পৃষ্ঠাসমূহ

শুক্রবার, ১৮ মে, ২০১২

শিক্ষকের বেত পুলিশের লাঠি

ক্লাস শেষ করে ফিরছি আমার রুমে। সায়েন্স এনেক্সের নিচতলার লম্বা করিডর ধরে এগোচ্ছি। দেখি ওপরে যাওয়ার সিঁড়ির কাছে মেঝেতে বসে আছেন চারজন মানুষ। দীনহীন, ক্লান্ত শরীর, জরাজীর্ণ পোশাক-আশাক। হাতের পলিথিনের পোঁটলা খুলে চিড়া আর গুড় বের করছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের করিডর দুপুরের খাওয়ার জায়গা না। তাই হয়তো ভীতসন্ত্রস্ত চোখে দেখছেন চারদিক। তাঁদের পাশ কাটিয়ে এগোই। হঠাৎ আমার সন্দেহ হয়। একটু পিছিয়ে এসে বলি, আপনারা শিক্ষক? তাঁরা মাথা নাড়েন। শহীদ মিনারে প্রখর রোদে বসে আন্দোলন করছেন তাঁরা দুই দিন ধরে। এখানে একটু ছায়া কিংবা দেয়ালঘেরা জায়গা দেখে খেতে এসেছেন। খোলা একটা ক্লাসরুমে দেখিয়ে তাঁদের অনুনয় করি: প্লিজ, আপনারা ওখানে বসে খান। তাঁরা যতটা খুশি হন, তারচেয়ে বেশি দ্বিধান্বিত। নিজের পরিচয় দিই, বলি কেউ আপনাদের কিছু বলবে না, ওখানে বসে খান।
তাঁরা উঠে দাঁড়ান, আমি পালিয়ে বাঁচি! চিড়া-গুড় খেয়ে, রোদে পুড়ে, খোলা জায়গায় শুয়ে তাঁরা কত দিন আন্দোলন করবেন? প্রতিবছর এই সময়টাতে তাঁদের দেখি শহীদ মিনারে। কোনো বছরই তাঁদের আর্তনাদ পৌঁছায় না কারও কাছে। কখনো বক্তৃতা, কখনো গান গেয়ে প্রধানমন্ত্রীকে কত কিছু স্মরণ করাতে চান তাঁরা। তিনি জাতির জনকের কন্যা, তিনি শিক্ষকদের দাবি পূরণের ওয়াদা করেছিলেন, তিনিও কেমন করে ভুলে যান তাঁদের! গানের কথা ছাপিয়ে যায় কান্নার জলোচ্ছ্বাসে। হায়রে! এই দেশে প্রধানমন্ত্রীদের কানে কেউ পৌঁছায় দেয় না এসব?
আমি রিকশায় করে পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় দেখি তাঁদের। একজন মাথায় কম চুলের তৈয়ব স্যার। একজন ঘুম-ঘুম চোখের মজিদ স্যার। ঘন-কালো চুলের ফিরোজ স্যার, লম্বা দাড়ির ইসলামিয়াত স্যার। সবাই আছেন এখানে। ৪০ বছর আগে সাভার প্রাইমারি স্কুলে যাঁরা আমাকে পড়তে শিখিয়েছেন, সে রকম শত শত তৈয়ব স্যার, মজিদ স্যারদের দেখি। বেতন-ভাতা নিয়মিত করানোর জন্য, সামান্য কিছুটা বাড়ানোর জন্য কত বছর ধরে তাঁরা দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে আসেন শহীদ মিনারে। রাজা যায়, রাজা আসে। বাজারে আগুন লাগে, তাঁদের অভাবের সংসার ক্রমেই ছাই হতে থাকে। কারও কানে পৌঁছায় না তাঁদের আর্তনাদ। 
তাই হয়তো শিক্ষকেরা অবশেষে রওনা হন প্রধানমন্ত্রীর অফিসের দিকে। তাঁরা শেয়ারবাজার লুট করেননি, মানুষের টাকা মেরে দেননি, কাউকে গুম করেননি, কারও স্বপ্ন খুন করেননি। তাঁরা বিএনপি না, তাঁরা জামায়াতও না। তাঁদের হাতে ককটেল নেই, লগি-বৈঠা নেই, বাহুতে ঢিল মারার শক্তিও নেই। তাঁরা আগুন দিতে যাননি, গালি দিতে যাননি, এমনকি স্লোগান দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর অফিসের শান্তিও নষ্ট করতে যাননি। তাঁরা শুধু তাঁদের অভাব-অভিযোগের কথা লেখা একটি কাগজ প্রধানমন্ত্রীর অফিসে পৌঁছে দিতে চেয়েছিলেন।
পুলিশ তাতেই দানব হয়ে ওঠে। ১৫ মে ২০১২। শাহবাগে জলকামানের তোড়ে রাস্তায় উল্টে পড়েন বৃদ্ধ, শীর্ণ কিংবা ক্লান্ত শিক্ষক। মোটা লাঠি হাতে পিটিয়ে রক্তাক্ত করা হয় কয়েকজনকে। ঘাড় ধরে কংক্রিটের রাস্তায় টেনেহিঁচড়ে তোলা হয় পুলিশের গাড়িতে। তাঁরা আমাদের প্রথম শিক্ষক, তাঁরা আমাদের শিখিয়েছেন বর্ণমালা, ধারাপাত কিংবা মানুষ হওয়ার মন্ত্র। সেই মন্ত্র নিশ্চয়ই আমরা মনে রাখিনি। আমাদেরই কেউ কেউ বরং বড় হয়ে রাষ্ট্রের কাছে শিখেছে পুলিশ কিংবা পুলিশদের মন্ত্রী হওয়ার মন্ত্র! পুলিশের প্রধান কাজ ক্ষুব্ধ মানুষের হাত থেকে সরকারকে রক্ষা করা। পুলিশের দ্বিতীয় প্রধান কাজ এসব মানুষকে চিৎকার এমনকি আর্তনাদও না করতে দেওয়া। পুলিশের তৃতীয় প্রধান কাজ এঁদের হাড্ডি গুঁড়ো করে দেওয়া। জিরো টলারেন্স! 
পুলিশের মার খেয়ে আহত হয়েছেন কয়েকজন। হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরে মারা গেছেন লাঞ্ছিত একজন শিক্ষক। এই শিক্ষক মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। ৪১ বছর আগে দেশকে স্বাধীন করার জন্য তিনি যুদ্ধ করেছেন। ৪১ বছর পর তাঁরই গড়া স্বাধীন দেশের পুলিশের হাতে লাঞ্ছিত হয়েছেন তিনি। এই দুঃসহ গ্লানি বহন করা হয়তো সম্ভব ছিল না তাঁর! তিনি চলে গেছেন অন্য এক ভুবনে। 
নিশ্চয়ই তাঁর এভাবে মরে যাওয়া উচিত হয়নি, ভুখানাঙা শিক্ষকদের সঙ্গে থাকাও উচিত হয়নি। তাঁর থাকা উচিত ছিল সমুদ্রজয়ের সমাবেশে কিংবা হরতালবিরোধী মিছিলে! তাই তাঁর মৃত্যুতে কোনো মন্ত্রী দুঃখ প্রকাশ করেননি, বুদ্ধিজীবীরা বিবৃতি দেননি, কেউ আদালতে রুল চাইতে যাননি! তিনি যখন হাসপাতালে, এমনকি আমাদের ‘প্রলেতারিয়েত’ শিক্ষামন্ত্রী তাঁকে দেখতেও যাননি। 
এই ‘বোকা’ শিক্ষককে নিয়ে আর কিছু লেখার মতো নেই! আমার বরং ছোটবেলার স্যারদের কথা মনে পড়ছে বেশি। পড়াশোনা না করলে, দুষ্টুমি করলে রাগে কাঁপতে থাকতেন তাঁদের কেউ কেউ। বাংলাদেশে তখনো সুশীল সমাজের জন্ম হয়নি। রেগে গেলে তাই শিক্ষকেরা পেটাতে পারতেন আমাদের। বেত দিয়ে পেটানোর সময় তৈয়ব স্যার গর্জে উঠতেন বারবার: মানুষ হবি না তোরা, মানুষ হবি না! 
শিক্ষকদের মার খেয়ে চামড়া জ্বলে উঠত। মাঝেমধ্যে একটু রাগ হতো। এত মারার কারণও বুঝতে পারতাম না। বহু বছর পর এখন মনে হচ্ছে, আমাদের সবাইকে আরও ভালো করে পেটানো উচিত ছিল তাঁদের! আরও গর্জে উঠে বলা উচিত ছিল: মানুষ হবি না? 
পুলিশের লাঠির চেয়ে শিক্ষকের বেত অনেক মহৎ। কিন্তু এই রাষ্ট্র কেমন করে যেন বদলে গেছে। শিক্ষকের বেত উঠে যাচ্ছে, পুলিশের লাঠি বাড়ছে! সেই লাঠি পড়ছে তাদেরই একসময়ের শিক্ষকদের ওপর! 
 আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

বৃহস্পতিবার, ১০ মে, ২০১২

তিস্তা চুক্তি নিয়ে সংশয়



আ সি ফ ন জ রুল

 লঅবশেষে ভারতীয়রা আমাদের জানিয়ে দিল, তিস্তা চুক্তি অচিরেই হ”েছ না। হ”েছ না যে তার বড় কারণ বাংলাদেশের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর অব¯’ান ভারতের কাছে অধিক গুর“ত্ব পেয়েছে। ভারতীয় বি”িছন্নতাবাদীদের দমন, বাণিজ্য সুবিধা, ট্রানজিট, বিনা আপত্তিতে টিপাইমুখ মেনে নেয়ার মতো বহু কিছুতে ভারতের স্বার্থ রক্ষার পর ভারতের এই মনোভাব অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। এটি সরকারের একপেশে ভারতনীতির ব্যর্থতার একটি বড় উদাহরণও। তিস্তা নদীর পানি প্রধানত সেচকাজে ব্যবহারের জন্য ভারত জলপাইগুড়িতে গজলডোবায় এবং বাংলাদেশ লালমনিরহাটে তিস্তা (দালিয়া) ব্যারেজ নির্মাণ করেছে বহু বছর আগে। উজানের দেশ হওয়ায় ভারত আগেই ব্যারেজ ও সেচখালের মাধ্যমে পানি সরিয়ে ফেলায় বাংলাদেশের ব্যারেজটি শুষ্ক মৌসুমে অকার্যকর ও মূল্যহীন হয়ে পড়ে। আবার বর্ষা মৌসুমে এই পানি ভারত পুরোপুরি ছেড়ে দেয়ায় বাংলাদেশে বন্যা ও নদীভাঙনেরও সৃষ্টি হয়। দেশের উত্তরাঞ্চলের দারিদ্র্যদশা ঘোচানোর একটি বড় শর্ত হ”েছ তাই তিস্তায় ন্যায্য পানি প্রাপ্তি নিশ্চিত করা। তিস্তা নদী নিয়ে স্বাধীনতার পরপর আলোচনা শুর“ হলেও ১৯৮৩ সালে প্রথম একটি সমঝোতা হয়। এই সমঝোতা অনুসারে তিস্তার পানির ৩৯ শতাংশ ভারত ও ৩৬ শতাংশ বাংলাদেশের পাওয়ার কথা ছিল। বাকি ২৫ শতাংশের কতটুকু বাংলাদেশে ব্রহ্মপুত্র পর্যন্ত তিস্তার গতিপথকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য প্রয়োজন এবং এটি কিভাবে ভাগাভাগি হবে, তা নিয়ে পরে আরও আলোচনার কথা ছিল। এ আলোচনা কখনও আর সুসম্পন্ন হয়নি। ১৯৮৬ সালে জয়েন্ট কমিটি অব এক্সপার্টের সভায় বাংলাদেশ নদীর পানি ভাগাভাগির একটি সার্বিক রূপরেখা প্রদান করে। এতে বাংলাদেশ ব্রহ্মপুত্র নদের ৭৫ শতাংশ এবং তিস্তাসহ আটটি নদীর পানির ৫০ শতাংশ পানি দাবি করে। পরে বাংলাদেশ নির্দিষ্টভাবে ২০ শতাংশ পানি তিস্তার নাব্যতার জন্য রেখে দিয়ে বাকি ৮০ শতাংশ সমান ভাগে ভাগ করার প্রস্তাব দেয়। ভারত এটি মেনে নেয়নি। ভারতের কোন কোন মহল থেকে এ সময় ভারতের অধিক পরিমাণ কৃষিভূমি ইতিমধ্যে সেচ সুবিধা ব্যবহার করছেÑ এই যুক্তিতে তিস্তার সিংহভাগ পানি দাবি করে বসে। যেমনÑ পশ্চিমবঙ্গ থেকে নির্বাচিত ক্ষমতাসীন কংগ্রেস দলীয় সংসদ সদস্য গত বছর ১ সেপ্টেম্বর বিবিসিকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, বর্তমানে তিস্তার ৩৯ শতাংশ পানি পেলেও তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষরিত হলে ভারত পাবে ৭৫ শতাংশ! ভারতের পক্ষে আলোচনাকারী দেশটির নিরাপত্তা উপদেষ্টা শিবশংকর মেনন তাকে এ তথ্য দিয়েছেন বলে তিনি বিবিসিকে জানিয়েছিলেন। আমার ধারণা, তিস্তায় বেশি পানি দাবি করার ক্ষেত্রে ভারত এর পানির বর্তমান ব্যবহারকে (এগ্জিস্টিং ইউটিলাইজেশন) যুক্তি হিসেবে দাঁড় করাতে চা”েছ। এটি অত্যন্ত অসঙ্গত এ কারণে যে, উজানের দেশ হওয়ায় ভারত একতরফাভাবে বেশি পানি ব্যবহার করার ভৌগোলিক সুযোগ পেয়ে প্রথমেই বাংলাদেশকে পানি ব্যবহারের সুযোগ থেকে অনেকাংশে বঞ্চিত করে ফেলে। এ বঞ্চনা আন্তর্জাতিক আইনে স্বীকৃত নয়, তাই এটি নদীর পানি ভাগাভাগির ভিত্তি হতে পারে না। বাংলাদেশের যে পরিমাণ জমিকে সেচসুবিধা দেয়ার লক্ষ্য নিয়ে তিস্তা ব্যারেজ নির্মাণ করা হয়েছিল, তাতে সেচ সুবিধা দেয়ার বিষয়টি অবশ্যই তাই তিস্তা চুক্তি সম্পাদনে বিবেচনায় নিতে হবে। সেক্ষেত্রে ২৫ শতাংশ তো প্রশ্নই আসে না, তিস্তার ৫০ শতাংশ পানি পেলেও তা বাংলাদেশের জন্য যথেষ্ট হবে না। আমার ধারণা, ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্বের এত ঢাকঢোল পেটানোর পর ২৫ শতাংশ পানিতে রাজি হওয়া কোনভাবেই সম্ভব নয় বাংলাদেশের পক্ষে। অন্যদিকে এর বেশি পানি দেয়া সম্ভব নয়, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী রাজি ননÑ এ ধরনের কথা বলে চুক্তি ঝুলিয়ে রাখলে ভারতের কোন ক্ষতি নেই। কারণ উজানের দেশ হিসেবে তিস্তার পানি ব্যবহারের জন্য ভাটির দেশ বাংলাদেশের সঙ্গে কোন চুক্তির অপেক্ষা তাদের করতে হয় না। তাছাড়া আরও উজানে তিস্তার যে দীর্ঘ গতিপথ ভারতের সিকিমের ভেতরে এবং সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গের সীমানায় প্রবাহিত হ”েছ, সেখান থেকে ভারত যে পানি প্রত্যাহার করছে বা জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র করছে, চুক্তি হলেও তাতেও ঝামেলা বাড়তে পারে। এসব বিষয় বিবেচনায় নিলে তিস্তা চুক্তি আদৌ কখনও হবে কিনা বা বাংলাদেশ এ নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা কখনও পাবে কিনা, তা নিয়ে সন্দিহান হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। ড. আসিফ নজর“ল : আন্তর্জাতিক নদী আইন বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক

সরকারের তাহলে ভয় কিসের


ভারতের অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জি এক নতুন সম্ভাবনার ইঙ্গিত দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে বন্ধুত্ব চায়, কোনো বিশেষ দলের সঙ্গে নয়। তিনি বিরোধী দলের নেত্রী খালেদা জিয়াকে ভারত সফরেরও আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। প্রণবের প্রথম বাংলাদেশ সফরকালে যে শীতল মনোভাব বিএনপির প্রতি দেখানো হয়েছিল, তার পরিপ্রেক্ষিতে এসব পরিবর্তন তাৎপর্যপূর্ণ।
প্রণব, হিলারি এবং সবশেষে ইউরোপীয় ইউনিয়ন আগামী নির্বাচন প্রসঙ্গে দুটো বিষয়ের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছে। এক. রাজনৈতিক সমঝোতা এবং দুই. সবার অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। দুটো বিষয়ের মূল লক্ষ্য অভিন্ন: তা হচ্ছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠান। বাংলাদেশে এখন যত রকম রাজনৈতিক হানাহানি হচ্ছে, তার মূলেও রয়েছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাখা না-রাখা নিয়ে বিরোধ।
অশক্ত গণতন্ত্রের একটি দেশ হিসেবে এই বিরোধ অস্বাভাবিক নয়। এ ধরনের দেশে শাসকগোষ্ঠী ‘অলটেরোকেসি’ বা ক্ষমতার পরিবর্তনে বিশ্বাস করে না। নির্বাচনে কারচুপি যতভাবে করা সম্ভব, তার মাধ্যমে জনগণের রায়কে ছিনতাই করার চেষ্টা এসব দেশে থাকে। বাংলাদেশে এটি চরম পর্যায়ে চলে গিয়েছিল বলে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্ব অরাজনৈতিক কিছু নাগরিকের কাছে প্রদান করার জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের রাজনৈতিক সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সেই সমঝোতাকে অগ্রাহ্য করার চেষ্টা সম্ভবত সফল হবে না। আন্তর্জাতিক মহলও সে রকম ইঙ্গিত দিয়ে যাচ্ছে এখন পর্যন্ত।

২.
গণতন্ত্র মানে যদি হয় জনগণের ম্যান্ডেট, সে ম্যান্ডেট তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে এখনো রয়েছে। জাতীয় পার্টি ছাড়া বাংলাদেশের প্রতিটি বড় রাজনৈতিক দল এই সরকারব্যবস্থার পক্ষে ছিল। জাতীয় পার্টির নেতারা ১৯৯১ সালে অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে সংগত কারণে এর বিরুদ্ধে কথা বলেছিলেন। সেই দলের নেতা এরশাদ পর্যন্ত জনগণ চাচ্ছে বলে তাঁর দল তত্ত্বাবধায়ক সরকারে রাজি আছে বলেছেন সাম্প্রতিক কালে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে দেশে এত সংঘাত হওয়ারও কথা ছিল না। সরকারে থাকা অবস্থায় ২০১০ সালে সংসদীয় কমিটির সঙ্গে সংলাপে স্বয়ং শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সংস্কার সাপেক্ষে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে মতামত জানিয়েছে। শেখ হাসিনা নিজে ১৯৯১ সালের নির্দলীয় সরকার, পরের দুটো তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং ২০০৭ সালের ‘অস্বাভাবিক’ তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার পেছনে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিলেন। তাঁর এই অবস্থানে পরে বিচ্যুতি না ঘটলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকবে কি থাকবে না তা নিয়ে দেশে কোনো সংঘাত সৃষ্টির কারণ হয়তো থাকত না।
প্রশ্ন হচ্ছে, আওয়ামী লীগ কেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারে এখন রাজি নয়? এর সহজ উত্তর হতে পারে নির্বাচনে হেরে যাওয়ার প্রবল ভীতি। বিদেশি ‘বন্ধুরা’ সামনের সময়ে হয়তো আরও স্পষ্ট করে বলবেন, দেশে এখনি ড. কামাল হোসেন, ড. ইউনূস, ড. আবেদের মতো বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তি থেকে অধিকাংশ সাধারণ মানুষ (প্রথম আলোর ৯ মের জরিপ অনুসারে ৯০ দশমিক ১৯ শতাংশ) বলছেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে। সুপ্রিম কোর্টের যে আদেশের খণ্ডিত ও একপেশে প্রয়োগ করে সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিলোপকে যৌক্তিক করতে চায়, সেখানেও জনগণ এবং রাষ্ট্রের নিরাপত্তার স্বার্থে আগামী দুটো নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত করার নির্দেশনা দেওয়া আছে। আওয়ামী লীগ তবু রাজি নয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারে। সর্বশেষ যা খবর, এ নিয়ে এমনকি কোনো সংলাপে বসতেও রাজি নয় দলটি।
সরকারি দলের কেন এই অনড় অবস্থান? একটি সফল সরকারের তো সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রতি ভীতি থাকার কথা নয়। আমরা পত্রিকায় দেখি, সরকারের মন্ত্রীরা সবাই নিজেকে সফল ভাবেন। প্রধানমন্ত্রী নিজেই বলেন, চালচলনে সবাই স্যুটেড-বুটেড না হলেও তাঁর সব মন্ত্রীই সফল। আজকের পত্রিকায় দেখি, দেশে এমন এক গুম আতঙ্কে গুমোট সময়ে সাহারা খাতুন বললেন: তিনি অবশ্যই সফল!
আবারও বলি, এত সফল একটি সরকারের তো নিরপেক্ষ নির্বাচনে ভয় পাওয়ার কথা নয়! তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে এর আগে মহাব্যর্থ কিছু সরকার অংশ নিয়েছিল। তারা প্রত্যেকেই পরাজিত হয়েছিল। গত বিএনপি সরকারের ভরাডুবিই ঘটেছিল ২০০৮ এর নির্বাচনে। আওয়ামী লীগ কি নিজেদের ব্যর্থতার কারণে এমন পরিণতির আশঙ্কা করছে? একমাত্র এই আশঙ্কা থাকলেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে তাদের প্রবল বিরোধিতা আমাদের কাছে বোধগম্য হতো।
কিন্তু আমরা প্রকাশ্যে তাদের কোনো ব্যর্থতা স্বীকার করতে দেখি না। এ জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিরোধিতার ক্ষেত্রে তাদের মনস্তত্ত্ব আরও দুর্বোধ্য হয়ে পড়ছে।

৩.
প্রকাশ্যে আমরা আওয়ামী লীগকে বলতে শুনি শুধু তাদের সফলতার কথা। এর কারণ হতে পারে এই যে, সাধারণ মানুষ যেভাবে সফলতার মানে বোঝে, তার চেয়ে সরকারি দলগুলোর বোঝাটার ভঙ্গিটি ভিন্ন ধরনের। যেমন: আমরা যখন ইলিয়াসের গুম হওয়া নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছি, সরকারের লোকজন হয়তো ভাবছেন ড. কিবরিয়া বা আহসানউল্লাহ মাস্টারের হত্যাকাণ্ডের তুলনায় এটি তেমন কোনো বিষয় নয়। আমরা যখন ড. ইউনূসের অপমানে দেশের মর্যাদা ক্ষুণ্ন হয়েছে ভাবি, তাঁরা হয়তো ভাবেন প্রধানমন্ত্রীর শান্তির মডেল উত্থাপন বাংলাদেশকে নিয়ে গেছে নতুন উচ্চতায়! আমরা যখন নদী শুকিয়ে যাচ্ছে বলে হাহাকার করে উঠি, তাঁরা হয়তো ভাবেন সমুদ্রজয়ের পানি দিয়ে সমাধান হয়ে যাবে সব সমস্যার। আমরা যখন কর্মসংস্থান বা বিনিয়োগ-পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন হই, তাঁরা তখন শুধু জিডিপির গতি দেখেই তৃপ্ত থাকেন।
আমাদের চেয়ে তাঁদের দেখার চোখ ভিন্ন। দলীয়করণকে তাঁরা হয়তো ভাবেন ‘মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের’ লোকের মূল্যায়ন, দুর্নীতিকে ভাবেন দেশসেবার কারণে অর্জিত অধিকার বা ধনতন্ত্রের জন্য মূলধন পুঞ্জীভূতকরণ, রাজনৈতিক সন্ত্রাসকে ভাবেন মহৎ প্রতিশোধ, শেয়ারবাজার লুট করাকে ভাবেন চতুর মানুষের অর্জন, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি মানে ভাবেন বাজার অর্থনীতি!
সরকারি দল নির্বাচনী ম্যানিফেস্টো করে শুধু নির্বাচনে জেতার জন্য, আমরা ভুল করে ভাবি তা বাস্তবায়নের জন্য। সরকারি দল দিনবদল মানে ভাবে শাসকগোষ্ঠী আর তার অনুগতদের দিনবদল, আমরা ভাবি সবার জন্য দিনবদল। সরকার ভাবে দেশটা সরকারি দলের, আমরা ভাবি জনগণের। সরকার ভাবে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক মানে ভারত, আমরা ভাবি অন্যরাও।
বোঝার ক্ষেত্রে এই মনস্তাত্ত্বিক পার্থক্য সত্যি না হলে সরকার আর আমাদের মূল্যায়ন এত ভিন্ন হওয়ার কারণ নেই। আমার কথা হচ্ছে, সরকারের আত্মমূল্যায়ন সঠিক হলে সুষ্ঠু আর অবাধ নির্বাচনে তাদের ভয় পাওয়ার কারণ নেই। আর এমন নির্বাচন কেবল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই হওয়া সম্ভব।

৪.
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রতি অনীহার একটি কারণ আমরা সরকারের নীতিনির্ধারকদের মুখে শুনি। তাঁরা ১/১১ পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রসঙ্গ টেনে সে সময় রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও আমলাদের প্রতি নিপীড়নের কথা বলেন। এই অভিযোগ অমূলক নয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকার যে সংবিধান-বহির্ভূতভাবে বহুদিন ক্ষমতায় ছিল, এটিও সত্যি। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে, সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছিল একটি অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে অস্বাভাবিকভাবে সৃষ্ট একটি সরকার। এ ধরনের পরিস্থিতির মূল কারণ ছিল বিএনপি কর্তৃক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মোড়কে একটি অনুগত নির্বাচন প্রশাসন ও নির্বাচনী প্রক্রিয়া স্থাপনের চেষ্টা। সেই চেষ্টা সহিংসভাবে ঠেকাতে গিয়েছিল তৎকালীন বিরোধী দল, এর পরিণতিতে সৃষ্ট অস্বাভাবিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে সদলবলে অভিনন্দিত করেছিলেন দলটির সভানেত্রী। একইভাবে বর্তমান সরকারি দলও কারসাজির নির্বাচন করতে গেলে তা যেকোনো মূল্যে বর্তমান বিরোধী দল প্রতিহত করার চেষ্টা করবে, এটাই স্বাভাবিক।
এই অনিবার্য সংঘাত এড়ানোর একমাত্র সমাধান হচ্ছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন (এবং ২০০৬ সালের মতো তা টেম্পারিং করার চেষ্টা না করা)। এ জন্য দেশি-বিদেশি বিভিন্ন মহল সংলাপের প্রয়োজনীয়তার কথা বলছে। কিন্তু আমার মতে, সরকার নিজে থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিলে সংলাপেরও তেমন প্রয়োজন নেই। এই উদ্যোগের ভিত্তিতে সংসদে বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের যে ত্রুটিগুলো রয়েছে (যেমন: এর গঠন, কার্যকাল এবং ক্ষমতাসংক্রান্ত), তা দূর করে সর্বমহলে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনকালীন একটি সরকার প্রতিষ্ঠা করা অসম্ভব নয়।
এ জন্য অতিকেন্দ্রীভূত বর্তমান সরকারব্যবস্থায় সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সরকারপ্রধানের সদিচ্ছা। এই সদিচ্ছার অভাব ছিল বলে অতীতে সংলাপের মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের কোনো নজির আমরা পাইনি। গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শেষ দিকে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কিছু সফল সংলাপ হয়েছিল। কিন্তু ৯০-পরবর্তী গণতন্ত্র পুনরুত্থানের যুগে সংলাপের মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের নজির সম্ভবত আর নেই। বর্তমান সরকারের আমলে সংবিধান সংশোধনী সংক্রান্ত সংলাপে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রয়োজনীয়তাসহ বহু বিষয়ে মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সরকার সেই মতৈক্যের গুরুত্ব অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রদান করেনি। এটি প্রমাণ করে, সরকারপ্রধান না চাইলে রাজনৈতিক সংলাপের মাধ্যমে প্রকৃত সমাধানের সম্ভাবনা তেমন নেই বাংলাদেশে।
আমরা সেই সদিচ্ছার প্রত্যাশা করি। দলীয় সরকারের মাধ্যমে একতরফা নির্বাচন বাংলাদেশে অতীতে হয়েছে। আমাদের অভিজ্ঞতা বলে, এমন নির্বাচনগুলো হয়েছে জনগণ কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হওয়ার ভয় থেকে। আগামী নির্বাচনও এভাবে করার উদ্যোগ নিলে মানুষ সেই ভয়ের গন্ধ পাবে। আমার মনে হয় না, জনগণকে ভয় পেয়ে বা ভয় দেখিয়ে বাংলাদেশে ক্ষমতায় টিকে থাকা যায়।
জনগণের সঙ্গে এমন ভয়ের সম্পর্ক যদি না থাকে, তাহলে জনগণের প্রত্যাশা অনুসারে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনঃপ্রবর্তনে সরকারের রাজি হওয়া উচিত। সেটি যত তাড়াতাড়ি হবে, ততই মঙ্গলজনক।

আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।