমিকা রেখেছিল। বিএনপির নেত্রী ভবিষ্যতে যে চারটি ক্ষেত্রে চীনের অর্থনৈতিক ও কারিগরি সহায়তা চেয়েছেন, তা জাতীয় প্রবৃদ্ধির জন্য আরও গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। প্রথম পদ্মা সেতুর অনিশ্চয়তার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি দ্বিতীয় পদ্মা সেতু নির্মাণ, সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ, মিয়ানমারের ভেতর দিয়ে চীনের কুনমিংয়ের সঙ্গে সড়ক ও রেল-যোগাযোগ এবং দেশের ভেতরের সড়ক কাঠামোর সার্বিক ও সমন্বিত উন্নয়নের জন্য চীনা সহযোগিতার আশ্বাস পেয়েছেন। সহযোগিতার সঠিক ক্ষেত্র নির্ধারণ এবং তাতে চীনা আশ্বাসপ্রাপ্তিই আপাতত তাঁর বড়
সাফল্য। তবে তাঁর চীন সফর ভারত কী চোখে দেখছে, তা পর্যবেক্ষক মহলের কাছে ছিল কৌতূহলের বিষয়।
আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, ভারত স্বতন্ত্রভাবেই খালেদা জিয়ার সফরকে মূল্যায়ন করেছে। ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ‘আর কখনো’ বাংলাদেশের মাটি ব্যবহার করতে না দেওয়া-সংক্রান্ত খালেদা জিয়ার ঘোষণা ভারতীয় নীতিনির্ধারকদের জন্য সবচেয়ে আশাপ্রদ বিষয় বলে বিবেচিত হচ্ছে। খালেদা জিয়ার এই ঘোষণায় প্রচ্ছন্নভাবে হলেও ভুলের স্বীকারোক্তি আছে বলে তা আন্তরিক বলে অনেকে মনে করছেন। ভারতীয় শিক্ষাবিদ ও নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে আমার সামান্য আলোচনার অভিজ্ঞতা থেকে জানি, বাংলাদেশের কাছে ভারতের সবচেয়ে বড় প্রত্যাশা এটিই। বিচ্ছিন্নতাবাদ শুধু ভারতের অখণ্ডতার জন্য হুমকি নয়, এটি ভারতের সামরিক ব্যয় এবং কৌশলগত অনিশ্চয়তাও বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়। ভারত নিজেও একসময় বাংলাদেশের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের প্রশ্রয় দিয়েছিল। শেখ হাসিনার প্রথম আমলে পার্বত্য চুক্তির পর অবস্থা পরিবর্তন হলেও পরের বিএনপির আমলে কেন এই সর্বনাশা খেলায় বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার মেতে উঠেছিল, কারা এতে জড়িত ছিল, তা বিএনপির নেত্রীর গভীরভাবে খতিয়ে দেখা উচিত। পুনরায় ক্ষমতায় এলে ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদী এবং জঙ্গিদের উত্থানের পেছনে বিএনপি বা জামায়াতের যে অংশের মদদ ছিল, তাদের ক্ষমতাবলয় থেকে দূরে রাখা এবং প্রয়োজনে কঠোরভাবে দমন করার মতো দৃঢ়তা তাঁর অবশ্যই থাকা উচিত।
ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের এই বিষফোড়ার সমাধান কঠিন কাজ নয়। এ জন্য স্রেফ আন্তরিকতাই যথেষ্ট। দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে অন্যান্য ইস্যুর সমাধান বরং অনেক জটিলতাপূর্ণ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার সর্বোচ্চ আন্তরিকতা সত্ত্বেও সীমান্তে হত্যাকাণ্ড, অভিন্ন নদীর পানি ভাগাভাগি এবং ট্রানজিট সমস্যার সমাধান করতে পারেনি। সম্ভবত তাঁর সরকারের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা ছিল একতরফাভাবে প্রথমেই প্রায় সবকিছু প্রদান করা, ব্যক্তি সম্পর্ক আর রাষ্ট্রীয় সম্পর্কের বিস্তর ব্যবধান বোঝার অক্ষমতা এবং অন্য প্রভাবশালী আন্তর্জাতিক মহলগুলোর সঙ্গে সম্পর্কের গুরুত্বকে খাটো করে দেখা। প্রশ্ন হচ্ছে, তুলনামূলকভাবে অগভীর মৈত্রী সম্পর্ক নিয়ে বিএনপির সরকার কি পারবে এসব ক্ষেত্রে দেশের স্বার্থ রক্ষা করতে? এসব ইস্যুতে আওয়ামী লীগ সরকারের নিরন্তর সমালোচনার পর ভারতের কাছ থেকে শ্রেয়তর কোনো সমাধান অর্জনের কর্মকৌশল কি রয়েছে বিএনপির? একই সঙ্গে দেশের স্বার্থ এবং ভারতের সঙ্গে সত্যিকারের বন্ধুত্ব রক্ষা করার ক্ষেত্রে আজ পর্যন্ত বাংলাদেশের কোনো
সরকার উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করতে পারেনি। বিএনপি কেন তা পারবে, সেটি পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করতে না পারলে ভারত ও ভোটার—দুই পক্ষই সন্দিহান থাকবে তাদের প্রতি।
তার আগে বিএনপিকে নিশ্চিত করতে হবে যে আগামী নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এ জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার না হলেও অন্তত গ্রহণযোগ্য কাঠামোর একটি সর্বদলীয় সরকার এবং নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের দাবি বিএনপিকে আদায় করতে হবে। অবস্থাদৃষ্টে এটি পরিষ্কার যে রাজপথে তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলে সরকারকে বাধ্য না করাতে পারলে এই দাবিগুলো আদায় করা যাবে না। জনমত এখন বিএনপির পক্ষে হয়তো রয়েছে, কিন্তু তাকে যৌক্তিক পরিণতির দিকে নিয়ে যাওয়ার মতো সাংগঠনিক ও নেতৃত্বের দৃঢ়তা বিএনপির আছে কি? ২১ নভেম্বর সমাবেশের পর থেকে আন্দোলন তীব্রতর করার দিকে বিএনপি এগোতে থাকলে মামলা-হামলাসহ নানা ধরনের দমনমূলক পদক্ষেপ সরকার গ্রহণ করতে পারে। বিএনপিকে কোনোভাবেই ক্ষমতায় আসতে না দিতে সরকার মরিয়া হয়ে উঠলে রাজপথে অরাজকতামূলক পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। আশঙ্কা রয়েছে যে এমন অবস্থায় গণতন্ত্র এবং আগামী নির্বাচন পর্যন্ত বিপন্ন হতে পারে।
যতই ঝুঁকি থাক, জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠানের দাবি আদায়ের জন্য আগামী কয়েক মাসই সম্ভবত শেষ সুযোগ বিএনপির জন্য। এ সময় সরকার বসে থাকবে না। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন করে, ভারতের সঙ্গে তিস্তা চুক্তি সম্পাদন করে, শেয়ারবাজার চাঙা করে এবং কিছু দুর্নীতির বিষয়ে ব্যবস্থা নিয়ে শেষ সময়ে জনসমর্থন পুনরুদ্ধারের চেষ্টা সরকার করবে। একই সঙ্গে ১০ ট্রাক অস্ত্র, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা ও জিয়া অরফানেজ মামলায় কিছু বিচারিক পদক্ষেপ গ্রহণ করে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বকে চাপে ফেলার চিন্তাও সরকারের থাকবে।
‘ভারত জয়’ মানেই তাই ক্ষমতায় চলে আসা নয়। আমেরিকার আশীর্বাদ মানেও ক্ষমতার কাছাকাছি চলে যাওয়া নয়। বিএনপি নির্বাচনে জিতে এসে এ দুটো দেশের প্রতি হুমকিস্বরূপ কোনো কাজ করবে না, এই নিশ্চয়তা সৃষ্টি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের একটি শর্ত মাত্র। কিন্তু এটি সম্ভব করার আসল কাজটি করতে হবে দেশের জনগণকে সঙ্গে নিয়ে। বিএনপি যদি আগামী কয়েক মাসে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তুলতে পারে, বিএনপি ও তার জোটের মৌলবাদী ও হঠকারী গোষ্ঠীকে যদি খালেদা জিয়া কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেন, সরকারের পরিবর্তন হলে আগের আমলের ভুলগুলোর পুনরাবৃত্তি হবে না—এমন বিশ্বাস যদি তিনি মানুষের মনে স্থাপন করতে পারেন, তা হলেই কেবল বিএনপি পুনরায় ক্ষমতায় আসতে পারে। তা না হলে খালেদা জিয়ার বিদেশ সফরের সাফল্য কাগুজে সাফল্য হিসেবেই থেকে যাবে।
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
শক্তিশালী প্রতিবেশী ও মুরব্বিদের উপেক্ষা করে এই যুগে ক্ষমতায় থাকার বা ক্ষমতায় আসার নজির কম। ইরানে আহমাদিনেজাদ আর উত্তর কোরিয়ার কিম ইল সুংয়ের পরিবার তা পারছেন শক্ত জাতীয় ঐক্য, আদর্শবাদ আর মোটামুটি স্বনির্ভর অর্থনীতির কারণে। ভেনেজুয়েলায় হুগো চাভেজ পারছেন গোটা লাতিন আমেরিকায় মার্কিন সাম্রাজ্যবাদবিরোধী মনোভাব এবং তেলনির্ভর অর্থনীতির শক্তির কারণে। কিউবা টিকে আছে মূলত ফিদেল কাস্ত্রোর ব্যক্তিত্ব আর কিউবাবাসীর কৃচ্ছ্রমূলক আত্মত্যাগের কারণে। এই দেশগুলোর ওপরও খবরদারির চেষ্টা চলছে নিরাপত্তার নানা অজুহাতে। পারমাণবিক অস্ত্র থাকার কারণে উত্তর কোরিয়া তা উপেক্ষা করে চললেও অন্যদের পক্ষে সেটি আরও বহু বছর পর্যন্ত হয়তো সম্ভব হবে না।
আগে একটা সময় ছিল যখন আন্তর্জাতিক আধিপত্যবাদের মূল কারণ ছিল অর্থনৈতিক—জ্বালানি, অস্ত্র, অবকাঠামোভিত্তিক ব্যবসা আর আন্তর্জাতিক পুঁজির আধিপত্য বিস্তার। সোভিয়েত যুগে রাজনৈতিক আদর্শের আধিপত্যের লড়াইও জোরদার ছিল। এখন নাইন-ইলেভেনের পর আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অন্যতম নির্ণায়ক হয়ে উঠেছে নিরাপত্তা ইস্যু। জাতীয়, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক নিরাপত্তা একই সূত্রে গাঁথা, এই তত্ত্ব দুর্বল দেশগুলোতে আন্তর্জাতিক খবরদারির একধরনের নৈতিক যৌক্তিকতা সৃষ্টি করেছে। বিএনপির সরকারের আমলে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ বা ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের প্রশ্রয় প্রদান বাংলাদেশের রাজনীতিতে আন্তর্জাতিক খবরদারির সুযোগকে আরও প্রসারিত করেছে এবং একই সঙ্গে বিএনপিকে মিত্র হিসেবে অগ্রহণযোগ্য করে তুলেছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে খালেদা জিয়ার জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে বিএনপিকে উদার না হোক, অন্তত মধ্যপন্থী গণতান্ত্রিক দল হিসেবে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলা।
খালেদা জিয়ার গত বছরের আমেরিকা সফর এ ক্ষেত্রে তেমন কোনো সাফল্য বয়ে আনতে পারেনি। তিনি প্রভাবশালী কোনো মার্কিন নেতার সাক্ষাৎ পর্যন্ত লাভ করতে পারেননি। কিন্তু ২০১২ একটি ভিন্ন বছর হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে বাংলাদেশের রাজনীতিতে। এ বছর বিএনপির বিভিন্ন কর্মসূচিতে বিশাল জনসমাগম, দুর্নীতি, আইনশৃঙ্খলা ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সরকারের একের পর এক ব্যর্থতা, ভারত বাদে বাকি প্রায় সব প্রভাবশালী আন্তর্জাতিক মহলের সঙ্গে সরকারের সম্পর্কের অবনতিসহ বিভিন্ন কারণে আন্তর্জাতিক বিশ্বে দুই দলের গ্রহণযোগ্যতা কিছুটা হলেও পরিবর্তিত হয়েছে। এ বছর প্রণব মুখার্জির সফরের সময় ভারত কোনো দলের সঙ্গে নয়, বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্বে বিশ্বাসী—এই মন্তব্য ছিল তার একটি বড় প্রমাণ। খালেদা জিয়া ভারত সফরের আমন্ত্রণ পেয়েছিলেন তখনই। ভারতে যাওয়ার আগে তিনি চীন সফর করলেন, এটা কৌশলগতভাবে ভুল কি না, তা নিয়েও আলোচনা ছিল।
খালেদা জিয়ার চীন সফর অবশ্য অসফল হয়নি। চীন বিএনপির সরকারের আমলে সড়ক, সেতু এবং বিভিন্ন অবকাঠামো উন্নয়নে লক্ষণীয় ভূমিকা রেখেছিল। বিএনপির নেত্রী ভবিষ্যতে যে চারটি ক্ষেত্রে চীনের অর্থনৈতিক ও কারিগরি সহায়তা চেয়েছেন, তা জাতীয় প্রবৃদ্ধির জন্য আরও গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। প্রথম পদ্মা সেতুর অনিশ্চয়তার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি দ্বিতীয় পদ্মা সেতু নির্মাণ, সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ, মিয়ানমারের ভেতর দিয়ে চীনের কুনমিংয়ের সঙ্গে সড়ক ও রেল-যোগাযোগ এবং দেশের ভেতরের সড়ক কাঠামোর সার্বিক ও সমন্বিত উন্নয়নের জন্য চীনা সহযোগিতার আশ্বাস পেয়েছেন। সহযোগিতার সঠিক ক্ষেত্র নির্ধারণ এবং তাতে চীনা আশ্বাসপ্রাপ্তিই আপাতত তাঁর বড়
সাফল্য। তবে তাঁর চীন সফর ভারত কী চোখে দেখছে, তা পর্যবেক্ষক মহলের কাছে ছিল কৌতূহলের বিষয়।
আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, ভারত স্বতন্ত্রভাবেই খালেদা জিয়ার সফরকে মূল্যায়ন করেছে। ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ‘আর কখনো’ বাংলাদেশের মাটি ব্যবহার করতে না দেওয়া-সংক্রান্ত খালেদা জিয়ার ঘোষণা ভারতীয় নীতিনির্ধারকদের জন্য সবচেয়ে আশাপ্রদ বিষয় বলে বিবেচিত হচ্ছে। খালেদা জিয়ার এই ঘোষণায় প্রচ্ছন্নভাবে হলেও ভুলের স্বীকারোক্তি আছে বলে তা আন্তরিক বলে অনেকে মনে করছেন। ভারতীয় শিক্ষাবিদ ও নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে আমার সামান্য আলোচনার অভিজ্ঞতা থেকে জানি, বাংলাদেশের কাছে ভারতের সবচেয়ে বড় প্রত্যাশা এটিই। বিচ্ছিন্নতাবাদ শুধু ভারতের অখণ্ডতার জন্য হুমকি নয়, এটি ভারতের সামরিক ব্যয় এবং কৌশলগত অনিশ্চয়তাও বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়। ভারত নিজেও একসময় বাংলাদেশের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের প্রশ্রয় দিয়েছিল। শেখ হাসিনার প্রথম আমলে পার্বত্য চুক্তির পর অবস্থা পরিবর্তন হলেও পরের বিএনপির আমলে কেন এই সর্বনাশা খেলায় বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার মেতে উঠেছিল, কারা এতে জড়িত ছিল, তা বিএনপির নেত্রীর গভীরভাবে খতিয়ে দেখা উচিত। পুনরায় ক্ষমতায় এলে ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদী এবং জঙ্গিদের উত্থানের পেছনে বিএনপি বা জামায়াতের যে অংশের মদদ ছিল, তাদের ক্ষমতাবলয় থেকে দূরে রাখা এবং প্রয়োজনে কঠোরভাবে দমন করার মতো দৃঢ়তা তাঁর অবশ্যই থাকা উচিত।
ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের এই বিষফোড়ার সমাধান কঠিন কাজ নয়। এ জন্য স্রেফ আন্তরিকতাই যথেষ্ট। দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে অন্যান্য ইস্যুর সমাধান বরং অনেক জটিলতাপূর্ণ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার সর্বোচ্চ আন্তরিকতা সত্ত্বেও সীমান্তে হত্যাকাণ্ড, অভিন্ন নদীর পানি ভাগাভাগি এবং ট্রানজিট সমস্যার সমাধান করতে পারেনি। সম্ভবত তাঁর সরকারের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা ছিল একতরফাভাবে প্রথমেই প্রায় সবকিছু প্রদান করা, ব্যক্তি সম্পর্ক আর রাষ্ট্রীয় সম্পর্কের বিস্তর ব্যবধান বোঝার অক্ষমতা এবং অন্য প্রভাবশালী আন্তর্জাতিক মহলগুলোর সঙ্গে সম্পর্কের গুরুত্বকে খাটো করে দেখা। প্রশ্ন হচ্ছে, তুলনামূলকভাবে অগভীর মৈত্রী সম্পর্ক নিয়ে বিএনপির সরকার কি পারবে এসব ক্ষেত্রে দেশের স্বার্থ রক্ষা করতে? এসব ইস্যুতে আওয়ামী লীগ সরকারের নিরন্তর সমালোচনার পর ভারতের কাছ থেকে শ্রেয়তর কোনো সমাধান অর্জনের কর্মকৌশল কি রয়েছে বিএনপির? একই সঙ্গে দেশের স্বার্থ এবং ভারতের সঙ্গে সত্যিকারের বন্ধুত্ব রক্ষা করার ক্ষেত্রে আজ পর্যন্ত বাংলাদেশের কোনো
সরকার উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করতে পারেনি। বিএনপি কেন তা পারবে, সেটি পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করতে না পারলে ভারত ও ভোটার—দুই পক্ষই সন্দিহান থাকবে তাদের প্রতি।
তার আগে বিএনপিকে নিশ্চিত করতে হবে যে আগামী নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এ জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার না হলেও অন্তত গ্রহণযোগ্য কাঠামোর একটি সর্বদলীয় সরকার এবং নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের দাবি বিএনপিকে আদায় করতে হবে। অবস্থাদৃষ্টে এটি পরিষ্কার যে রাজপথে তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলে সরকারকে বাধ্য না করাতে পারলে এই দাবিগুলো আদায় করা যাবে না। জনমত এখন বিএনপির পক্ষে হয়তো রয়েছে, কিন্তু তাকে যৌক্তিক পরিণতির দিকে নিয়ে যাওয়ার মতো সাংগঠনিক ও নেতৃত্বের দৃঢ়তা বিএনপির আছে কি? ২১ নভেম্বর সমাবেশের পর থেকে আন্দোলন তীব্রতর করার দিকে বিএনপি এগোতে থাকলে মামলা-হামলাসহ নানা ধরনের দমনমূলক পদক্ষেপ সরকার গ্রহণ করতে পারে। বিএনপিকে কোনোভাবেই ক্ষমতায় আসতে না দিতে সরকার মরিয়া হয়ে উঠলে রাজপথে অরাজকতামূলক পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। আশঙ্কা রয়েছে যে এমন অবস্থায় গণতন্ত্র এবং আগামী নির্বাচন পর্যন্ত বিপন্ন হতে পারে।
যতই ঝুঁকি থাক, জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠানের দাবি আদায়ের জন্য আগামী কয়েক মাসই সম্ভবত শেষ সুযোগ বিএনপির জন্য। এ সময় সরকার বসে থাকবে না। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন করে, ভারতের সঙ্গে তিস্তা চুক্তি সম্পাদন করে, শেয়ারবাজার চাঙা করে এবং কিছু দুর্নীতির বিষয়ে ব্যবস্থা নিয়ে শেষ সময়ে জনসমর্থন পুনরুদ্ধারের চেষ্টা সরকার করবে। একই সঙ্গে ১০ ট্রাক অস্ত্র, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা ও জিয়া অরফানেজ মামলায় কিছু বিচারিক পদক্ষেপ গ্রহণ করে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বকে চাপে ফেলার চিন্তাও সরকারের থাকবে।
‘ভারত জয়’ মানেই তাই ক্ষমতায় চলে আসা নয়। আমেরিকার আশীর্বাদ মানেও ক্ষমতার কাছাকাছি চলে যাওয়া নয়। বিএনপি নির্বাচনে জিতে এসে এ দুটো দেশের প্রতি হুমকিস্বরূপ কোনো কাজ করবে না, এই নিশ্চয়তা সৃষ্টি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের একটি শর্ত মাত্র। কিন্তু এটি সম্ভব করার আসল কাজটি করতে হবে দেশের জনগণকে সঙ্গে নিয়ে। বিএনপি যদি আগামী কয়েক মাসে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তুলতে পারে, বিএনপি ও তার জোটের মৌলবাদী ও হঠকারী গোষ্ঠীকে যদি খালেদা জিয়া কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেন, সরকারের পরিবর্তন হলে আগের আমলের ভুলগুলোর পুনরাবৃত্তি হবে না—এমন বিশ্বাস যদি তিনি মানুষের মনে স্থাপন করতে পারেন, তা হলেই কেবল বিএনপি পুনরায় ক্ষমতায় আসতে পারে। তা না হলে খালেদা জিয়ার বিদেশ সফরের সাফল্য কাগুজে সাফল্য হিসেবেই থেকে যাবে।
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।