পৃষ্ঠাসমূহ

সোমবার, ৩০ জানুয়ারী, ২০১২

ক্ষমতার যুদ্ধ স্থগিত রাখুন

হঠাৎ করেই দেশের রাজনীতি উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। বিএনপির গণমিছিল কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্ন স্থানে সংঘাত-সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। চাঁদপুর ও লক্ষ্মীপুরে পুলিশের গুলিতে চারজন মারা গেছেন। এই প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আবদুল মান্নান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল

৩০ জানুয়ারি বিএনপির গণমিছিল শান্তিপূর্ণভাবে শেষ হয়েছে, শান্তিপূর্ণভাবে কর্মসূচি পালন করেছে আওয়ামী লীগও। এটি যেমন আমাদের স্বস্তি দিয়েছে, তেমনি জোরালো করেছে কিছু প্রশ্নও। সত্যিই কি নাশকতার কোনো আশঙ্কা ছিল ২৯ জানুয়ারির কর্মসূচিতে, যদি ছিলই তাহলে ৩০ তারিখে কীভাবে শান্তিপূর্ণভাবে হলো গণমিছিল? আশঙ্কা যদি নাই ছিল তাহলে কেন পুলিশ হঠাৎ করে ২৯ জানুয়ারি গণমিছিলের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল চারটি বড় বিভাগীয় শহরে? আরও যা প্রশ্ন, কেনইবা একই ধরনের কর্মসূচি পালনে বাধা দিতে গিয়ে আগের দিন দেশের অন্যান্য অঞ্চলে গুলি বর্ষণ করল পুলিশ?
২৯ জানুয়ারি পুলিশের গুলিতে (চাঁদপুর ও লক্ষ্মীপুরে) প্রাণ হারিয়েছেন চারজন মানুষ, আহত হয়েছেন চার শতাধিক। তাঁরা বিএনপির কর্মী হতে পারেন, নাও হতে পারেন। মূল বিষয় হচ্ছে, পুলিশ এদিন গুলি চালিয়েছে বিএনপির নেতৃত্বে গণমিছিলের মতো একটি গণতান্ত্রিক কর্মসূচি পালনকালে। কর্মসূচি পালনকালে নাশকতা দূরে থাক, বড় ধরনের সহিংসতা হয়েছে, এমন কোনো খবরও ৩০ জানুয়ারির পত্রিকায় প্রকাশিত হয়নি। সরকারের পুলিশ তাহলে মাত্রাতিরিক্ত মারমুখী আর নির্মম হয়ে উঠল কেন?
সরকারের এ আচরণ কিছুটা আকস্মিক, তবে কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। মাত্র পাঁচ দিন আগে মাহী বি. চৌধুরীর ব্লু ব্যান্ড কল নামে একটি অরাজনৈতিক সংগঠনের কর্মসূচি লাঠিপেটা করে পন্ড করে দেওয়া হয়। সিপিবিকে কর্মসূচি পালনের অনুমতি দেওয়া হয়নি নির্ধারিত স্থানে। বিএনপির ক্ষেত্রে সরকারের কঠোরতা ছিল আরও খোলামেলা। কর্মসূচির আগের তিন-চার দিন সরকারের মুখপাত্র হিসেবে পরিচিত কিছু মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী নানাভাবে জানিয়ে দেন বিএনপিকে কোনো ছাড় দেওয়া হবে না। এর মধ্যে আওয়ামী লীগ পূর্বঘোষিত বিএনপির গণমিছিলের পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি দেয় ২৯ জানুয়ারি, পুলিশি নিষেধাজ্ঞার কারণে বিএনপি চার বিভাগীয় শহরের গণমিছিল একদিন পিছিয়ে ৩০ জানুয়ারিতে নিয়ে গেলে সেদিনও প্রায় একই স্থান ও সময়ে আবারও কর্মসূচি ঘোষণা করে আওয়ামী লীগ। ২৯ তারিখে ঘটে গুলিবর্ষণের ঘটনা!
সার্বিকভাবে সরকারের আচরণ ছিল উসকানিমূলক ও দমনমূলক। এর আগে বিএনপির কিছু কর্মকাণ্ডেও উসকানি ছিল। ডিসেম্বরের মধ্যে সরকার পতনের ডাক, ডিসেম্বরের কিছু কর্মসূচিতে সহিংসতা, খালেদা জিয়া কর্তৃক সেনাবাহিনীতে গুমের অভিযোগ এবং কিছু সেনাসদস্য কর্তৃক সেনা অভ্যুত্থানের অপচেষ্টা—এসব ঘটনা সরকারের জন্য অবশ্যই উদ্বেগজনক ছিল। কিন্তু সরকারকে মনে রাখতে হবে কোনো আশঙ্কা বা উদ্বেগ থাকলে এর প্রতিকারও আছে সরকারের কাছে। গোয়েন্দা, পুলিশ ও প্রশাসনের মাধ্যমে আশঙ্কামূলক তথ্যের সত্যতা যাচাই এবং সে অনুসারে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষমতা, অধিকার ও সুযোগ সরকারের রয়েছে। জনগণের কাছে নাশকতা বা যড়যন্ত্রের কোনো বিশ্বাসযোগ্য তথ্যপ্রমাণ পেশ না করে বিরোধী দলের এ ধরনের কর্মসূচি বাধাগ্রস্ত করার অধিকার সরকারের নেই। বিশেষ করে ২৯ জানুয়ারি পুলিশ যে নৃশংসতা দেখিয়েছে তা সমর্থন করার মতো কোনো পরিস্থিতি অকুস্থলগুলোতে ছিল না।
সরকারের কাছে আমাদের দাবি থাকবে ২৯ জানুয়ারির ঘটনায় সরকারের ভেতরের কোনো হঠকারী গোষ্ঠীর ভূমিকা ছিল কি না তা খুঁজে বের করা এবং এ ধরনের গোষ্ঠীর প্রাধান্য প্রতিহত করা। ২৯ জানুয়ারি পুলিশ কর্তৃক ডিসপ্রপোরশনেট (অ-সমানুপাতিক) শক্তিপ্রয়োগের যে ঘটনা ঘটেছে তার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের যথাযথ শাস্তির ব্যবস্থা করা।
সরকারের কাছে আবেদন থাকবে তারা কোনো কারণে অতিরিক্ত নার্ভাসনেসে ভুগছে কি না তা খতিয়ে দেখার। জানুয়ারির পর পুরো ফেব্রুয়ারি এসএসসি পরীক্ষা থাকার কারণে বিএনপির তেমন কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি ছিল না। ফলে ২৯ জানুয়ারি নির্বিঘ্নভাবে কর্মসূচি পালন করতে দিলেও বিএনপি তার শক্তি বা ব্যাপ্তি ফেব্রুয়ারিতে অব্যাহত রাখতে পারত না, সরকারের জন্য বড় কোনো সমস্যাও তৈরি করতে পারত না। ২৯ জানুয়ারি কর্মসূচি প্রতিহত করতে গিয়ে তাহলে সাধারণ মানুষকে হত্যার কলঙ্ক গ্রহণ করার কী প্রয়োজন ছিল সরকারের? মার্চে বিএনপির বড় কর্মসূচি আছে। এ রকম বৃহৎ কর্মসূচি আওয়ামী লীগও গত আমলে পালন করেছে, তাতে সরকারের পতন ঘটে যায়নি, এবারও ঘটবে এমন ভেবে ব্যতিব্যস্ত হওয়ার তেমন কোনো কারণ ঘটেনি।
সরকারের সঙ্গে বিরোধী দলের আসল বিরোধ ক্ষমতা নিয়ে। বিএনপি বদ্ধমূলভাবে বিশ্বাস করে যে আগামী সংসদ নির্বাচনে কারচুপি করার উদ্দেশ্য রয়েছে বলেই আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থায় রাজি হচ্ছে না। একই বিশ্বাস থেকে ১৯৯৬ সালে বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে গণ-আন্দোলন করেছিল আওয়ামী লীগ। সেটি যদি যৌক্তিক হয়ে থাকে তাহলে নিয়মতান্ত্রিক পথে গণ-আন্দোলন করার এবং এর মাধ্যমে বর্তমান সরকারকে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা পুনঃস্থাপনে চাপ সৃষ্টির অধিকার বর্তমান বিরোধী দলগুলোরও রয়েছে। গণ-আন্দোলনের পাশাপাশি বা এর আড়ালে যদি কোনো যড়যন্ত্রের চেষ্টা করা হয় সেটি প্রতিহত করার বৈধতা অবশ্যই সরকারের রয়েছে। কিন্তু তাই বলে গণ-আন্দোলনের বিকাশকে শক্তিপ্রয়োগের মাধ্যমে দমিয়ে রাখার চেষ্টা করার কোনো অধিকার সরকারের নেই।
ভালো হয় বিএনপি ও আওয়ামী লীগ যদি ক্ষমতার আগাম যুদ্ধ স্থগিত রাখে। ভালো হয় যদি অন্তত আগামী শীত পর্যন্ত মামলা, হামলা ও ভয়ভীতির মাধ্যমে বিএনপিকে খর্ব ও দুর্বল করার চেষ্টা বন্ধ থাকে, সরকারের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত আন্দোলনের চেষ্টাও স্থগিত থাকে। মোকাবিলাই যদি অনিবার্য হয়ে পড়ে তাহলে দুই দলের উচিত উপযুক্ত সময়ে জনসমর্থনের জোরে নিয়মতান্ত্রিক পথে তা করা। তবে তার আগে অবশ্যই তাদের কর্তব্য হলো সংসদ ও প্রয়োজনে সংসদের বাইরে আলোচনার মাধ্যমে সমাধান খোঁজার সর্বাত্মক চেষ্টা করা।
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

শুক্রবার, ২৭ জানুয়ারী, ২০১২

পীর: বাহিনী ও কাহিনি

বিশ-পঁচিশ বছর আগেও পীরদের মহা প্রতাপ ছিল দেশে। অনেক রাজনীতিবিদ, জেনারেল ও ক্ষমতাশালী লোক যেতেন পীরদের কাছে। বাংলাদেশে এসে এমনকি বেনজির ভুট্টোও অখ্যাত এক পীর মজিবর রহমান চিশতির কাছে ছুটে গিয়েছিলেন। সারা দেশে তুমুল আলোচিত ছিল এ ঘটনা।
প্রথম আলোর সাংবাদিক কবির হোসেন পীরের ছবি তুলে আরেক ধরনের আলোড়ন তুলেছেন এখন দেশে। এই ছবি মুন্সিগঞ্জের পীর ও তাঁর বাহিনীর ভণ্ডামি এবং নিষ্ঠুরতাকে উন্মোচন করেছে। বহু মানুষ সোচ্চার হয়েছে ভণ্ড পীরের উপযুক্ত শাস্তির দাবিতে। কেউ কেউ বিস্ময়ে হতবাকও হয়েছে। কিন্তু পীর-সংস্কৃতি নিয়ে আসলে বিস্ময়ের কিছু নেই। যুগ যুগ ধরে মানুষের অশিক্ষা, অসহায়ত্ব আর অন্ধবিশ্বাসকে পুঁজি করে বাংলাদেশে চলছে ভণ্ড পীরদের দৌরাত্ম্য। কবিরের সচিত্র প্রতিবেদন দেখে মনে পড়ে এ রকম বহু ঘটনা।

২.
আমাদের তরুণ বয়সে পীরেরা ছিলেন দুই ধরনের। রাজনৈতিক পীর আর ব্যবসায়ী পীর। রাজনৈতিক পীরেরাও ধর্মব্যবসা করতেন, কিন্তু তাঁদের মূল ক্ষমতার উৎস ছিল রাজনীতিবিদ আর ক্ষমতাধর মানুষের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ। তখনকার দিনে রাজনৈতিক পীরদের মধ্যে সবচেয়ে ক্ষমতাশালী ছিলেন ফরিদপুর নিবাসী আটরশির পীর। এরশাদের কল্যাণে তিনি তখন তারকাখ্যাতি পেয়েছেন বাংলাদেশে। কিন্তু আটরশির পীর জনসমক্ষে আসতেন না। তিনি পত্রিকায় সাক্ষাৎকার দিতেন না। এমনকি তখন এমন গুজবও ছিল যে তাঁর ছবি নাকি ক্যামেরার রিলেতে তোলাও যায় না।
আটরশির পীরের কাছে যাওয়ার ‘সৌভাগ্য’ হয়েছিল আমারও। সাংবাদিক পরিচয় লুকিয়ে রেখে রওনা দিয়েছিলাম একবার আটরশিতে। সেখানে সবাইকে জুতো খুলে খালি পায়ে থাকতে হয়। আমরাও তা-ই করি। রাতে দেখা হলো তাঁর ফিটফাট ছেলের সঙ্গে। তিনি জুতো পরেই দিব্যি ঘুরছেন সবখানে। বাম রাজনীতির সোনালি দিন তখন দেশে, শ্রেণীচেতনা ছিল আমাদের অনেকের মধ্যেও। আটরশির পীরের ছেলের চকচকে জুতোর দিকে চেয়ে তাই রাগে গা জ্বলতে থাকে। গোপনে আটরশির ছবি তোলার পরিকল্পনা বাদ দিয়ে ফিরে আসি ঢাকায়।
পীরদের সঙ্গে আমার মোলাকাত শেষ হয়ে যায়নি তাই বলে। ১৯৮৯ সালে সাপ্তাহিক বিচিত্রায় যোগ দিয়ে বহু রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা ঘটে জীবনে। পীরদের সামনাসামনি হওয়া ছিল সে রকমই কিছু। বিচিত্রায় একবার সিদ্ধান্ত হলো, পরের প্রচ্ছদকাহিনি হবে ঢাকার পীরদের নিয়ে। লিখব আমি।
সেটি ১৯৯২ সালের কথা। দেশে কিছুদিন আগে গণতন্ত্র এসেছে। গণতন্ত্র এসেছে পীর-ব্যবসাতেও। সারা ঢাকা তাই ছেয়ে গেছে পীরদের আস্তানায়। এঁদের অনেকের বিজ্ঞাপন ছাপা হতো তখন বহুল প্রচারিত দৈনিক আর সাপ্তাহিকগুলোতে। অনেক বিজ্ঞাপনে লেখা থাকত ‘চেহারা দেখে সমস্যার সমাধান দেয়া হয়’। কেউ করতেন সাপ দিয়ে চিকিৎসা, কেউ পাথর দিয়ে। কিন্তু সবারই দাবি, তাঁদের ক্ষমতা অলৌকিক কিংবা কুদরতি। আসলে তা কী, সেই বর্ণনা দেওয়ার জন্য একটু নিজের প্রতিবেদনের কথা বলে নিই।

৩.
ঢাকার অধিকাংশ পীর তখন একটি বিশেষ কৌশল অবলম্বন করে লোক ঠকাতেন। অতিথিকক্ষে তাঁদেরই বেতনভোগী কর্মচারীরা পীরের দর্শনার্থী সেজে থাকতেন। সমস্যায় আক্রান্ত কোনো মানুষ পীরের কাছে গেলে এই কর্মচারী বাহিনীর কেউ তাঁর সঙ্গে আলাপ জুড়ে দিতেন। ওই ব্যক্তি হয়তো বলেন, তাঁর ব্যবসায় খুব দুর্দিন যাচ্ছে, পীরের কাছে এসেছেন তদবির করতে। পীরের কাছে তাঁর ডাক পড়ে হয়তো ঘণ্টাখানেক পর। পীর তাঁকে দেখে বলে দেন ‘তোমার তো ব্যবসার অবস্থা খারাপ, তাই না।’ ওই ব্যক্তি তখন চমকে উঠে ভাবেন, এই পীর আমাকে দেখেই বলে দিলেন সমস্যার কথা। এত মহা আল্লাহওয়ালা লোক! এ সুযোগে পীর তাঁকে নানা কথা বলে আরও ভড়কে দেন, দোয়া-তদবির-সদকা বিভিন্ন নামে তাঁর কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নেন। প্রবীর মিত্রের অলৌকিক নয়, লৌকিক নামক বিখ্যাত গ্রন্থে ভণ্ড পীরদের এ রকম বহু টেকনিকের বর্ণনা আছে।
১৯৯২ সালে ঢাকার কয়েকজন বিখ্যাত পীরের ওপর প্রতিবেদন রচনার সময় প্রবীর মিত্রের বই আমাকে অনেক সাহায্য করেছে। এই পীরদের একজন ছিলেন ‘হুজুর হজরত ফকির আবদুর রব চিশতী ছুম্মায়ে আজমিরী’। ছুম্মায়ে আজমিরীর চেম্বারে দর্শনার্থীদের ঘরে বসামাত্র মলিন চেহারার এক লোক এসে আলাপ জুড়ে দেন আমার সঙ্গে। তাঁর নাকি দুই বউ ছিল, দুজনই ‘মইরা শেষ’। তৃতীয় বিয়ের আগে তদবির করতে চান। আমার সমস্যা কী তা তিনি জানতে চান। আমি বানিয়ে বলি সমস্যার কথা। আমার বউ বড়ই বদ, তার সঙ্গে ঝগড়াঝাঁটি, মামলা-মোকদ্দমা চলছে (আসলে আমি তখনো অবিবাহিত, মামলার কোনো ঝামেলাও ছিল না তখন)।
একটু পরেই হুজুরের দরবারে ডাক। তিনি উঁচু তাকিয়ার পাগড়ি মাথায় বসে। আতর, গোলাপজল, আগরবাতিতে আচ্ছন্ন ঘরের মেঝেতে হাঁটু গেড়ে বসি আমি। কালো ব্যাগে গোপনে রেকর্ড হয় হুজুরের সঙ্গে আমার সংলাপ। সেখানকার কিছু অংশ ছিল হুবহু এ রকম:
‘হুজুর বলেন...তুমি এখন বড় টেনশনে আছো নিজেকে নিয়ে...তুমি বড়...অহেতুক মামলা-মোকাদ্দমা তোমার পেছনে লেগে থাকবেই, কিছু করতে পারুক আর না পারুক...তোমার বুকে একটা তিল আছে, আছে না?
জি না হুজুর (আসলেই আমার বুকে কোনো তিল নেই)।
আছে, অবশ্যই আছে, দেখি শার্ট খোলো...হুজুর আমার বুকের দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলেন, কি নাই?
জি না হুজুর।
আছেই, ভালো করে খেয়াল করে দেখো, গোসলের সময় কাঁচা হলুদ দিয়া ডইলা উঠায় ফেলবা।
হুজুর আমার সমস্যার কথা বলেন...
তোমার প্রথম জীবনে চাকরি হবে, তারপর ব্যবসা, এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট, একাধিকবার বিদেশ ভ্রমণ আছে, অস্ট্রেলিয়া-জাপান-সৌদি আরব...“ইয়ার লাইন” বোঝো?
জি হুজুর!
ইয়ার লাইনে তোমার বিমান দুর্ঘটনা শতকরা ৮৮ ভাগ, মাত্র ৮ ভাগ ভালো আছে...
বাকি ৪ ভাগ কী হুজুর?
যা বলি শোনো, তুমি বড় বেশি কথা বলো।’
(তথ্যসূত্র: আসিফ নজরুলের অনুসন্ধানী প্রতিবেদন, বিদ্যাপ্রকাশ, ১৯৯৭)
ছুম্মায়ে আজমিরী ও অন্য পীরদের কাছে আমি কিছুদিন পর যাই প্রতিবেদক হিসেবে। এই পর্যায়ে তাঁদের কথাবার্তা একদম বদলে যায়। স্বীকার করেন যে আসলে সমস্যার কোনো সমাধান করতে পারেন না তাঁরা। সমাধান আল্লাহর হাতে, তাঁরা শুধু দোয়া করে দেন। তাঁদের কাছে না এসে লোকজন নিজেরা দোয়া করলেই পারে।
বিজ্ঞাপনে তাঁদের দাবি আবার একবারে ভিন্ন। বিচিত্রায় আমার প্রচ্ছদ প্রতিবেদনে এসব অসংগতি বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হয়। প্রতিবেদন বের হওয়ার আগেই আল-জহুরী সর্পরাজ এ আর গনি তাঁর বিরুদ্ধে কিছু লেখা হলে সর্প দংশন করিয়ে মেরে ফেলার হুমকি দেন, প্রতিবেদন বের হওয়ার পর ছুম্মায়ে আজমিরী খোদার গজবের ভয় দেখিয়ে চিঠি পাঠান। মওলানা এম ইউ আজাদী কুদরতী বিচিত্রায় ফোন করে আমাকে বলেন, ‘আপনি একটা “ইসটুপিড” লোক।’
বিচিত্রায় প্রতিবেদন ছাপা হওয়ার দুই বছর পর আমি বিদেশে যাই গবেষণার কাজে। ফিরে আসি পাঁচ বছর পর। তখনো দেশের নামকরা দৈনিকগুলোতে ছুম্মায়ে আজমিরীর বিজ্ঞাপন, আরও বহু নারী-পুরুষ পীরের বিজ্ঞাপন। আমাদের লেখালেখিতে কিছুই হয়নি তাঁদের।
কবির হোসেনের প্রতিবেদনের পর মুন্সিগঞ্জের পীর আমজাদ ধরা পড়েছেন, তাঁর সিন্ডিকেটের সদস্যরা ধরা পড়েছেন। কিন্তু তাঁদের কি শাস্তি হবে শেষ পর্যন্ত? পুলিশ কি ঠিকমতো তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি করবে? সরকারের উকিল কি লড়বেন ঠিকমতো? আদালত কি জামিন না দিয়ে বিচার করবেন দ্রুত?
সব যদি ঠিকমতো হয়, একজন ভণ্ড পীর ও তাঁর সাঙ্গপাঙ্গরা হয়তো সাজা পাবে। কিন্তু বাংলাদেশ কি রেহাই পাবে এই পীরদের দৌরাত্ম্য থেকে? সারা দেশে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য আমজাদের হাত থেকে কি রক্ষা পাবে অগণিত অসহায় মানুষ? আমার তা মনে হয় না।

৪.
ভণ্ড পীর আসলে শুধু মুন্সিগঞ্জের আমজাদেরা নন। মূল সমস্যা হলো, সমাজে এ রকম ভণ্ড পীর ছড়িয়ে আছেন সর্বত্র। মানুষের বিশ্বাস ও আনুগত্যকে পুঁজি করে এঁরা তাদের ঠকান নানাভাবে। নিজেরা হন অর্থ-বিত্ত-ক্ষমতার মালিক। সাংবাদিক, আইনজীবী, শিক্ষক, চিকিৎসক, বুদ্ধিজীবী—সবার নেতৃত্বে আছেন এ রকম নেতাবেশী পীর। সবাই এমন নন, তবে অন্তত কেউ কেউ এমন। পীরদের মতো তাঁদেরও আছে উচ্ছিষ্টভোগী বাহিনী।
ভণ্ড পীরের মতো আচরণ করেন এমনকি আমাদের সর্বোচ্চ পর্যায়ের নেতারাও। দেশের সমস্যা, সমাজের সমস্যা ক্ষমতায় এসে অলৌকিক সমাধানের বাণী দেন। আমরা চরম ভক্তিবাদ দেখিয়ে, তাঁদের অন্ধভাবে বিশ্বাস করে ক্ষমতায় বসাই। পীরেরা ঝাড়ফুঁক দিয়ে, পানি পড়া খাইয়ে সমস্যার সমাধান করেন। সেই সমাধানে সমস্যা আরও বাড়তে থাকে। আমাদের রাজনীতিবিদেরাও গলাবাজি করে ডিজিটাল বাংলাদেশ কিংবা জাতীয়তাবাদী বাংলাদেশের পানি পড়া খাইয়ে দেন আমাদের। তাঁদের ধোঁকা আর দুঃশাসনে শুধু বাড়তে থাকে দেশের সমস্যা। আরও মানুষ দরিদ্র হয়, আরও মানুষের ঘরের বাতি নিভে যায়, আরও মানুষ বস্তি কিংবা ফুটপাতে নেমে আসে।
পীরেরা পিটিয়ে অসুখ সারান। নেতারা পিটিয়ে প্রতিবাদের অসুখ সারান। পীরেরা কলা-মুলো ভ্যাট পান, নগদ টাকায় গড়ে তোলেন পাকা দালানকোঠা। নেতারা পান লাইসেন্স-পারমিট-কমিশন, বারিধারার প্লট। কোনো পীর দরিদ্র নন, কোনো নেতাও নন। পীরের আশপাশে গড়ে ওঠে মধুলোভী সঙ্গীদের বাহিনী। নেতাদের চারপাশেও তাই। পীরেরা কখনো কখনো গ্রেপ্তার হন, কালেভদ্রে শাস্তি পান। আমাদের নেতারাও তাই।
পীরের সঙ্গে নেতার মিল সম্ভবত সবচেয়ে বেশি। এই মিল ঘোচানোই সবচেয়ে জরুরি।
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
 তারিখ: ২৪-০৪-২০১০

দমননীতি: প্রতিবাদ থেমে থাকে না

বাংলাদেশের কিছু মানুষের মধ্যে বেশি কথা বলার রোগ আছে। এই রোগ সবচেয়ে বেশি রাজনীতিবিদদের মধ্যে। মন্ত্রিত্ব পেলে তাঁদের অনেকের কথা অসংলগ্নও হয়ে ওঠে। বিভিন্ন সরকারের আমলে কিছু কিছু মন্ত্রী পিলে চমকানো বা হাস্যকর বক্তব্য দেওয়ার জন্যও ‘প্রসিদ্ধি’ অর্জন করেছেন। কারও কারও বক্তব্যে হাস্যরস আর বিরক্তি ছাপিয়ে ওঠে দুর্ভাবনা। মন্ত্রী হলে কি দেশের মানুষকে বোকা ভাবার বা বোকা বানানোর রোগ জন্মে অনেকের মধ্যে?
আমার ধারণা, তা-ই হয়। না হলে আমাদের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এই ইংগিত দেন কী করে যে বিরোধী দলের মানববন্ধন কর্মসূচিও ছিল যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য? ৭ জুলাই এক ঘণ্টার এই নিরীহ কর্মসূচিকে নস্যাৎ করার জন্য পুলিশ পিটিয়েছে কিংবা ছত্রভঙ্গ করেছে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের। অতীতে মানববন্ধনের ওপর এ রকম চড়াও হওয়ার নজির সম্ভবত দেশে নেই। ‘দিনবদল’ এখানেও হচ্ছে বুঝলাম। কিন্তু মানববন্ধন কর্মসূচির সঙ্গে মন্ত্রীর দাবিমতো যুদ্ধাপরাধী বিচার নস্যাৎ করার সম্পর্ক কোথায়, এটা তো বোঝা যাচ্ছে না!
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করে সরকারের লাভ হয়েছে। অন্য কিছু ক্ষেত্রে ব্যর্থতা সত্ত্বেও এই একটি কারণে দেশের অনেক মানুষের সমর্থন এখনো পাচ্ছে তারা। কিন্তু এই মহান দায়িত্ব পালনের অজুহাতে অন্য সব ক্ষেত্রে জবাবদিহির বাইরে থাকার যে চেষ্টা সরকারের মন্ত্রীরা বিভিন্ন বক্তৃতা-বিবৃতিতে চালাচ্ছেন, তা হাস্যকর। একই সঙ্গে অগ্রহণযোগ্য।

২.
বিএনপির সামপ্রতিক হরতালের বিরোধিতা করতে গিয়েও কোনো কোনো মন্ত্রী হরতালকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা হিসেবে অভিহিত করেছেন। বিএনপি যেসব দাবিতে হরতাল ডেকেছিল, তার মধ্যে যুদ্ধাপরাধের বিচারের প্রসঙ্গের কোনো উল্লেখই ছিল না। হরতাল আহ্বান করা হয়েছিল পানি-বিদ্যুৎ সমস্যা, বিরোধী দলের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন, বিচার বিভাগ ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতাসহ নানা ইস্যুতে। অতীতে প্রায় অবিকল এসব ইস্যুতে আওয়ামী লীগ বহুবার হরতাল পালন করেছে। হরতালের সঙ্গে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কোনো সম্পর্ক আগে না থাকলে এখন থাকবে কোন যুক্তিতে?
হরতাল প্রতিবাদের ভাষা বা কর্মসূচি হিসেবে গ্রহণযোগ্য নয়। বিশেষ করে হরতালের আগের রাত থেকে শুরু করে হরতালের দিন জনগণকে এটি পালনে বাধ্য করার জন্য যে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করা হয়, তা গণতন্ত্রের ভাষা নয়। হরতালের সমালোচনা হওয়া উচিত মূলত এ কারণে। এ ছাড়া হরতালের আরও সমালোচনার জায়গা রয়েছে। আমরা বিভিন্ন সময় বলেছি, সরকারের যেসব ব্যর্থতার প্রতিবাদে বিএনপি হরতাল ডেকেছিল, সরকারের থাকার সময় তারাও একইভাবে ব্যর্থ হয়েছিল। বিদ্যুতের ইস্যুতে সরকারের সমালোচনার আগে বিএনপিকে তাই এই খাতে তার নিজের অতীত ব্যর্থতার জন্য ক্ষমা চেয়ে ভবিষ্যতে তারা কী কী কর্মসূচি নিয়ে বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান করবে, তার বিশ্বাসযোগ্য ব্যাখ্যা দেওয়া উচিত। সন্ত্রাস, দলীয়করণ, দুর্নীতি, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। এসব বিষয়ে সংসদে বলার পর্যাপ্ত চেষ্টা করে ব্যর্থ হলেই কেবল শান্তিপূর্ণভাবে হরতাল কর্মসূচি দেওয়া উচিত।
সরকারের মন্ত্রীরা এ ধরনের যৌক্তিক কথা বলে হরতালের সমালোচনা করলে কোনো অসুবিধা নেই। কিন্তু সরকার অব্যাহতভাবে ‘ক্রসফায়ার’ বা বিরোধী দলের নেতাদের ‘গুম’ করে ফেললে, সীমাহীন দলীয়করণ চালালে বা সংসদে কথা বলতে না দিলেও হরতাল করা যাবে না, এটি ঠিক নয়। ঠিক নয় এসবের সঙ্গে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ইস্যুকে অযৌক্তিকভাবে সম্পর্কিত করা। হরতালের তুলনায় মানববন্ধন অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য কর্মসূচি। এই কর্মসূচিতে বাধা দিলে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের আর কি পথ খোলা থাকবে?

৩.
বিএনপির মানববন্ধন কর্মসূচি ছিল হরতালের দিন গ্রেপ্তার করা তাদের তিন নেতার মুক্তির দাবিতে। আমাদের প্রশ্ন, মীর্জা আব্বাস, বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা শমশের মবিন চৌধুরী এবং স্বাধীনতাযুদ্ধকালে শিশুবয়সী শহীদ উদ্দীন এ্যানী কি যুদ্ধাপরাধী? তাঁদের মুক্তির দাবির সঙ্গে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে নস্যাৎ করার সম্পর্ক কোথায়? এই দাবিতে কর্মসূচি দিলে সরকারকে এমনভাবে চড়াও হতে হবে কেন?
মানববন্ধন কর্মসূচি দিয়েছিল জামায়াতও। জামায়াতের মানববন্ধনের দাবি ছিল তাদের দলের তিন নেতার (নিজামী, মুজাহিদ ও সাঈদী) মুক্তির দাবিতে। তাঁদের সরকার যুদ্ধাপরাধের জন্য গ্রেপ্তার করেনি। যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে ১৯৭৩ সালের আইন অনুসারে তাঁদের গ্রেপ্তার করা হলে এবং তখন জামায়াত এর প্রতিবাদে কোনো কর্মসূচি দিলে তাকে প্রতিহত করার চেষ্টা অবশ্যই সরকার করতে পারে। তার আগ পর্যন্ত তিন নেতার মুক্তির দাবিতে মানববন্ধনকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার রোধ করার কর্মসূচি হিসেবে আখ্যায়িত করার কোনো সুযোগ নেই। ১৯৯৫-৯৬ সালে আওয়ামী লীগ জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে বিএনপির সরকারের অপশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিল। অপশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের অধিকার তখন জামায়াতের থাকলে এখনো তা আছে। তবে এই আন্দোলনকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নস্যাৎ করার দিকে ধাবিত করার অধিকার জামায়াত, বিএনপি বা অন্য কারও নেই। দেশের একটি প্রচলিত আইনে এই বিচার করা হচ্ছে। এই বিচারের বিরোধিতা শুধু নৈতিকভাবে নয়, আইনগতভাবেও তাই অবৈধ। কিন্তু যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করছে বলে এই সরকারের দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে ব্যর্থতা বা দমননীতির বিরুদ্ধে কোনো কর্মসূচি দেওয়া যাবে না, এটা বলাও অনুচিত ও অযৌক্তিক।
আমরা মনে করি, আগের বিএনপির সরকারের তুলনায় দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে লক্ষণীয় সাফল্য দেখাতে পারলেই বরং যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পরিবেশ আরও সুশক্ত হবে। এটি করা গেলে সরকরের জনসমর্থন বহু গুণে বাড়বে। ফলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরুদ্ধপক্ষ একে নস্যাৎ করার কোনো কর্মসূচি দিতে ভয় পাবে, দিলেও আদৌ সফল হবে না। আওয়ামী লীগের সরকারকে বুঝতে হবে দলীয়করণ, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি বা নতজানু পররাষ্ট্রনীতি দিয়ে জনসমর্থন হারালে, মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হয়ে দুর্নাম কুড়ালে সরকার পতনের যে পরিবেশ সৃষ্টি হবে, তাতেই বরং যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সম্ভাবনা বাধাগ্রস্ত হবে।

৪.
আওয়ামী লীগের সরকার দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে তার ব্যর্থতা ঢাকতে যুদ্ধাপরাধের বিচার বা জামায়াত ইস্যুকে ব্যবহার করার চেষ্টা করছে আরও বহুভাবে। আওয়ামী লীগের প্রতি মানুষের অসন্তোষ ও অভিযোগের একটি বড় কারণ ছাত্রলীগের অব্যাহত নৈরাজ্যকর এবং কখনো কখনো পাশবিক সন্ত্রাস। দেশে প্রধানমন্ত্রী নিজেই এতে যে বীতশ্রদ্ধ তার বিভিন্ন প্রমাণ পাওয়া গেছে। তার পরও এ সমস্যার কোনো সমাধান সরকার করতে পারেনি কেন?
সরকারের মন্ত্রীদের একটি তৈরি উত্তর আছে এই প্রশ্নের। তাঁদের বক্তব্য, ছাত্রলীগের ভেতর শিবির ঢুকে গেছে, তারাই অনেক ক্ষেত্রে এসব সন্ত্রাস করছে। আমরা বুঝতে অক্ষম আওয়ামী লীগের অভিভাবকত্বে থাকা এই সংগঠনে শিবির ঢোকে কীভাবে, কারা এ জন্য দায়ী, তাদের বিরুদ্ধে কেন তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না?
প্রশ্ন আরও আছে। ঢাকা বা অন্য কোথাও ছাত্রলীগের হাতে খুন-জখম হলে কেন গ্রেপ্তার করা হয় শুধু গুটিকয়েক মাঠপর্যায়ের কর্মীকে? দেশের সব পত্রপত্রিকায় জাহাঙ্গীরনগরের পাশবিক সন্ত্রাসের ঘটনায় সেখানকার ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে দায়ী করা হলেও তাঁদের দুজনকে কেন গ্রেপ্তার করা হলো না? শমশের মবিন চৌধুরী গাড়ি পুড়িয়েছেন, এহসানুল হক মিলন হাতঘড়ি ছিনতাই করেছেন এমন অদ্ভুত অভিযোগে তাঁদের রিমান্ডে নেওয়া গেলে হত্যা, সন্ত্রাস আর চাঁদাবাজির পর ছাত্রলীগের আসল হোতাদের কেন রিমান্ডে নেওয়া হয় না?
আমার খবর পাই, গোটা দেশের পুলিশ প্রশাসন ছাত্রলীগের সন্ত্রাস দমনে অনীহ থাকে অন্য একটি কারণে। কোনো পুলিশ কর্মকর্তার ছাত্রলীগ বা এর নেতাদের আশ্রয়ে থাকা সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তারের কোনো পদক্ষেপ নিলেই তাকে ‘জামায়াত-শিবিরের লোক’ হিসেবে চিহ্নিত করে ব্যাপক প্রচারণা চালানো হয় ছাত্রলীগ এমনকি আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে। ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের তাই গ্রেপ্তার করা হয় কেবল ব্যাপক সন্ত্রাস সংঘটিত হওয়ার পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশ পেলে। এর আগ পর্যন্ত এমনকি সংঘর্ষ চলাকালেও পুলিশ কাউকে গ্রেপ্তারের সাহস পায় না। হরতাল চলাকালে বিরোধী দলের ওপর পুলিশের উপস্থিতিতে হামলা এবং বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশের সামনেই ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষে তার প্রমাণ পাওয়া গেছে। কোনো পুলিশ কর্মকর্তা এ ধরনের পরিস্থিতিতে আইন অনুসারে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার করলে তাকে জামায়াত-শিবিরের লোক বলে অপদস্থ করা হবে না এই গ্যারান্টি কেউ কি দিতে পারবে?
এই গ্যারান্টি সরকারকেই দিতে হবে। বাছবিচার না করে সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তারের সুস্পষ্ট ও আন্তরিক নির্দেশ পুলিশের ওপর না থাকলে, ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে দায়িত্ব পালন করলে জামায়াত-শিবির অপবাদ পেতে হবে, এই আশঙ্কায় পুলিশ গুটিয়ে থাকলে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের কোনো দিনও দমন করা যাবে না, এই ঐতিহ্যবাহী সংগঠনটির আগের সুনামও ফিরিয়ে আনা যাবে না।

৫.
সরকারকে আরেকটি জিনিস বুঝতে হবে। জামায়াত-শিবির অপবাদে চাকরি হারানোর ভয়ে পুলিশ ছাত্রলীগের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে নিস্ক্রিয় থাকতে পারে। কিন্তু যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে বাধাদানের অপবাদ পেতে হতে পারে এই ভয়ে দেশের বিরোধী দলগুলো সরকারের কোনো ব্যর্থতার প্রতিবাদ করবে না, কর্মসূচি দেবে না, এটা আশা করা ঠিক নয়।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে প্রকৃতই কোনো বাধা থাকলে বা এলে তার উপযুক্ত প্রতিকার অবশ্যই সরকারকে করতে হবে। কিন্তু সবকিছুকে যুদ্ধাপরাধী বিচারের বাধা হিসেবে দেখালে আসল বাধাকে বরং দূর করা সরকারের জন্য দুঃসাধ্য হয়ে উঠবে।
সরকারকে বুঝতে হবে, একটি ভালো কাজ করলে সাত খুন মাফ হয়ে যায় না। তেমনি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করলেই সরকারের অন্য নানা ব্যর্থতা
ঘুচে যাবে না। এর প্রতিবাদও থেমে থাকবে না।
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

টার্গেট যখন ড. ইউনূস

২০০৯ সালের ৯ ডিসেম্বর ড. ইউনূসের বক্তৃতা শোনার জন্য ভারতের লোকসভা ও রাজ্যসভার একটি যুক্ত সভা হয়েছিল। সেখানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং ড. ইউনূসকে সম্মানিত বন্ধু হিসেবে সম্বোধন করে তাঁর সান্নিধ্য পাওয়া একটি সত্যিকারের প্রিভিলেজ (বিশেষ সুযোগ) হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন। আবেগপূর্ণ বক্তৃতার একটি অংশে তিনি বলেছিলেন: ‘২০০৬ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ীর কাছ থেকে আমাদের বহু কিছু শেখার আছে এবং আমি আবারও তাঁর কাজ এবং আমাদের মধ্যে তাঁর উপস্থিতিকে স্যালুট (অভিবাদন) জানাচ্ছি।’
ড. ইউনূসকে নিয়ে ঠিক এক বছর পর বাংলাদেশের কয়েকটি দৈনিকে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি সংবাদ প্রচারিত হয়। এতে বলা হয় যে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন ড. ইউনূস এবং তাঁর ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্পের তীব্র সমালোচনা করেছেন। ঢাকার ভারতীয় হাইকমিশন সঙ্গে সঙ্গে এই ভিত্তিহীন সংবাদের প্রতিবাদ করে। বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, এই প্রতিবাদপত্রটি উল্লিখিত দৈনিকগুলোর কোনো কোনোটি ছাপানোরই দায়িত্ব অনুভব করেনি।
ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে আরও ভয়ংকর অপপ্রচার চলে সে সময়। নরওয়ের টেলিভিশনের একটি প্রামাণ্যচিত্রে অভিযোগ করা হয়েছিল যে গ্রামীণ ব্যাংক দাতা প্রতিষ্ঠানের অনুমতি ছাড়া ব্যাংকের তহবিল থেকে অন্য একটি সহযোগী প্রতিষ্ঠানের তহবিলে টাকা স্থানান্তর করে অনুদানের শর্ত লঙ্ঘন করেছে। প্রামাণ্যচিত্রে কোথাও ড. ইউনূস কর্তৃক টাকা আত্মসাৎ বা দুর্নীতির অভিযোগ ছিল না। অথচ এই প্রামাণ্যচিত্রের বরাত দিয়ে কিছু কিছু পত্রিকার সংবাদে ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, তহবিল তছরুপ কিংবা টাকা আত্মসাতের অভিযোগ তোলা হয়। পরে নরওয়ে সরকার নতুনভাবে তদন্ত করে জানিয়ে দেয় যে বিষয়টি বহু আগে সুন্দরভাবে নিষ্পত্তি হয়েছে এবং তাতে দুর্নীতি বা টাকা আত্মসাতের কোনো বিষয় ছিল না।
বাংলাদেশে দুর্ভাগ্যজনকভাবে বিষয়টি সুন্দরভাবে নিষ্পত্তি হয়নি। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নিজে ড. ইউনূসকে গরিবের রক্তচোষা হিসেবে ইঙ্গিত করেন এবং ক্ষুদ্রঋণের বিষয়টি ব্যাপক তদন্ত হওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেন। এরপর সরকারের বিভিন্ন নীতিনির্ধারকেরা ড. ইউনূসের সমালোচনা করেন এবং সরকারপন্থী হিসেবে পরিচিত কিছু সংবাদমাধ্যমে ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে নানান কুৎসামূলক সংবাদ ও সংবাদভাষ্য প্রচারিত হতে থাকে। বিরোধী দলের নেতাদের বিরুদ্ধে যেভাবে হয়, অনেকটা তেমনভাবে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। ফেব্রুয়ারিতে ভিনদেশি নোবেল বিজয়ী অমর্ত্য সেনকে যখন সরকার নানাভাবে সম্মান জানাচ্ছে, সে সময় আমাদের দেশের একমাত্র নোবেল বিজয়ীকে জামিনের জন্য ছুটতে দেখা গেছে দেশের বিভিন্ন আদালতে।
২ মার্চ তাঁর ওপর আসে চূড়ান্ত আঘাত। সারা পৃথিবীতে সম্মানিত গ্রামীণ ব্যাংকের জন্মদাতা এবং নির্মাতাকে এদিন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদ থেকে ‘অব্যাহতি’ দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক একটি চিঠি দিয়ে। রাতে টেলিভিশন খুলে দেখি, আইন পেশার ধারে-কাছে নেই এমন কেউ কেউ এটি আইনগতভাবে করা হয়েছে বলে মন্তব্য করছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের একজন শিক্ষক প্রশ্ন তুলেছেন, দারিদ্র্য বিমোচনে গ্রামীণ ব্যাংকের আদৌ কোনো সফলতা আছে নাকি তা নিয়ে। এর আগে সম্মানজনক প্রতিষ্ঠানে অধিষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেকজন শিক্ষক ড. ইউনূসের সামাজিক ব্যবসা কর্মসূচির মাধ্যমে গরিবকে প্রতারণা করা হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছিলেন। ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে গত বছর প্রধানমন্ত্রীর সমালোচনার পর ইউনূসবিরোধী যে প্রচারণার কোরাস চলছে থেমে থেমে, তাতে দায়িত্বপূর্ণ পদে থাকা ব্যক্তিরাও যোগ দিয়েছেন কোনো তথ্য-প্রমাণ এমনকি যুক্তি ছাড়াই।
মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে সরকারের তদন্ত চলছে। আদালতে বিচার হচ্ছে। একই সঙ্গে একশ্রেণীর গণমাধ্যমের বিচার চলছে তাঁর বিরুদ্ধে। তিনি নতুন প্রতিষ্ঠান, চিন্তা ও কর্মপদ্ধতির উদ্ভাবন করে বাংলাদেশকে সারা বিশ্ব থেকে বিভিন্ন বিরল ও অনন্য সম্মান এনে দিয়েছেন। এমন একজন মানুষের সম্পর্কে সমালোচনার ক্ষেত্রে আমাদের দেশপ্রেম, দায়িত্ববোধ ও সংযম থাকা উচিত ছিল। তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আগে জনগণ ও বাংলাদেশের স্বার্থ এবং দেশের ভাবমূর্তি নিয়ে যথেষ্ট দায়িত্ববোধের পরিচয় দেওয়া উচিত ছিল।

২.
মুহাম্মদ ইউনূস কি তাই বলে সমালোচনার ঊর্ধ্বে? অবশ্যই না। তিনি সমালোচনার ঊর্ধ্বে নন, আইনের তো নয়ই। বহু বছর ধরে ড. ইউনূসের সমালোচনা করে আসছেন বদরুদ্দীন উমর। কোন সরকার ক্ষমতায় আছে, কখন প্রধানমন্ত্রী তাঁর ওপর রুষ্ট, এই হিসাব-নিকাশ তাঁর সমালোচনায় খুঁজে পাওয়া যাবে না। অন্য বহু ব্যক্তি ও গণমাধ্যম তাঁর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ড. ইউনূসের সমালোচনা করার পর। তাদের সমালোচনায় যুক্তি নেই, পাণ্ডিত্য নেই, এমনকি সৌজন্যবোধও নেই। সারা পৃথিবীতে বাংলাদেশের সবচেয়ে ইতিবাচক ব্র্যান্ডিং হচ্ছেন ড. ইউনূস। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যেখানে ইউনূস সেন্টার এবং মাইক্রোক্রেডিট ডিপার্টমেন্ট খুলে তাঁর চিন্তাকে অধ্যয়ন করছে, সেখানে বাংলাদেশে কিছু মানুষ কোনো প্রমাণ ছাড়া তাঁর বিরুদ্ধে কুৎসা রচনায় নেমেছে। আমাদের আপত্তি সেখানেই।
ব্যক্তির সমালোচনার চেয়ে মারাত্মক হয়ে দাঁড়িয়েছে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের আক্রমণ। বাংলাদেশ ব্যাংকের চিঠিতে তাঁকে অপসারণের ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছে। পত্রিকায় দেখেছি, তাঁকে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদ থেকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে দুটো কারণ দেখিয়ে। প্রথমত, তাঁর নিয়োগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের পূর্বানুমোদন নেওয়া হয়নি। দ্বিতীয়ত, তিনি চাকরির বয়সসীমা ৬০ পার করেছেন অনেক বছর আগে। আমার মতে, এই দুটো যুক্তির কোনোটিই ড. ইউনূসের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। ‘গ্রামীণ ব্যাংক অর্ডিন্যান্স, ১৯৮৩’ নামে আলাদা একটি আইন অনুসারে গ্রামীণ ব্যাংক পরিচালিত। এই আইনের ৩৬ ধারায় গ্রামীণ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদকে ব্যাংকের দক্ষ পরিচালনার স্বার্থে বিধি প্রণয়নের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। ১৯৯০ সালের গ্রামীণ ব্যাংক (সংশোধন) আইনের ১৪ ধারা অনুসারে বিধিগুলো সরকার কর্তৃক পূর্বানুমোদন করানোর প্রয়োজন নেই। সে মোতাবেক ২০০১ সালের ১৯ নভেম্বর গ্রামীণ ব্যাংক একটি বিধি প্রণয়ন করে, যাতে বলা হয় ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে চাকরির ক্ষেত্রে কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমা থাকবে না এবং গ্রামীণ ব্যাংকের চাকরিবিধি ব্যবস্থাপনা পরিচালকের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না। এই বিধি যদি অবৈধ না হয়ে থাকে, তাহলে বাংলাদেশ ব্যাংক বয়স বা পূর্বানুমোদনের কথা বলে তাঁকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দিতে পারে না। এই বিধি অনুসারে গ্রামীণ ব্যাংক ১০ বছর যাবৎ পরিচালিত হচ্ছে এবং বাংলাদেশ ব্যাংক এই বিধিকে অবৈধ ঘোষণা না করে বা এ সম্পর্কিত কোনো আইনি উদ্যোগ না গ্রহণ করেই গ্রামীণ ব্যাংকের সঙ্গে যাবতীয় কার্যক্রম চালিয়েছে। ড. ইউনূসকে আইনসংগতভাবে অপসারিত করতে চাইলে এই বিধি আদালত কর্তৃক অবৈধ ঘোষণা করানোর বা এটি পরিচালনা পর্ষদের সভায় বাতিল করার চেষ্টা করা আবশ্যক ছিল।
বাংলাদেশ ব্যাংক ড. ইউনূসকে অপসারিত করতে পারে কি না, তা নিয়েও আইনগত প্রশ্ন তোলা যায়। জেনারেল ক্লজেস অ্যাক্ট অনুসারে চাকরিদাতাই কেবল চাকরি থেকে কাউকে অপসারিত করতে পারে। গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে নিয়োগ প্রদান করে ব্যাংকের বোর্ড অব ডিরেক্টরস বা পরিচালনা পর্ষদ। বাংলাদেশ ব্যাংক কেবল এটি অনুমোদন করতে পারে বা অনুমোদন না করতে পারে। আমাদের প্রশ্ন, ১৯৯০ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক তাঁকে নিয়োগের ক্ষেত্রে যেসব শর্ত দেয় তা ২০০১ সালের বিধির মাধ্যমে লঙ্ঘিত হয়ে থাকলে ১০ বছর ধরে বাংলাদেশ ব্যাংক তাঁকে মেনে নিল কেন? প্রিন্সিপল অব এসটোপেল অনুসারে বাংলাদেশ ব্যাংক ১০ বছর পর এখন ভিন্ন ভূমিকা নিতে পারে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত ছিল গ্রামীণ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের কাছে তার অভিমত জানানো এবং সে অনুসারে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য নির্দেশ দেওয়া। পরিচালনা পর্ষদ ড. ইউনূসকে সে অনুসারে অব্যাহতি না দিলে বাংলাদেশ ব্যাংক আদালতে যেতে পারত। কিন্তু তাই বলে সরাসরি চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়ার ক্ষমতা বাংলাদেশ ব্যাংকের নেই। গ্রামীণ ব্যাংক যে আইন দ্বারা পরিচালিত তাতে ঠিক এ ধরনের কোনো ক্ষমতা বাংলাদেশ ব্যাংককে প্রদান করা হয়নি। ন্যায়বিচার এবং আইনের শাসনের একটি মৌলিক নীতি হচ্ছে, কাউকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়ার আগে তাঁকে নোটিশ দেওয়া ও তাঁর বক্তব্য শোনা। ড. ইউনূসের ক্ষেত্রে এমনকি এই নীতিও মানা হয়নি।

৩.
৭০ বছর হয়েছে তাই ড. ইউনূসের চলে যাওয়া উচিত কিংবা চিরদিন এক পদ ধরে না রেখে তাঁর চলে যাওয়া উচিত—এ ধরনের কথাও বলছেন সরকারের কেউ কেউ। তাঁদের কেউ কেউ ড. ইউনূসের চেয়েও বয়স্ক বা তাঁর সমবয়সী। সরকার অবসর থেকে ডেকে এনে যাঁদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিচ্ছে, তাঁদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। আমরা মনে করি, বয়স নয়, জনস্বার্থ ও প্রতিষ্ঠানের স্বার্থে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে দক্ষতা ও নেতৃত্বের যোগ্যতা। ড. ইউনূস কি তাঁর দক্ষতা হারিয়েছেন, তাঁর বয়সের কারণে গ্রামীণ ব্যাংকের বিকাশ কি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে? দেশে এবং সারা বিশ্বে ব্যাংকের বিকাশ এবং ক্রমবর্ধমান গুরুত্ব তো দিন দিন বরং বৃদ্ধিই পাচ্ছে।
ড. ইউনূসের একটি ব্যর্থতা হচ্ছে, তিনি তাঁর উত্তরসূরি তৈরি করতে পারেননি। বাংলাদেশের প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত ব্যক্তির বিরুদ্ধে একই অভিযোগ তোলা যায়। ড. ইউনূস এর কোনো উজ্জ্বল ব্যতিক্রম হতে পারেননি। ভালো হতো, তিনি যদি তা পারতেন। ভালো হয়, সরকার ও গ্রামীণ ব্যাংক যদি অন্য কোনোভাবে ব্যাংক এবং এর সব সহযোগী প্রতিষ্ঠানে তাঁর ব্যক্তিত্ব, পাণ্ডিত্য ও অভিজ্ঞতাকে স্থায়ী ও কার্যকরভাবে ব্যবহারের লক্ষ্যে কোনো আইনি সংস্কার করতে পারে। সম্মানজনকভাবে আলোচনার মাধ্যমে এখনো তা করা সম্ভব।
আমাদের বুঝতে হবে, এখন যেভাবে তাঁকে অপসারিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে, তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। হোসেন জিল্লুর রহমান বলেছেন, এটি জনস্বার্থমূলক নয় এবং এতে সুশাসনের কোনো লক্ষণ নেই। প্রথম আলোর ওয়েবসাইটে অধিকাংশ পাঠক এতে দেশের ভাবমূর্তি এবং গ্রামীণ ব্যাংকের প্রাতিষ্ঠানিক ভিত ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। বিশ্বের বিভিন্ন গণ্যমান্য প্রতিষ্ঠান, সংগঠন ও ব্যক্তিরা এর নিন্দা করছেন। উন্নয়ন-সহযোগীরা বহু আগে থেকে ড. ইউনূসকে যেভাবে আক্রমণ করা হচ্ছে তাতে তাদের আপত্তির কথা জানিয়ে আসছে।
ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শুধু সরকার, ড. ইউনূস বা গ্রামীণ ব্যাংক নয়। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ও স্বার্থ। হুমকির মুখে পড়েছে দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচির সুবিধাভোগী লাখ লাখ সাধারণ মানুষ।
আমাদের উৎকণ্ঠা সেখানেই।
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
তারিখ: ০৪-০৩-২০১১

দেশপ্রেমের হরতাল

গত ৩০ জুন হেঁটে যাচ্ছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবে। দূর থেকে স্লোগানের শব্দ শুনে ফিরে তাকাই। দিগন্তে আলোর নাচন, দৃপ্ত মশাল উঁচিয়ে এগিয়ে আসছে মিছিল। ফুটপাতে দাঁড়িয়ে মিছিলের জন্য অপেক্ষা করি, পাশে এলে তার সঙ্গে এগোই কিছুটা পথ। এই মিছিলের তরুণ-তরুণীদের চিনি আমি। এরা ছাত্র ইউনিয়ন, সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টসহ বিভিন্ন বাম সংগঠনের ছেলেমেয়ে। এরাই তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির কর্মী। এদের মিছিল ক্ষমতায় যাওয়ার মিছিল নয়, উচ্ছিষ্ট ভোগের লোভ নয়, নেতা-নেত্রীর বন্দনার জন্য নয়। এই মিছিল দেশকে ভালোবাসার। এই মিছিল দেশের সম্পদ রক্ষার। একটি দেশপ্রেমিক হরতালকে সফল করার আহ্বানের।
বহুদিন পর এমন একটি হরতাল দেখলাম আমরা। এই হরতাল কি সফল হবে? সরকারের ভয়, প্রলোভন আর দাসত্ব যাদের গ্রাস করেছে, তারা হয়তো বলবে, একদম সফল হয়নি। তাতে আমাদের কিছু আসে-যায় না। এই হরতাল ডাকার মানুষ আজও আছে দেশে, এটাই স্বস্তিকর। এই হরতালে সমর্থন নেই বিএনপি-জামায়াত-জাতীয় পার্টির। এই হরতাল দমনে মারমুখী হয়ে নেমেছে সরকারের পুলিশ আর গোয়েন্দা। দেশের সম্পদ রক্ষায় সোচ্চার তরুণ-তরুণীকে নির্দয় লাঠিপেটা করেছে, বন্দী করে নিয়ে গেছে পুলিশের খাঁচায়। এই হরতালে ভয় পায় সব সরকার। কারণ, কোনো না কোনোভাবে এরা সবাই বিশ্ব পুঁজিবাদের দাস। ক্ষমতার লড়াইয়ে আন্তর্জাতিক আধিপত্যবাদ ও লুটেরা শক্তির অনুগ্রহপ্রত্যাশী। তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ বিদেশিদের হাতে অসম চুক্তিতে তুলে দেওয়ার উৎকোচ এরা গ্রহণ করে নানাভাবে।
হরতাল ডাকা হয়েছে যেসব দাবিতে এবং যেসব প্রশ্ন তুলে, তার উত্তর নেই এদের কাছে। যুক্তিপূর্ণ উত্তর যেখানে নেই সেখানে থাকে মিথ্যাচার, নিন্দা আর চরিত্র হননের অপচেষ্টা। হরতাল ডেকেছে জাতীয় কমিটি। বলা হচ্ছে শুধু কমিটির সদস্য-সচিব আনু মুহাম্মদের নাম। এক নেতা প্রশ্ন তুলেছেন, হরতাল ডাকার জন্য আনু মুহাম্মদ কে? আরেক অর্ধেক মন্ত্রী সংসদে তাঁকে মনু মুহাম্মদ ডেকে স্থূল ভাঁড়ামো করেছেন।
দেশ আর ইতিহাসবিস্মৃত মানুষের পক্ষে এমন আচরণ অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু আমরা আনু মুহাম্মদকে দেখেছি, তরুণ বয়সেই তেল-গ্যাস-অস্ত্রকেন্দ্রিক আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র নিয়ে গবেষণাধর্মী লেখা লিখতে। অন্য অনেকের মতো আমল বুঝে নয়, সব সরকারের আমলেই তিনি এই ষড়যন্ত্রবিরোধী লড়াইয়ে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। শুধু তিনি নন, জাতীয় কমিটির সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য এর অধিকাংশ নেতার অঙ্গীকার, দেশপ্রেম আর অবিচল পক্ষপাতশূন্যতা। আমাদের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, দেশের সংকটকালে জাতীয় কমিটির লোকদের কখনো দেখা যায়নি। আমার মনে হয় না, তিনি এই কমিটি সম্পর্কে খুব বেশি জেনে এটি বলেছেন। এই কমিটির আহ্বায়কসহ অনেক নেতা সেই বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে সব প্রগতিশীল ও জনস্বার্থমূলক আন্দোলনে শরিক থেকেছেন। নিকট অতীত থেকেই উদাহরণ দিই। বিগত বিএনপি সরকারের আমলে বিবিয়ানা কূপ থেকে ভারতে গ্যাস রপ্তানি, উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন এবং চট্টগ্রাম বন্দর মার্কিন কোম্পানির হাতে তুলে দেওয়ার চেষ্টা প্রতিরোধ করেছিল মূলত এই কমিটিই। ২০০৫ সালে এশিয়া এনার্জির কাছে কয়লা সম্পদ তুলে দেওয়ার বিরুদ্ধে কমিটির ডাকা হরতালে সমর্থন জানিয়েছিলেন স্বয়ং শেখ হাসিনা।
আমরা স্বীকার করি, কোনো বিষয়ে সরকারের নিজস্ব অভিমত ও বিচার-বিবেচনা থাকতে পারে। কিন্তু তাতে তো তাঁদের কর্তব্য শেষ হয়ে যায় না। বহু কাটাছেঁড়া এবং তুঘলকি কর্মকাণ্ডের পরও দেশের সংবিধানে এখনো দেশের এবং এর সব সম্পদের মালিক জনগণ। সরকারের কাছে আমাদের বিনীত প্রশ্ন, জনগণের সম্পদ নিয়ে কী শর্তে কেন বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করা হলো, তা জনগণকে কেন জানতে দেওয়া হবে না? কেন এই চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বিবরণ প্রকাশ করা হবে না?
আমরা শুধু জানি, কনোকোফিলিপসের সঙ্গে চুক্তি করা হয়েছে পিএসসি-২০০৮-এর অধীনে। জাতীয় কমিটি এর কয়েকটি অনুচ্ছেদকে জাতীয় স্বার্থবিরোধী বলছে এবং কিছু প্রশ্ন তুলেছে। যেমন—কেন কনোকোফিলিপসের প্রাথমিক বিনিয়োগের চেয়ে তিন গুণ বেশি অর্থ ব্যয়ে ১৭৫ মাইল পাইপলাইন স্থাপন করলেই কেবল বাংলাদেশ প্রাপ্ত গ্যাসের মাত্র ২০ শতাংশের অধিকারী হবে? ‘দুর্ঘটনার রাজা’ হিসেবে পরিচিত কনোকোফিলিপসের কর্মকাণ্ডের ঝুঁকি থেকে বঙ্গোপসাগর, তার সম্পদ ও প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষার কী নিশ্চয়তা চুক্তিতে রয়েছে? এই চুক্তির মাধ্যমে বঙ্গোপসাগরের সীমানা নিয়ে ভারত ও মিয়ানমারের দাবি কি একপক্ষীয়ভাবে মেনে নেওয়া হলো? জাতীয় কমিটির সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, পুঁজি সংগ্রহ করে এবং প্রয়োজনীয় সাব-কনট্রাকটিং করে তেল-গ্যাস উত্তোলনের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ আমরা নিজেরাই কেন গ্রহণ করি না?
জাতীয় কমিটির নিজস্ব বক্তব্য আছে এসব প্রশ্নের। তাদের সব বক্তব্য-বিশ্লেষণ অকাট্য না-ও হতে পারে। তাদের বক্তব্যে এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাস্তবতার কমতিও থাকতে পারে। কিন্তু তাদের নির্দিষ্ট বক্তব্যের কোনো উত্তর নেই কেন সরকারের? কেন তারা প্রকাশ করছে না কনোকোফিলিপসের সঙ্গে চুক্তি বা ভারত-আমেরিকাসহ অন্য রাষ্ট্র বা বিদেশি কোম্পানিদের সঙ্গে সম্পাদিত সব চুক্তি? কেন সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা অনুসারে সংসদে পেশ করা হয় না এসব চুক্তি?
আওয়ামী লীগ-বিএনপি কেউ এসব প্রশ্নের উত্তর দেবে না। তাদের অশুভ অলিখিত আঁতাত এখানেই। এই আঁতাতে আমরা অন্যান্য দলের বর্ণচোরাদেরও মাঝেমধ্যে কৌশলে অংশ নিতে দেখি। এত অন্ধকারে তাই দেশপ্রেমী বামদের মশাল মিছিল অক্ষয় আলো হয়ে থাকে। তাদের হরতালই প্রকৃত দেশপ্রেম।
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

একটাই প্রার্থনা এখন

পাঁচ-ছয় বছর আগের কথা। বাংলাদেশ দলে এসেছেন নতুন এক মারকুটে ব্যাটসম্যান। দলের প্রথম ব্যাটসম্যান প্রায়ই আউট হয়ে ফিরে আসেন শ খানেক রানের মধ্যে। তারপর নামেন অলক কাপালি নামের এক উদ্ধত যুবক। কখনো খালেদ মাসুদ, কখনো রফিককে নিয়ে অবলীলায় মারতে থাকেন বাঘা বাঘা বোলারকে। রক্তে নাচন শুরু হয়। উত্তেজনায় শিরদাঁড়া খাড়া হয়ে ওঠে। উল্লাসে কত অর্থহীন কথা বলে উঠি! একবার তাঁর ছয় মারা দেখে চিৎ কার করে বলি, ‘সব সম্পত্তি দিয়ে দেব তোমাকে!’ আমার মেয়ে রিমঝিম সকৌতুকে বলে, ‘আব্বু, তোমার তো কোনো সম্পত্তিই নেই!’ অতি সত্যি কথা। কিন্তু তবু আমি বিরক্ত হই, বের করে দিই তাকে টেলিভিশনের সামনে থেকে। আমার মেয়ে একটু পরে উঁকি দিয়ে বলে, ‘আব্বু, আলাকাপালা আউট নাকি!’ আমাকে খেপানোর জন্য সে অলক কাপালির নাম অশুদ্ধভাবে বলে। কিছুক্ষণ পর খেলা শেষ হয়। অলক-পাইলটদের বীরত্ব শেষ হয়েছে। বাংলাদেশ আবারও হেরেছে। অন্ধকার ঘরে চুপচাপ বসে থাকি আমি। আমার মেয়ের মায়া হয় বোধহয়; কাঁচা ভঙ্গিতে বোঝানো শুরু করে, হেরেছে তো কী হয়েছে! দেখো, একদিন জিতবে।
সেই একদিন আসে এক-দুই বছর পরপর। আল-শাহরিয়ার, হান্নান শাহ, রাজিন সালেহ, মুশফিকুর রহমান, ফরহাদ রেজা, তাপস বৈশ্য—কত সম্ভাবনা নিয়ে আসেন এক-একজন। বারুদের মতো কিছুদিন জ্বলে উঠেই সব শেষ। আশরাফুলের বারুদের উত্তাপ বেশি, কিন্তু সেও অনিয়মিত। হাবিবুল বাশার, পাইলট, রফিক চেষ্টা করেন যথাসাধ্য। কিন্তু তা সম্মানজনক পরাজয়ের চেষ্টা, বিজয়ী হওয়ার উদ্ধত সাহস পুরোপুরি নেই তাঁদের। ম্যাচের পর ম্যাচ হারে বাংলাদেশ। লাঞ্ছিত, অপমানিত, ছিন্নভিন্ন হয়ে বসে থাকি খেলা শেষে। আমি, আমার চেনাজানা আরও কত মানুষ! সে কি ক্রিকেটের জন্য? না, সে আমার প্রিয় মাতৃভূমির জন্য। তার পরাজয়ের বেদনায়।
বুকের ভেতর থাকে কত রকম দীর্ঘশ্বাস! অলিম্পিকে কতবার জিতে যায় ছোটখাটো ভুখা-নাঙা মানুষের দেশ! পদক নেওয়ার সময় তাদের পতাকা ওঠে, জাতীয় সংগীত বেজে ওঠে। কেনিয়া, ইথিওপিয়া, জ্যামাইকার সোনাজয়ী মানুষের চোখে পানি আসে। আসে আমাদের চোখেও। আহা রে! কবে জিতবে বাংলাদেশ! কবে সব পতাকা ছাপিয়ে উঠবে বাংলাদেশের পতাকা! অলিম্পিকে আশা নেই, বিশ্বকাপ ফুটবলে আশা নেই, টেনিস-বাস্কেটবল-গলফ—কোথাও নেই বাংলাদেশ। রাজনীতি আর অর্থনীতি দূরের কথা, খেলায়ও নেই বাংলাদেশ। কিন্তু বাংলাদেশ থাকতে পারে কেবল ক্রিকেটেই। যদি কিছু হয়, ক্রিকেটেই হবে। নাছোড়বান্দার মতো লেগে থাকে বাংলাদেশের মানুষ। পরাজয়ের পর পরাজয়ে নীল হয় হূদয়, তবু ফিরে আসে তারা বারবার। স্টেডিয়ামে না পারলে টিভি বা রেডিওর সামনে।
সেই দিন এসেছে বাংলাদেশের। বিশ্বকে চ্যালেঞ্জ জানানোর অমিত প্রতিভা, দুঃসাহস আর দৃঢ়চিত্ত নিয়ে এসেছেন আমাদের সাকিব, আমাদের তামিম। টানা দুই বছর ধরে কে বিশ্বের সেরা ওয়ান-ডে অলরাউন্ডার? আমাদের সাকিব। কে উইজডেনের বর্ষসেরা ব্যাটসম্যান? আমাদের তামিম। আমাদের রাজ্জাক আর শফিউল এখন পারেন যেকোনো ব্যাটসম্যানের উইকেট গুঁড়িয়ে দিতে। সাকিব-তামিমের অবিশ্বাস্য উজ্জীবনী ক্ষমতায় গত দুই বছরে একের পর এক বিশ্বসেরা দলকে নাস্তানাবুদ করেছে বাংলাদেশ। অস্ট্রেলিয়া হোক, ভারত হোক, বাংলাদেশ এখন আর সম্মানজনক পরাজয়ের আশায় খেলে না। খেলে বিজয়ের প্রত্যয় নিয়ে।
বাংলাদেশ কি জিতবে এবার বিশ্বকাপ? না জিতুক, বিশ্বসেরা দু-তিনটি দলকে তো হারাতে পারি আমরা। এই বিশ্বাস অন্তত অর্জন করেছে বাংলাদেশ। আমার কেবলই মনে হয়, এই বিশ্বাস যদি থাকত সব ক্ষেত্রে! সুশাসন, শিক্ষা, অর্থনীতি, অবকাঠামো, আবিষ্কার, অর্জন—সবকিছুতে যদি থাকত এই বিশ্বাস! যদি থাকত বিশ্বসেরাদের কাতারে ওঠার সম্ভাবনা!
সারা বিশ্বে বাংলাদেশের নামও যদি উচ্চারিত হতো শ্রদ্ধা আর সম্মানের সঙ্গে!

২.
আমাদের দেশ নিয়ে তেমন কোনো উচ্ছ্বাস নেই অন্য কারও। নিজের দেশটা সম্পর্কে বাইরের পৃথিবীর ধারণা ভালোভাবে বোঝা যায় সেসব দেশে গেলে। আমাদের জন্য সে অভিজ্ঞতা সুখের হয় না অনেক সময়। ১৯৯৪ সালে লন্ডনে পড়তে গিয়ে লন্ডন হাউসে থাকার সুযোগ হলো আমার। অন্য দেশের ছাত্ররা এসে জানতে চায় কোন দেশ থেকে এসেছি। বাংলাদেশ শুনে চুপ করে থাকে তারা। আমি আগ্রহ নিয়ে বলি, নাম শুনেছ বাংলাদেশের? হ্যাঁ, শুনেছে তারা। বাংলাদেশ পানিতে ডুবে থাকা দেশ আর তসলিমা নাসরিনকে বের করে দেওয়া দেশ! আমি প্রায় হাহাকার করে তাদের বোঝানোর চেষ্টা করি, অনেক অর্জন আছে আমাদের।
একাত্তরের স্বাধীনতাযুদ্ধের কথা শুনেই কিছুটা সম্ভ্রম জাগে তাদের। বাইরের বিশ্বে তাক লাগানো অন্য কোনো অর্জন নেই আমাদের। গরিব, প্রাকৃতিক দুর্যোগ আর রাজনৈতিক হানাহানির দেশ আমাদের। এই পরিচয় মুছে দেওয়ার শক্তি ছিল না তখন কারও।
সময় এগোয়। বাংলাদেশের ছবি উজ্জ্বল করতে পারি না আমরা। অন্য দেশের এয়ারপোর্টে আমাদের পাসপোর্ট নিয়ে ইমিগ্রেশন অফিসারদের উল্টেপাল্টে দেখা শেষ হয় না। পাসপোর্টের ছবির সঙ্গে চেহারা মিলিয়ে দেখা, শূন্যে উঁচু করে ধরে পাসপোর্ট ঠিক নাকি দেখা, কম্পিউটারে অনবরত টিপাটিপি করে কী সব পরীক্ষা করে দেখা—তাদের সন্দেহ যেন কাটে না কিছুতেই। পেছনে বিরক্ত মানুষের লাইন, সামনের ডেস্কে সন্দিহান অফিসার। তাঁর সন্দেহ না কাটলে আরেক ডেস্কে পাঠানো। সবাই বের হয়ে যায়, শুধু আটকে থাকি আমরা আর আফ্রিকার কালো কিছু মানুষ। কত দিন আমার ইচ্ছে হয়, পালিয়ে যাই এই অপমান থেকে। কত দিন মনে হয়, পিএইচডি করতে গিয়ে অন্য কোনো শিক্ষকদের মতো চেষ্টা করলাম না কেন ব্রিটেনের পাসপোর্ট পাওয়ার। একসময় সবুজ ময়লা পাসপোর্ট ফেরত আসে হাতে। বুকের ভেতর হু-হু করে ওঠে, এই পাসপোর্ট আমার মাতৃভূমির। শত অপমানে কোনো দিন কখনো ত্যাগ করব না তাকে।
কিন্তু আমাদেরও ইচ্ছে হয় পৃথিবীর বুকে বাংলাদেশকে মাথা উঁচু করে দাঁড় করাতে। এই কাজ বিচ্ছিন্নভাবে কিছু ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান করেছে। ড. ইউনূস নোবেল পুরস্কার পেয়ে বাংলাদেশকে একটি ক্ষেত্রে হলেও সম্মানের সর্বোচ্চ শিখরে নিয়েছেন। তাঁর গ্রামীণ ব্যাংক আর ড. আবেদের ব্র্যাক সারা বিশ্বে অনুকরণীয় উন্নয়নের মডেল হয়েছে। দুই নেত্রী এরশাদের সামরিক জান্তাকে রুখে দিয়ে বাংলাদেশ সম্পর্কে সারা বিশ্বের সম্ভ্রম অর্জন করেছিলেন। আমাদের সেনাবাহিনী আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষার কাজ করে সারা বিশ্বে প্রশংসিত হয়েছে। কৃষিক্ষেত্রে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায়, নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ কিছু সাফল্য অর্জন করেছে। টুকরো টুকরো এসব সাফল্যে গোটা দেশ যত দূর এগিয়েছে, তার চেয়ে অনেক বেশি এগিয়েছে আমাদের প্রতিবেশী বা আমাদের সঙ্গে একসময়ের তুলনীয় দেশগুলো। বেদনার বিষয় হলো, আমরা আমাদের সাফল্য সংহত করতে পারিনি। নিজেরা নিজেরা হানাহানি করে, একে অন্যের সর্বাত্মক চরিত্র হনন করে, দেশের ঊর্ধ্বে দল বা ব্যক্তিকে স্থান দিয়ে, নিজের দেশ সম্পর্কে অপপ্রচারে নানাভাবে নিজেরাই অংশ নিয়ে সাফল্যের টুকরো টুকরো ক্যানভাসকে কালিমালিপ্ত করার আত্মবিনাশী কাজ আমরা করেছি। বাংলাদেশের পজিটিভ ব্র্যান্ডিং দূরের কথা, বাংলাদেশকে অপমানিত করার খবর আমরাই জন্ম দিয়েছি। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এক ভাষা, এক সংস্কৃতি, এক জনগোষ্ঠীর দেশে নিজেদের গোষ্ঠীস্বার্থে কৃত্রিমভাবে হুটু-টুটসির মতো বিবদমান বিভাজন তৈরি করেছেন আমাদেরই সর্বোচ্চ নেতারা।
আমাদের দিন ফেরেনি। বাংলাদেশ তার প্রকৃত শক্তি আর সম্মান নিয়ে বিশ্বে দাঁড়াতে পারেনি। হালকা কথা মনে হতে পারে কারও কাছে, তবু বলি, একমাত্র ক্রিকেটেই মনে হয় নিজেদের প্রকৃত শক্তি অনেকটা দেখাতে পেরেছি আমরা। ক্রিকেটে অন্তত আওয়ামী লীগ-বিএনপি বিভাজন নেই; দুর্নীতি, সাম্প্রদায়িকতা আর সন্ত্রাসের কালিমা নেই। ক্রিকেটেই শুধু দুই নেত্রীর প্রতি কোনো হুমকি নেই। গত কয়েক বছরে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে উল্লেখযোগ্যভাবে শুধু নোবেল বিজয় আর ক্রিকেট সাফল্যেই ইতিবাচক শিরোনাম হয়েছে বাংলাদেশ।
নোবেল বিজয়ীর চরিত্র হননে নেমেছে এখন নানা মহল। ঢালাও অভিযোগ আনা হচ্ছে, প্রত্যন্ত অঞ্চলে মামলা দায়ের করে হয়রানি করা হচ্ছে তাঁকে। ব্যর্থতার দায়ে যাঁর পদত্যাগের দাবি উঠেছে নানা মহলে এমন একজন মন্ত্রী নোবেল বিজয়ীকেই বলছেন গ্রামীণ ব্যাংক থেকে পদত্যাগ করতে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে সমালোচিত হচ্ছেন নোবেল বিজয়ী নন, তাঁর প্রতিপক্ষরা, এক অর্থে গোটা বাংলাদেশ।
তবু ভালো, ক্রিকেটকে অন্তত কালিমালিপ্ত করিনি আমরা। শেয়ারবাজার, দ্রব্যমূল্য, বিদ্যুৎ আর রাজনৈতিক সংঘাতে বিপর্যস্ত মানুষ কিছুদিন অন্তত দুঃখ ভুলে থাকতে পারে ক্রিকেটের মধ্যে; সাকিব বাহিনীর সাফল্যে নির্ভেজাল আনন্দে উদ্বেল হতে।

৩.
বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের তাই অভিনন্দন। মায়ের মতো স্নেহকণ্ঠে ক্রিকেটারদের সাফল্য চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী; তাঁকে অভিনন্দন। বিরোধী দলের নেত্রী বিশ্বকাপে কর্মসূচি দেবেন না; তাঁকেও অভিনন্দন। কয়েক সপ্তাহ থাকি না আমরা সব বিভেদ ভুলে! থাকি আমাদের ছেলেদের সাফল্য কামনায়, অসামান্য একটি আয়োজন সফল করার চেষ্টায়। কিছুদিনের জন্য বাংলাদেশ হোক না গৌরবদীপ্ত শিরোনাম!
আমি কল্পনায় দেখি, বাংলাদেশ খেলছে। সারা দেশের মানুষ দুই হাত তুলে, দুই হাত জোড় করে প্রার্থনা করছে। সারা দেশের একটাই প্রার্থনা, বাংলাদেশের বিজয়। ক্রিকেটের আনন্দাশ্রু, দীর্ঘশ্বাস, উল্লাসে যে নিখাঁদ ঐক্য আমাদের, তা-ই আমাদের দেশপ্রেম। তা-ই আমাদের এগিয়ে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা।
আমি বিশ্বাস করি, একদিন এই ঐক্যের ভূমি থেকেই জন্ম নেবেন আমাদের কোনো নেতা, আমাদের প্রকৃত অগ্রনায়ক।
আসিফ নজরুল: রাজনৈতিক বিশ্লেষক, গবেষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক।

স্বাধীন দেশ, পরাধীন মন

বাঙালি মধ্যবিত্তের পরাধীন মন নিয়ে অনেক কথা হতো একসময়। এ নিয়ে লিখেছেন দুই বাংলার নামী কয়েকজন লেখক। এখন অবস্থা বদলেছে কিছু ক্ষেত্রে। এই বাংলার মানুষ স্বাধীন দেশ পেয়েছে। মধ্যবিত্তের আকার বেড়েছে বহু গুণ, কেউ কেউ নানা উপায়ে বিপুল সম্পদের মালিকও হয়েছে। এখন পরাধীনতা থাকার কথা নয় আমাদের। কিন্তু এখনো বাঙালি মধ্যবিত্তের সবচেয়ে সুবিধাভোগী অংশের মধ্যে রয়েছে ঔপনিবেশিকতার ভূত, মানসিক পরাধীনতার শৃঙ্খল। মাঝেমধ্যে তা এতই প্রবল যে মন খারাপ করে বসে থাকতে হয় অনেকক্ষণ।
পরাধীন মানুষের দেশপ্রেম কম থাকে। আত্মসম্মানবোধ সম্ভবত আরও কম। অথচ সরকারে হোক সরকারের বাইরে হোক, পরাধীন মানুষেরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমাদের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। দেশে এদের দম্ভ আর দাপটের শেষ নেই। কিন্তু সব দাপট, সব আত্মসম্মান ম্লান হয়ে যায় অন্য জায়গায়। উপসচিব বা যুগ্ম সচিব মর্যাদার বিদেশি দূতের কাছে এরা নতজানু হয়ে থাকে, বিদেশে সামান্য খাতির পেলে এরা ধন্য হয়ে যায়, নিম্নশ্রেণীর বিদেশি পরামর্শকদের এরাই মাথায় তোলে। বিদেশের টাকায় নিজের দেশের দোষত্রুটি ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে সারা বিশ্বে এরাই প্রচার করে। বিনিময়ে পুরস্কৃত হয় ব্যক্তি বা গোষ্ঠীবদ্ধভাবে। ডুবিয়ে দেয় দেশকে।
পরাধীন মানুষ নিজ দেশের মানুষের স্বার্থ নিরাপদ করতে পারে না। পারে না দেশের সম্পদ রক্ষা করতে। দেশের গ্যাস বিদেশিদের কাছে রপ্তানি করার সার্টিফিকেট এরাই দিয়েছিল। প্রকৌশলী শহীদুল্লাহ্ আর আনু মুহাম্মদের মতো দেশপ্রেমিক মানুষ না থাকলে, তাঁদের আন্দোলন না থাকলে এরা তখনই সফল হতো। পরাধীন মানুষ দেশের পানিসম্পদ উজাড় করার ভারতীয় প্রকল্পে সমর্থন দেয়। বিদেশিদের বক্তব্য স্বদেশি কণ্ঠে প্রচার করে মানুষকে বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টা চালায়। পরাধীন মানুষ ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের কাছে বেহাত হওয়া হাজার কোটি টাকার সম্পদ ফেরত চাইতে ভুলে যায়, গণহত্যার জন্য ক্ষমা দাবি করার গুরুদায়িত্ব বিস্মৃত হয়। পরাধীন মানুষ ১৯৭৫ সালের নির্মম হত্যাকাণ্ডে অন্য সবার ভূমিকার কথা বলে, বলতে ভুলে যায় বিদেশি যড়যন্ত্রের কথা।
পরাধীন মানুষ স্বাধীনতার চেতনার কথা বলে। কিন্তু ব্যর্থ হয় নিজেকে স্বাধীন করতেই। দেশপ্রেমের কথা বলে। কিন্তু ব্যর্থ হয় দেশপ্রেমের মানে বুঝতে, নিজের দেশের মানুষের পাশে এসে দাঁড়াতে।

২.
পরাধীন মানুষ সবচেয়ে নির্মম ব্যর্থতা দেখায় দেশের মানুষের জীবন রক্ষার ক্ষেত্রে। এমনই এদের পরাধীন মন, দেশের সীমান্তে ভারতীয় বাহিনীর নির্বিচার হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ করতে পারে না এরা সজোরে। সীমান্তে দেশের মানুষ খুন হলে এরা বড়জোর দুঃখিত হয়। ইসরায়েল-পশ্চিম তীর সীমান্তে এখন খুন হলে প্রতিবাদে ফেটে পড়ে মানুষ। আমেরিকা-মেক্সিকোতে তা হলে আমেরিকাতেই ওঠে প্রতিবাদের ঢেউ। খুন হওয়া দেশের সরকার প্রতিবাদ করে, ক্ষোভ জানায়, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে প্রতিকার চায়। আমাদের পরাধীন কর্তারা অধিকাংশ সময় নির্বিকার থাকে, মাঝেমধ্যে কেবল দুঃখিত হয়। ছোট দেশ, কর্তাদের কিছু সীমাবদ্ধতা হয়তো রয়েছে। কিন্তু নাগরিক সমাজ! তার বৃহত্তর অংশও চেপে যেতে চায় এই বৈরিতা, পারলে সেদিনও অপ্রাসঙ্গিকভাবে স্মৃতিচারণা করে বন্ধুত্বের।
বিএসএফ বা ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর গুলিতে নিহত হচ্ছে সীমান্তের গ্রামগুলোর দরিদ্র ভারতীয় নাগরিকেরাও। এদের বিরুদ্ধে সোচ্চার রয়েছে বাংলার মানবাধিকার সুরক্ষা মঞ্চ, সংযোগ, এসডিটিসি, এসপিএমইউএম, বিএপিইউয়ের মতো অনেক ভারতীয় মানবাধিকার সংস্থা। বাংলাদেশের অধিকাংশ মানবাধিকার সংগঠনের ভ্রুক্ষেপ নেই এই মানবতাবিরোধী অপরাধের দিকে। কেউ কেউ হত্যাকাণ্ডের তালিকা করে পাঠায় সংবাদপত্রে। কোনো কোনো পত্রিকার ইচ্ছেই হয় না এই সংবাদ ছাপার!
সীমান্তে বিএসএফের হত্যাকাণ্ডের ওপর প্রামাণ্য রিপোর্ট করেছিলেন লন্ডনভিত্তিক চ্যানেল ফোরের জোনাথন রাগম্যান। এই রিপোর্ট করেন তিনি ২০০৯ সালের আগস্টে। পরম বন্ধু দুই সরকার তখন দুই দেশে। অথচ এরই মধ্যে আধা বছরে খুন হয়েছে ৬০ জনের বেশি বাংলাদেশি। রাগম্যানের বর্ণনা: ‘যে তিনটি গ্রামে আমরা গিয়েছি, স্থানীয় লোকেরা ভিড় জমিয়েছে তাদের মৃত স্বজনদের ছবি নিয়ে। ক্যামেরার সামনে বারবার বলতে চেয়েছে, কতজন কৃষক আর রাখাল মারা গেছে বিএসএফের গুলিতে।’
রাগম্যান ভারতীয় কাঁটাতারের বেড়ার ছবি তুলেছেন, বিএসএফ গার্ড পোস্টের উঁচু করা বন্দুক দেখিয়েছেন, গুলিবিদ্ধ মানুষের সঙ্গে কথা বলেছেন। আমাদের সাংবাদিকদের কাছেই ভিড়তে দেওয়া হবে না এসব রিপোর্ট করতে। কিন্তু আমাদের কলামিস্ট আছেন, আলোচক আছেন, টক শো আছে, সেখানে এর প্রতিবাদ হয় কালেভদ্রে। এমনকি সেখানেও বিস্ময়করভাবে বলে ওঠেন কেউ কেউ: অবৈধভাবে বাংলাদেশের মানুষ সীমান্ত পার হয় বলেই নাকি বিএসএফ গুলি করে!
অবৈধভাবে সীমান্ত পার হতে গেলে আর কোনো দেশের সীমান্তরক্ষীরা গুলি করে বিনা নোটিশে? ইসরায়েল-পশ্চিম তীর বাদে আর কোনো সীমান্তে গুলিবিদ্ধ হয় এত মানুষ? কোন দেশ বছরের পর বছর বিনা কিংবা ভুয়া প্রতিবাদে মেনে নেয় এমন করুণ মৃত্যু?
ভারত-পাকিস্তান নাকি ‘শত্রু’ দেশ। সেখানে বিএসএফ সীমান্ত পার হয়ে যাওয়া পাকিস্তানিদের গ্রেপ্তার করে, গুলি করে না। এই মাত্র দুই দিন আগে বিএসএফের ক্রোকোডাইল ইউনিট ভারতের জলসীমা থেকে গ্রেপ্তার করেছে পাকিস্তানি ছয় জেলেকে। গোলাগুলির ঘটনা সেখানেও ঘটে কখনো কখনো। কিন্তু পাকিস্তান-ভারত সীমান্তে অধিকাংশ সময় ঘটে গ্রেপ্তারের ঘটনা। আমরা কখনো গ্রেপ্তারের খবর পাই না, সতর্ক করে দেওয়ার জন্য ফাঁকা গুলির খবর পাই না, পাই শুধু বুকে কিংবা মাথায় গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর। খুন হয় মাঠে গরু চরাতে যাওয়া যুবক, বাবার আহার নিয়ে যাওয়া কিশোরী, ফসল দেখে ফিরে আসার পথে বৃদ্ধ। খুন হয় বৈরী সরকারের আমলের মানুষ, বন্ধু সরকারের আমলের মানুষ।
খুন হওয়া এই মানুষেরাও ছিল এ দেশের মানুষ। নির্বাচনে নিশ্চয়ই এরাও ভোট দিয়েছিল আওয়ামী লীগ আর বিএনপিকে। মহাশক্তিধর এই দুই দল ব্যস্ত থাকে পরস্পরকে ধ্বংস করার কাজে। সীমান্তে মানুষ খুন হলে বিএনপি ফাঁকা প্রতিবাদ করে। আওয়ামী লীগ কাকুতি-মিনতি করে। ‘বন্ধু’ রাষ্ট্রের গুলিতে মরতেই থাকে বাংলাদেশের মানুষ।
সারা পৃথিবীতে এমন বন্ধুত্বের নজির অন্য কোথাও আছে কি? আছে নজির বাংলাদেশের মতো এমন নতজানু পররাষ্ট্রনীতির?

৩.
সীমান্তে মানুষ মরলে বা সম্পদ বেহাত হলে আমরা কী করব? ভারত, আমেরিকা বা পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ করব? সেটি সম্ভব নয়, সংগতও নয়। কিন্তু সম্ভব জাতিগতভাবে ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদের। সম্ভব সংসদে সর্বসম্মতিক্রমে নিন্দা জানানোর, প্রতিকার দাবির। যৌথ নদীতে অন্য দেশ একতরফা বাঁধ দিলে, সমুদ্রসীমায় হানা দিলে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে বাগড়া দিলে আমরা কেন পারি না ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদ জানাতে? জাতীয় স্বার্থবিরোধী চুক্তি হলে আমাদের সংসদে কেন ওঠে না প্রতিবাদের ঢেউ? জাতীয় স্বার্থ বিপন্ন হলে আমাদের নাগরিক সমাজ কেন পারে না ঐক্যবদ্ধ অবস্থান নিতে?
অথচ আমাদেরই সবচেয়ে বেশি ঐক্যবদ্ধ থাকার কথা ছিল। আমাদের অধিকাংশ মানুষের জাতি, ভাষা ও ধর্ম এক। সংখ্যালঘু মানুষেরও নেই কোনো অসংগত দাবি। আমরাই একসঙ্গে ভাষা আন্দোলন, স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন আর স্বাধীনতা সংগ্রাম করেছি। এমন বর্ণাঢ্য ইতিহাস নেই ভারত, পাকিস্তান বা পৃথিবীর অধিকাংশ দেশেরই। তবু আমরা বিভক্ত এমনকি জাতীয় স্বার্থমূলক বিষয়েও।
শুধু কি সংকীর্ণ স্বার্থ বা নেতা-পূজাই রাখে আমাদের বিভক্ত করে? আমার তা মনে হয় না। এর আরেকটি কারণ আমাদের মানসিক পরাধীনতাও। আমাদের সমাজের সুবিধাভোগী মানুষের একটি বিরাট অংশকে বলা হয় ভারতের ‘দালাল’, আরেকটি বিরাট অংশকে পাকিস্তানের ‘দালাল’। এটা ঢালাও অভিযোগ, কিন্তু সকল ক্ষেত্রে ভিত্তিহীন নয়। প্রকাশ্যেই আমরা বহু হর্তাকর্তাকে দেখি নিজের দেশের কথা না বলে অন্য রাষ্ট্রের স্বার্থে কথা বলতে।
বন্ধুত্ব মানে মানসিক দাসত্ব নয়। বন্ধুত্ব মানে বিনা প্রতিবাদে কোনো অন্যায় মেনে নেওয়া নয়। বন্ধুত্ব মানে একসময়ের উপকারের কথা স্বরণ করে পরবর্তী সময়ের সকল সর্বনাশ মেনে নেওয়া নয়। আমরা অনেকেই জানি না তা। নাকি জানতে চাই না?
আমাদের পরাধীন মানসিকতা আর বিভক্তির কথা জানে প্রতিবেশী দেশ, দূরের সব দেশ। বাংলাদেশকে বিভিন্নভাবে বঞ্চিত করা সম্ভব হয় এ কারণেই।
আমাদের এই দীনতা ঘুচবে কবে?

৪.
আমার আরও কিছু বলার ছিল। সকালে উঠে প্রথম আলো পড়ে আর কিছু লেখার শক্তি হারিয়ে যায়। প্রথম আলো শেষ পাতায় ছাপিয়েছে দুই বছর নয় মাস বয়সী শিশু ধর্ষিত হওয়ার সংবাদ। মুখ চেপে এই অবোধ শিশুকে ধর্ষণ করেছে কেউ। কোনো মানুষ দেখলেই আঁতকে ওঠে এখন সে। এই লজ্জা কোথায় রাখি আমরা!
এই শিশুকে ক্ষতবিক্ষত করেছে মানুষ নামধারী এক পশু। কিংবা পশুর চেয়ে বর্বর কেউ। উন্মত্ত পশুও ধর্ষণ করে না তাদের গোত্রের বা অন্য কোনো শিশুকে। আমাদের সমাজের একজন করেছে। এই ‘মানুষ’কে খুঁজে বের করতে পারবে না পুলিশ? তাকে জামিন না দিয়ে মৃত্যুদণ্ড দিতে পারবেন না কোনো আদালত?
যদি না পারে, তাহলে সেই পশুর কাছে ধর্ষিত আসলে আমরা সবাই!
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

ব্যর্থ মন্ত্রীদের অপসারণ কেন জরুরি

বাংলাদেশের ইতিহাসে বিরল ঘটনা ঘটেছে সম্প্র্রতি। কয়েকজন মন্ত্রীর বিভিন্ন ব্যর্থতায় সমালোচনামুখর হয়েছেন সরকারি দলের সাংসদেরা। তাঁদের মধ্যে আওয়ামী লীগের কয়েকজন সিনিয়র নেতা রয়েছেন। চাইলে কেউ ভাবতে পারেন যে পদ না পেয়ে তাঁরা ক্ষুব্ধ হয়ে এসব বলেছেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এসব সমালোচনা তাঁরা আগে এত সরাসরি করেননি, এখন কেন করছেন? এর সহজ উত্তর হচ্ছে, সমালোচনা করার যথেষ্ট কারণ সৃষ্টি হয়েছে এখন।
সারা দেশে আরও বিভিন্ন মহল থেকে সরকারের কিছু মন্ত্রীর সমালোচনা করা হচ্ছে। তাঁদের অনেকে আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ সমর্থক হিসেবে পরিচিত। তাঁদের মধ্যে নাগরিক সমাজ ও পেশাজীবীরা রয়েছেন, যাঁরা আগে কখনো প্রকাশ্যে সরকারের সমালোচনা করেননি। রয়েছেন এমনকি মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানও, সরকারের কাছ থেকে ব্যক্তিগতভাবে যাঁর আর কিছু পাওয়ার প্রত্যাশা থাকার কথা নয়।
মাস ছয়েক আগে সংসদে সরকারি সাংসদদের ক্ষোভের প্রথম বড় ধরনের বহিঃপ্রকাশ দেখি আমরা। রাস্তাঘাট মেরামতে চরম ব্যর্থতার সমালোচনা করেছিলেন আওয়ামী লীগের কয়েকজন সিনিয়র নেতা। আমরা তখন দেখেছি, আওয়ামী লীগ ও মহাজোটের সাংসদেরা টেবিল চাপড়ে তাঁদের বক্তব্যকে সমর্থন করেছিলেন। কাজেই এটি শুধু পদবঞ্চিত ব্যক্তিদের ক্ষোভ ভাবার কোনো কারণ ছিল না। সাংসদদের সবাইকে কমবেশি নিজের এলাকায় যেতে হয়। তাঁদের প্রত্যেকেই সরেজমিনে ভোগান্তির চিত্র দেখেছিলেন বলেই হয়তো যোগাযোগমন্ত্রীর সমালোচনাকে এভাবে সমর্থন করেছিলেন। আমাদের প্রধানমন্ত্রী তারপরও যোগাযোগমন্ত্রীকে সমর্থন করেছিলেন, সমালোচনাকারীদের থামিয়ে দিয়েছিলেন। আমরা তখন যোগাযোগমন্ত্রীকে ডেকে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়ার কোনো নির্দেশ তাঁকে দিতে দেখিনি। এরপর সড়কের অবস্থা আরও ভয়ংকর হয়েছে, আরও বহু শিশু, নারীসহ বিভিন্ন মানুষ রাস্তায় প্রাণ হারিয়েছেন। প্রাণ হারিয়েছেন তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরের মতো দুই অমিত প্রতিভাধর মানুষ। সড়ক দুর্ঘটনার জন্য যৌক্তিক কারণে দায়ী করা হয়েছে যোগাযোগমন্ত্রীকে, ভুয়া লাইসেন্সের তদবিরকারী হিসেবে নৌপরিবহনমন্ত্রীকে। গত এক-দেড় বছরে বাণিজ্যমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কর্মকাণ্ডে এমনিতেই অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল অনেক মানুষ। এখন তারা দাবি করছে অযোগ্য মন্ত্রীদের অপসারণের। মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ‘অদক্ষ-অথর্ব মন্ত্রীদের বাদ দেওয়া হবে জনগণের জন্য প্রধানমন্ত্রীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ঈদ উপহার’ এই বক্তব্য দিয়েছেন। বিভিন্ন পত্রিকার অনলাইন জরিপে প্রায় শতভাগ মানুষ তাঁর বক্তব্যকে সমর্থন করেছেন।
আমার ধারণা, আমাদের প্রধানমন্ত্রী এই উপহার দিচ্ছেন না দেশের মানুষকে। সমালোচনাকারীদের সঙ্গে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির বিরাট পার্থক্য রয়েছে। তিনি বলেছেন, তাঁর সরকার দু-একটি ক্ষেত্র ছাড়া সব ক্ষেত্রে সফল। তিনি উল্টো সমালোচনাকারীদের সমালোচনা করে শত্রুদের হাতে অস্ত্র তুলে না দিতে বলেছেন। তাঁর বক্তব্যে এটি অনুমান করা যায়, ঈদের উপহার মানুষকে নয়, তিনি দিচ্ছেন অযোগ্য, অথর্ব, অকর্মণ্য মন্ত্রীদের। তাঁদের মন্ত্রিত্ব হয়তো অব্যাহত থাকবে। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে তাঁদের অনেকে নতুন উৎসাহ পাবেন। ব্যর্থ মন্ত্রীদের দাঁত বের করা হাসি, গরু-ছাগল তত্ত্ব, মানুষের দুর্ভোগের প্রতি নিষ্ঠুর ঔদাসীন্যও হয়তো অব্যাহত থাকবে।

২.
আমাদের সংবিধান অনুসারে সরকারের সব ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর হাতে কেন্দ্রীভূত। দলের ভেতরও গণতন্ত্র নেই বলে তিনি এককভাবে নির্ধারণ করেন কারা হবে তাঁর সরকারের মন্ত্রী। কানাঘুষা আছে যে বিভিন্ন আমলে প্রধানমন্ত্রীরা মন্ত্রী নির্বাচনে কখনো পরিবারের কারও কারও মতামত নেন, কখনো বিদেশি মহলের অনুরোধ বা নির্দেশ গ্রহণ করেন। মন্ত্রিত্ব নির্ধারণে উন্নত গণতন্ত্রে বড় ভূমিকা রাখে সততা, সংশ্লিষ্ট বিষয়ে জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা। আমাদের দেশে আরও বড় ভূমিকা রাখে প্রধানমন্ত্রীর প্রতি নিখাদ আনুগত্য। বর্তমান সরকারের মন্ত্রীরা ঠিক কীভাবে বা কোন যোগ্যতায় মন্ত্রী হয়েছেন, তা নির্দিষ্টভাবে বলা সম্ভব নয়। তবে এটি সম্ভবত ঠিক বাংলাদেশে কোনো মন্ত্রিসভাই গঠনকালে এভাবে চমকে দেয়নি মানুষকে। এই মন্ত্রিসভায় মতিয়া চৌধুরী, নুরুল ইসলাম নাহিদ, আবুল মাল আবদুল মুহিত, আব্দুর রাজ্জাক, এ কে খন্দকার, ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ প্রমুখ উজ্জ্বল ইমেজের ব্যক্তিরা ছিলেন ও আছেন। তাঁদের মধ্যে আবুল মাল আবদুল মুহিত ছাড়া আর কেউ বড় কোনো সমালোচনার মুখে কখনো পড়েননি, অনেকেই বরং প্রশংসিত হয়েছেন সর্বমহলে। কিন্তু বাকি অনেকের যোগ্যতা ও উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, যাঁদের নিয়োগের কোনো বোধগম্য ব্যাখ্যা তখনই খুঁজে পাওয়া যায়নি। সৈয়দ আবুল হোসেনের মতো প্রশ্নবিদ্ধ বা সাহারা খাতুনের মতো অনুল্লেখ্য ব্যক্তি কেন অতি গুরুত্বপূর্ণ দুটো মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেলেন, অজ্ঞাত রমেশ চন্দ্র কোন বিবেচনায় পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মতো অত্যন্ত ট্যাকনিক্যাল একটি মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হলেন, দীপু মনি কোন পারদর্শিতায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী হলেন তা নিয়ে তখনই প্রশ্ন উঠেছিল কোনো কোনো মহলে। তা ছাড়া ব্যবসায়ী ফারুক খানের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং শ্রমিকনেতা শাজাহান খানের নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব গ্রহণ স্বার্থসংঘাতের (কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট) কারণে নৈতিক নয়, এমন কথাও কেউ কেউ বলেছিলেন। গত দুই বছরে বিভিন্ন ব্যর্থতা, কর্মকাণ্ড ও বক্তব্য দ্বারা এই মন্ত্রীরাই সবচেয়ে বেশি সমালোচিত হয়েছেন। সরকারের অন্য অনেক ক্ষেত্রে সাফল্য এঁরাই ম্লান করে দিয়েছেন।
এঁদের সঙ্গে যোগ হয়েছেন একঝাঁক রাজনৈতিক সংস্রবহীন উপদেষ্টা। এঁদের কেউ ভারতের কাছে ট্রানজিটের জন্য মাশুল চাওয়া হবে অসভ্যতা—এ ধরনের দেশদ্রোহি বক্তব্য রেখেছেন, কেউ প্রকাশ্যে শুধু দলের ক্যাডারদের চাকরিতে নিয়োগ দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন, অনেকে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে অযাচিত হস্তক্ষেপ করে চলেছেন। তাঁদের অধিকাংশের কর্মকাণ্ডে নির্দিষ্টকৃত কোনো স্বচ্ছতা, দায়িত্বশীলতা ও জবাবদিহি নেই। গোপনীয়তার কোনো শপথ গ্রহণ না করে এঁরা গোপনীয়তার শপথ নেওয়া মন্ত্রীদের সভায় যেভাবে উপস্থিত থাকেন, তা অসাংবিধানিক, অনৈতিক, নজিরবিহীন এবং দেশের স্বার্থের জন্য বিপজ্জনক। গওহর রিজভীর মতো হাতেগোনা দু-একজন উপদেষ্টা বাদে বাকি সবার কর্মকাণ্ড নিয়ে বিভিন্ন সময় প্রশ্ন তুলেছেন এমনকি আওয়ামী লীগেরই কোনো কোনো সিনিয়র নেতা।
লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, সমালোচিত উপদেষ্টাদের কেউই সাংগঠনিকভাবে আওয়ামী লীগের জন্য মোটেও গুরুত্বপূর্ণ কেউ নন। সমালোচিত মন্ত্রীদেরও অধিকাংশ দলে বড়জোর দ্বিতীয় বা তৃতীয় সারির নেতা হিসেবে পরিচিত। এঁদের কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করলে বা কাউকে কাউকে মন্ত্রিসভা থেকে বাদ দিলে দল হিসেবে কোনো রকম ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা আওয়ামী লীগের নেই। বরং দলের সঙ্গে সংস্রবহীন মন্ত্রীদের বাদ দিলে দলে সত্যিকারের ত্যাগী নেতা-কর্মীদের মধ্যে বঞ্চনাবোধ দূর হতো, দলও শক্তিশালী হতো। সবচেয়ে বড় কথা, দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে এই বোধ তৈরি হতো যে তাঁদের উৎকণ্ঠা, ভোগান্তি ও ক্ষোভ বিবেচনায় নেওয়ার মতো নেতৃত্ব রয়েছে আওয়ামী লীগ ও সরকারের মধ্যে। তাঁদের জায়গায় উপযুক্ত ব্যক্তিদের মন্ত্রিসভায় নিয়ে এলে হয়তো সরকারের জনপ্রিয়তাও পুনরুজ্জীবিত হতো অনেকাংশে।
প্রশ্ন হচ্ছে, অব্যাহত সমালোচনার মুখে আমাদের প্রধানমন্ত্রী কেন তাহলে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছেন না ব্যর্থ মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে? তাঁর কথামতো শুধু দু-এক জায়গায় ব্যর্থতা থাকলে সেখানে অন্তত কোনো পরিবর্তন কেন আনছেন না তিনি? ঈদের আগেই তাঁকে এ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। হয়তো ঈদের পরে তিনি যোগাযোগমন্ত্রীর মতো দু-একজন প্রবল সমালোচিত মন্ত্রীকে সরিয়ে দিতে পারেন। যদি না দেন তাহলে অত্যন্ত উৎকণ্ঠিত হয়ে আমাদের এর রহস্য ও পরিণতি ভাবতে হবে।

৩.
মন্ত্রিসভায় রদবদল যেকোনো গণতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থায় স্বাভাবিক একটি বিষয়। সমালোচিত মন্ত্রীদের অপসারণ জনস্বার্থ, জনমত ও জনকল্যাণের প্রতি সরকারের মনোযোগ রয়েছে এই বার্তা পৌঁছে দেয়। এটি অন্য মন্ত্রীদের কাজে পারদর্শিতা, আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার তাগিদ সৃষ্টি করে। অতীতে মন্ত্রিসভার রদবদল শেখ হাসিনার প্রথম সরকারও করেছে। উপদেষ্টাদের সংখ্যা ও ক্ষমতা তখন সীমাবদ্ধ ছিল, এমনকি মন্ত্রিসভার বৈঠকে তাঁদের উপস্থিতি কখনো দেখা যায়নি তাঁর প্রথম আমলে।
এই আমলে কোনো কোনো মন্ত্রী আরও বেশি সমালোচনায় বিদ্ধ হলেও তাঁদের অপসারণের কোনো উদ্যোগ প্রধানমন্ত্রী এখনো নেননি। আশঙ্কা করার কারণ রয়েছে যে ব্যর্থ মন্ত্রীদের অপসারণ এবং অস্বচ্ছ ক্ষমতাধর উপদেষ্টাদের নিয়ন্ত্রণে অপারগ হলে তিনিই চূড়ান্ত বিচারে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। বাংলাদেশের মানুষ আবুল হোসেন বা সাহারা খাতুনকে দেখে আওয়ামী লীগকে ভোট দেয়নি। ভোট দিয়েছে শেখ হাসিনাকে দেখে। জনভোগান্তি চরমে উঠলে মানুষের সবচেয়ে বেশি অভিমান বা ক্ষোভ হয় নেত্রীর প্রতিই।
এসব কঠিন সত্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে তুলে ধরার মতো সৎ সাহস আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল নেতাদের আছে বলে মনে হচ্ছে না। দলের সাধারণ সম্পাদক ও প্রভাবশালী মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফ বরং গণমাধ্যমের সমালোচনাকে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে যড়যন্ত্র হিসেবে দেখছেন, এটি তাঁর জীবন বিপন্নকারী হিসেবেও বর্ণনা করেছেন। আমরা মনে করি, একজন সরকারপ্রধানকে বিপন্ন করতে পারে কেবল তাঁর সরকারের ব্যর্থতা, দুর্নীতি ও কুশাসন। পৃথিবীতে এমন নজির খুবই কম যে জনপ্রিয় ও দক্ষ একটি সরকারের পতন ঘটানো গেছে কোনো ষড়যন্ত্র করে। ষড়যন্ত্রের ক্ষেত্র তৈরিতে বরং ভূমিকা রাখে মন্ত্রী বা নিজ দলের প্রভাবশালী নেতাদের কুকীর্তি। বাংলাদেশে এর বহু নজির আছে।
আমরা এমন নজির আর চাই না। আমাদের প্রত্যাশা, মন্ত্রীরা বরং ব্যক্তি ও গোষ্ঠী স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে দেশের জন্য কাজ করে এবং মানুষের নিত্যনৈমিত্তিক সমস্যা সমাধান করে সব ষড়যন্ত্রের আশঙ্কা দূর করবেন। আমরা চাই, সুশাসন দিয়ে জনকল্যাণে কাজ করে এই সরকার সর্বোচ্চ সাফল্য অর্জন করুক। সরকার সফল হলে দেশ এগোয়, এর সুবিধা পায় প্রতিটি মানুষ।
আমরা জানি, বাংলাদেশের বহু মানুষ বিশ্বাস করে, একটি উন্নত, প্রগতিশীল এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র নির্মাণের সামর্থ্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রয়েছে। তাঁর সামর্থ্য কোনো মন্ত্রী, উপদেষ্টা এমনকি তাঁর নিজের কোনো ভুলের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হলে তা নিঃশঙ্কচিত্তে বলতে হবে। এটি বলার পরিবেশও বজায় রাখতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অতীতে সমালোচনার মুখে সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করেছেন। আমরা আশা করব, নিজের মন্ত্রিসভা নিয়ে পুনর্বিবেচনার গুরুত্বও তিনি আন্তরিক ও নির্মোহভাবে ভেবে দেখবেন।
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

আদালতের মর্যাদা কীভাবে রক্ষিত হবে

১৪ সেপ্টেম্বর একটি ছবি ছাপানো হয়েছে দৈনিক নয়া দিগন্ত পত্রিকায়। ছবিটি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে প্রধান বিচারপতি ও অন্য কয়েকজন বিচারপতির। প্রধানমন্ত্রীকে ঈদের শুভেচ্ছা জানাতে গত শনিবার তাঁরা গণভবনে গিয়েছিলেন। ছবিটির উৎস সরকারের একটি দপ্তর, প্রেস ইনফরমেশন ডিপার্টমেন্ট।
প্রধানমন্ত্রীকে তাঁর বাসভবনে গিয়ে প্রধান বিচারপতির শুভেচ্ছা জানানোর নজির আমার জানামতে আর নেই। এই ঘটনা সর্বোচ্চ আদালতের জন্য মর্যাদাহানিকরও মনে হতে পারে কারও কারও কাছে। সর্বোচ্চ আদালতে বিচারাধীন মামলাগুলোতে (বিশেষ করে সাংবিধানিক, ফৌজদারি, ট্যাক্স-সংক্রান্ত) সরকার একটি পক্ষ হিসেবে জড়িত থাকে। সরকার বলতে এখানে নির্বাহী বিভাগকেই বোঝানো হয়। সেই নির্বাহী বিভাগের প্রধান হচ্ছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে এ ধরনের সামাজিক মেলামেশা সে জন্য মানুষকে ভুল ইঙ্গিত দিতে পারে। সম্ভবত এই বিবেচনা থেকেই আমরা বিচারপতিদের কোনো সরকারপ্রধানের কাছে গিয়ে শুভেচ্ছা জানাতে আগে কখনো দেখিনি।
এর আগে কাছাকাছি একটি ঘটনা ঘটেছিল বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে। তখন তৎকালীন প্রধান বিচারপতি মাহমুদূল আমীন চৌধুরী প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে বিচারপতিদের কিছু সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়েছিলেন। তিনি বিনা কাজে সেখানে যাননি, অন্য বিচারপতিদের সঙ্গে করেও নিয়ে যাননি। তার পরও তখন এই ঘটনার জন্য বিভিন্ন মহল থেকে সমালোচনা করা হয়েছিল। বর্তমান প্রধান বিচারপতির সে ঘটনা ভুলে যাওয়ার কথা নয়। তাঁর সঙ্গে যেসব বিচারপতি গিয়েছেন তাঁদেরও নিকট-অতীতের এই ঘটনা ভুলে যাওয়ার কথা নয়। প্রধান বিচারপতি যদি তাঁদের বলেও থাকেন, তাহলেও সামাজিক কোনো অনুষ্ঠানে যাওয়ার বাধ্যবাধকতা তাঁদের ছিল না।
প্রধান বিচারপতির আচরণ নিয়ে অতীতেও প্রশ্ন উঠেছে। তিনি প্রধান বিচারপতি হওয়ার পর চট্টগ্রাম সমিতি, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় আইন সমিতি বা বাংলাদেশ আইন সমিতির মতো সংগঠনের অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন। বিচারপতিদের আচরণবিধির সঙ্গে এগুলো কতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ, তা নিয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশ্যে সংশয় প্রকাশ করা হয়েছে। তিনি তার পরও থামেননি। মাত্র মাসখানেক আগেই তিনি একটি লিটল ম্যাগাজিন আয়োজিত পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানে গিয়েছেন।
প্রধান বিচারপতিকে নিয়ে এসব প্রশ্ন উদ্রেককারী ঘটনা এমন এক সময়ে ঘটছে যখন আদালতের মর্যাদা রক্ষার দায়িত্ব উচ্চ আদালতই অন্যদের বিভিন্নভাবে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন। প্রধান বিচারপতি নিজেও এ ক্ষেত্রে কঠোর ভূমিকা নিচ্ছেন। তিনি এবং আপিল বিভাগের বিচারপতিরা আদালত অবমাননার দায়ে মাহমুদূর রহমানকে নজিরবিহীনভাবে দণ্ডিত করেছেন। উচ্চ আদালত আরও কিছু ক্ষেত্রে তাঁর মর্যাদা রক্ষার প্রশ্নে সাধারণ নাগরিকদের বিভিন্নভাবে তিরস্কৃত বা শাস্তিদান করেছে।
উচ্চ আদালতের মর্যাদা রক্ষা করা অবশ্যই সবার দায়িত্ব। কিন্তু চূড়ান্ত বিচারে এই মর্যাদা সবচেয়ে বেশি রক্ষিত হতে পারে বিচারপতিদের আচরণ ও কাজের মধ্য দিয়েই। বিচারপতিদের কেউ যদি এসব বিষয়ে দৃষ্টিযোগ্যভাবে সচেতন না থাকেন, আবার কেউ যদি আদালতের সম্মান রক্ষার কথা বলে সমালোচকদের নজিরবিহীন শাস্তি দেন, তাহলে তা সবার কাছে মানানসই মনে হবে না। আদালতের রায়ে কোনো রকম অসংগতি থাকলেও তা আদালতের মর্যাদা বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে না।

২.
আদালত অবমাননার দায়ে আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমান এবং এর একজন প্রতিবেদকের শাস্তি প্রদানের ঘটনা সাম্প্রতিক। এই রায় নিয়ে আইরিন খান, আতাউস সামাদ, মিজানুর রহমান খানসহ অনেকের লেখা ছাপা হয়েছে, বহু ব্লগে পাঠকেরা নানা মন্তব্য করেছেন। আমি খুব কম লেখা ও মন্তব্যে এই রায়ের প্রতি সমর্থন লক্ষ করেছি। আইনশাস্ত্রে একটি বহুল প্রচলিত নীতি হচ্ছে, ন্যায়বিচার শুধু করলেই হবে না, ন্যায়বিচার যে হয়েছে তা প্রতীয়মান হতে হবে। মাহমুদুর রহমানের রায়ের ক্ষেত্রে তা কোনো কোনো স্থানে প্রতীয়মান হয়নি। ন্যায়বিচারের অন্যতম শর্ত হচ্ছে, অন্তত একটি আপিল করার অধিকার প্রদান। খুনি, ধর্ষণকারী এমনকি যুদ্ধাপরাধীরা পর্যন্ত এই অধিকার বাংলাদেশ এবং অন্য সব দেশে পেয়ে থাকেন। এই অধিকার নিশ্চিত করার জন্য পৃথিবীর বহু দেশে আপিল বিভাগ বা সর্বোচ্চ বিচারিক প্রতিষ্ঠানকে নিজে নিজে বিচার করার ক্ষমতা (অর্থাৎ আদি এখতিয়ার) প্রদান করা হয়নি। আপিল বিভাগের আদি এখতিয়ার আছে, বাংলাদেশের সংবিধানেও তা বলা নেই। সংবিধান সুস্পষ্টভাবে আদি এখতিয়ার প্রদান করেছে হাইকোর্ট বিভাগকে, যাতে তার রায়ের ভুল-বিচ্যুতি উচ্চতর বিভাগ হিসেবে আপিল বিভাগ আপিল চলাকালে পরীক্ষা করে দেখতে পারেন। কিন্তু মাহমুদুর রহমানকে নজিরবিহীনভাবে বিচার করে শাস্তি প্রদান করেছে আপিল বিভাগ নিজে। এখন বাংলাদেশে তিনি এবং তাঁর প্রতিবেদকই হচ্ছেন সম্ভবত একমাত্র মানুষ, যাঁদের কোনো আপিলের অধিকার নেই। আমাদের সংবিধানে বর্ণিত আইনের দৃষ্টিতে সমতার নীতি এতে রক্ষিত হলো কি?
তাঁকে যে মেয়াদে শাস্তি দেওয়া হয়েছে, তার সঙ্গেও আপিল বিভাগের একজন কর্মরত বিচারক এবং সাবেক বিচারপতি গোলাম রাব্বানীসহ কেউ কেউ ভিন্নমত পোষণ করেছেন। আদালত অবমাননা আইন, ১৯২৬ অনুসারে আদালত অবমাননার সর্বোচ্চ শাস্তি হচ্ছে ছয় মাসের কারাদণ্ড এবং/অথবা দুই হাজার টাকা জরিমানা। আইনে এও বলা আছে যে অন্য কোনো আইনে যা কিছুই লেখা থাক না কেন, হাইকোর্ট এর চেয়ে বেশি কোনো শাস্তি দিতে পারবে না। আইনে এ কথা জোরের সঙ্গে বলার কারণ এই যে আগে আদালত অবমাননার শাস্তি নির্ধারণে বিচারকদের ক্ষমতা ছিল অবারিত এবং অতীতে এর বহু বিতর্কিত প্রয়োগ হয়েছে। আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি অনুসারে অপরাধের শাস্তি নির্ধারণ করে আইন প্রণয়নের ক্ষমতা কেবল সংসদের। আমাদের সংবিধানে সুপ্রিম কোর্টকে এবং আপিল বিভাগের বিধিমালায় আপিল বিভাগকে আইনসাপেক্ষে বা আইন অনুসারে আদালত অবমাননার শাস্তি প্রদানের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। আদালত অবমাননার জন্য আপিল বিভাগ সর্বোচ্চ কত শাস্তি দিতে পারবে, এটি নির্ধারণ করে কোনো আইন আজ পর্যন্ত প্রণীত হয়নি। আপিল বিভাগ এ ক্ষেত্রে অন্তত ১৯২৬ সালের আইনের সীমারেখার মধ্যে থাকতে পারতেন। তাঁরা যে মাহমুদুর রহমানকে অতিরিক্ত শাস্তি দিলেন, তা একটি খারাপ নজির হয়ে থাকবে। কারণ এর তাত্ত্বিক মানে হচ্ছে, ভবিষ্যতে উল্লিখিত আইন না হওয়া পর্যন্ত যেকোনো মেয়াদে শাস্তি দেওয়ার ক্ষমতা আপিল বিভাগ নিজে নিজেকে প্রদান করেছেন। এই ক্ষমতা বিশেষ করে অনির্বাচিত সরকারের আমলে বিভিন্ন মহল কর্তৃক অপব্যবহারের চেষ্টা করা হতে পারে।
১৯২৬ সালের আইনের নির্দিষ্ট দণ্ডের বিষয়টি অনুসরণ না করলেও এই আইন থেকে উদ্ভূত যে সেকেলে দৃষ্টিভঙ্গি সেটা কিন্তু ঠিকই অনুসরণ করেছেন আপিল বিভাগ। তাঁরা আদালত সম্পর্কে মাহমুদুর রহমানের অবমাননাকর মন্তব্যগুলো সত্য ছিল কি না, তা পরীক্ষা করে দেখেননি। পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে সত্যপ্রকাশকে আদালত অবমাননা হিসেবে গণ্য করা হয় না। ভারতে ২০০৬ সালের আইনে সত্যপ্রকাশকে আদালত অবমাননার দায় থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। পাকিস্তানের আইনে বিদ্বেষপ্রসূত কোনো উদ্দেশ্য না থাকলে এমনকি বিকৃত তথ্য প্রকাশ করলেও তা আদালত অবমাননা হবে না। আমাদের দেশেও অতীতে সত্যপ্রকাশের জন্য আদালত অবমাননা হয়নি, এ ধরনের নজির আছে (যেমন মানবজমিন মামলা)। সত্য প্রকাশ করা হয়েছিল বলেই অতীতে আমরা দুর্নীতিপরায়ণ বা মিথ্যে সার্টিফিকেট প্রদানকারী বিচারপতিকে হাইকোর্ট ত্যাগ করতে বাধ্য হতে দেখেছি। এখন আপিল বিভাগের রায়ের ভিত্তিতে ভবিষ্যতে যদি এ ধরনের কোনো বিচারপতি আদালত অবমাননার দণ্ড দিয়ে দেন, তা কি শুভকর হবে?
আদালত অবমাননা আইনের মূল লক্ষ্য হচ্ছে, আদালত নামক মহান প্রতিষ্ঠানের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধাবোধ রক্ষা করা। এর উদ্দেশ্য সমালোচকদের ঢালাওভাবে ভীতসন্ত্রস্ত করা নয়। ঔপনিবেশিক আমলে ১৯২৬ সালের আইনটি খুব সৎ উদ্দেশ্যে করা হয়নি। উচ্চ আদালত বহু ক্ষেত্রে, বিশেষ করে জনস্বার্থ মামলায় আইন ও সংবিধানের প্রগতিশীল ব্যাখ্যা দান করে প্রশংসিত হয়েছেন। মাহমুদুর রহমানের মামলায় ১৯২৬ সালের আইনটির প্রগতিশীল ব্যাখ্যা করার সুযোগ উচ্চ আদালতের ছিল। তাঁরা তা করলেই বরং উচ্চ আদালতের মর্যাদা আরও বৃদ্ধি পেত।

৩.
উচ্চ আদালতের মর্যাদা বিশেষভাবে সম্পর্কিত সংবিধানসংক্রান্ত রায়গুলোর সঙ্গে। এসব রায়ে রাজনৈতিক ইতিহাসের আইনগত পর্যালোচনার সুযোগ থাকে। বাংলাদেশের মতো তীব্রভাবে বিভাজিত একটি রাজনৈতিক সমাজে সেই রায় তাই পড়া হয় নানা প্রত্যাশা এবং একই সঙ্গে সন্দেহ নিয়ে।
সম্প্রতি উচ্চ আদালত পঞ্চম ও সপ্তম সংশোধনী-সংক্রান্ত রায় দিয়েছেন। আমার বিশ্বাস, এসব রায় জনমনে প্রবল আগ্রহের সৃষ্টি করেছে। এসব রায়ে প্রত্যাশিতভাবেই সামরিক শাসনকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে বলে বহু বিশ্লেষক প্রশংসা করেছেন। কিন্তু তাই বলে রায়গুলো বিতর্কমুক্ত থাকেনি। যেমন: পঞ্চম সংশোধনী মামলার রায়ে বঙ্গবন্ধুর আমলে কৃত চতুর্থ সংশোধনীর সঙ্গে সাংঘর্ষিক ক্ষেত্রগুলোতে পঞ্চম সংশোধনীর বিধানগুলো বহাল রাখা হয়েছে। কেন একটি বৈধ সংশোধনীর (চতুর্থ) তুলনায় অবৈধ সংশোধনী (পঞ্চম) প্রাধান্য পেল, তার সম্পূর্ণ ব্যাখ্যা করতে হলে চতুর্থ সংশোধনীর অগণতান্ত্রিক দিকগুলো আলোচনা করা প্রয়োজন ছিল। রায়ে তা অনেকাংশে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। আবার একই রায়ে বঙ্গবন্ধু সরকারের আমলে কৃত সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদের পরিবর্তনকে মাইনর চেঞ্জেস (ছোটখাটো পরিবর্তন) হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। অথচ এই পরিবর্তনের মাধ্যমেই সংবিধানে মৌলিক অধিকার-পরিপন্থী বিধান সংযোজনের পথ সুগম হয়েছে।
সপ্তম সংশোধনী মামলার পূর্ণাঙ্গ রায় আমরা পাইনি এখনো। তবে এই রায়ের সংক্ষিপ্ত আদেশে কেবল ১৯৮২ থেকে ১৯৮৬ পর্যন্ত এরশাদের শাসনকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে। এর মানে হচ্ছে, বাকি সময়ে তাঁর শাসনামল বৈধ ছিল। এরশাদ এখন বলার সুযোগ পাবেন যে ১৯৮৭ ও ১৯৯০ সালের গণ-অভ্যুত্থান ছিল একটি বৈধ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন (নাকি যড়যন্ত্র?)। তিন জোটের যে দলিলে এরশাদকে অবৈধ শাসক বলা হয়েছে, সেই দলিলও কি তাহলে এখন অবৈধ বা মানহানিকর হয়ে গেল না? জয়নাল, দীপালি সাহা, সেলিম, দেলোয়ার, বসুনিয়া, নূর হোসেন তাহলে রক্ত দিয়েছিলেন একজন বৈধ শাসককে উৎখাত করতে গিয়ে? হাইকোর্টের আদেশের এমন অপব্যাখ্যা করার সুযোগ কি আদেশের মধ্যেই রয়ে গেল না? পূর্ণাঙ্গ রায়ে এর কোনো সন্তোষজনক ব্যাখ্যা না থাকলে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের জন্য তা শুভকর হবে না।

৪.
বাংলাদেশের মতো দুর্বল গণতান্ত্রিক দেশে মানুষের শেষ ভরসার স্থল হচ্ছে আদালত। এখানে নির্বাহী বিভাগের আচরণ লুটেরা ও অত্যাচারীর মতো। সংসদ থাকে নির্বাহী বিভাগের তল্পিবাহক হয়ে। দুর্নীতি দমন কমিশন, তথ্য কমিশন বা মানবাধিকার কমিশন কাজ করে বা বসে থাকে সরকারের ডিকটেশনে। সরকারকে জবাবদিহির মধ্যে রাখার ভূমিকা অপর্যাপ্তভাবে হলেও পালন করে কেবল গণমাধ্যম বা উচ্চ আদালত। এই দুটো প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা, স্বাতন্ত্র্য ও নিরপেক্ষতা নিয়ে তাই সচেতন নাগরিক সমাজ সব সময়ই উচ্চকিত। তবে তাঁদের কারও কারও মন্তব্য বা আচরণে বাড়াবাড়ি থাকে না, তা নয়। কিন্তু আদালত অতীতে অধিকাংশ সময়ে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে তা দেখেছেন। অন্যদিকে, আদালতের স্বাধীনতা ও ক্ষমতায়নের প্রতিও মানুষ অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়েছে।
শাসক বনাম শোষিতের স্বার্থের দ্বন্দ্বে আইনগত পরিসীমার মধ্যে থেকে আদালত যখনই শোষিতের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন, তাঁর মর্যাদা তখনই বেড়েছে। আইনের শাসন, মানবাধিকার আর সংবিধানকে রক্ষা করতে গিয়ে উচ্চ আদালত যত বেশি বিদ্যমান সরকারের প্রতিপক্ষ হয়েছে, তাঁর সম্মান ততই প্রসারিত হয়েছে।
আমরা আদালতের এমন ভূমিকা প্রত্যাশা করি। আমরা এও মনে করি, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, মিথ্যা ও অবমাননাকর আক্রমণ থেকে আদালতকে অবশ্যই মুক্ত রাখতে হবে। একটি যুগোপযোগী ও সুস্পষ্ট আদালত অবমাননা আইন, বিচারপতিদের আচরণবিধি তদারকিতে উচ্চ আদালত কর্তৃক বিধি প্রণয়ন করে সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি নির্ধারণ, বিচারকদের নিয়োগপদ্ধতি উন্নতকরণ, ১৯৭২ সালের সংবিধানের আলোকে তাঁদের অবসর-পরবর্তী নিয়োগ নিষিদ্ধকরণ এবং তাঁদের চাকরিকালীন সুযোগ-সুবিধা আরও বৃদ্ধির মাধ্যমে এগুলো করা সম্ভব। উচ্চ আদালত কিছু বিষয়ে নিজেই বিভিন্নভাবে উদ্যোগী ভূমিকা নিতে পারেন।
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

তাহারা’ সাধু, আমরাই শয়তান

নতুন একটি টিভি চ্যানেল চব্বিশ ঘণ্টা খবর প্রচার করছে। সেখানে গোপন ক্যামেরায় পুলিশের ঘুষ গ্রহণের ছবি দেখানো হচ্ছে। এমন ছবি আমরা পত্রিকায়ও দেখছি বহু আগে থেকে। এরা ছিঁচকে ধরনের চোর, এমন চোর অবশ্যই আছে বাংলাদেশে। তবে দেশের হর্তাকর্তাদের কেউই এমন নন। তাঁরা ছিঁচকেও না, সিঁধেল চোরও না। তাঁরা নিষ্কলুষ। তাঁদের কাউকে হাতেনাতে ধরা হয় না টিভিতে-পত্রিকায়। ধরা সম্ভব না। কারণ তাঁরা সাধুপুরুষ। স্বয়ং উচ্চ আদালতেও তা প্রমাণ হয়েছে, হচ্ছে।
মাঝখানে ঝামেলা শুরু করেছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার। ধুমধাড়াক্কা আয়োজনের মধ্য দিয়ে সাধুদের বিরুদ্ধে মামলা করা হলো সেই সরকারের আমলে! ভয়াবহ সব তথ্য উদ্ঘাটিত হলো, অকাট্য সব প্রমাণ দাখিল করা হলো। আসলে এ সবই ছিল যড়যন্ত্র! দেশে গণতন্ত্রের জোয়ার বওয়ামাত্র এই যড়যন্ত্র খড়কুটোর মতো ভেসে গেল। গণতান্ত্রিক সরকারের আমলে গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সম্মান ফিরে এল, তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহার হলো। তাঁরা সরকারের লোক। সরকারের লোক দুর্নীতি করেন না বাংলাদেশে, দুর্নীতি করে বিরোধী দল! কাজেই তাঁদের মামলা তো প্রত্যাহার হবেই! এর মধ্যে দোষের কিছু নেই। থাকলে গোটা দেশ চুপ করে থাকত না এ ঘটনায়!
মামলা প্রত্যাহার হয়নি বিরোধী দলের। সরকারের দু-একজন বিচারিক আদালতে সাজাপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। তাই তাঁদেরও মামলা প্রত্যাহার করা যায়নি। আসলে তাঁরাও ছিলেন সাধুপুরুষ। উচ্চ আদালতে তাঁদের সাজা মাফ হয়েছে, হচ্ছে। এমনকি বিরোধী দলের যেসব মহাপুরুষের দুর্নীতির খবরে ঢি-ঢি পড়ে গিয়েছিল সারা দেশে, তাঁদের সাজাও একে একে বাতিল হচ্ছে উচ্চ আদালতে।
উচ্চ আদালতের দোষ নেই। দুর্নীতি প্রমাণ করার দায়িত্ব আদালতের নয়। এই দায়িত্ব সরকারি আইনজীবীদের। তাঁদেরও দোষ নেই। মামলা ঠিকমতো দায়ের না হলে, দুর্নীতির প্রমাণ না থাকলে তাঁরা কী করবেন? দোষ যে তদন্তকারীদের তাও নয়। আইনে যেভাবে আছে, নির্দেশ যেভাবে ছিল, তাঁরা সেভাবেই মামলা করেছিলেন। আইন যাঁরা বানিয়েছিলেন, নির্দেশ যাঁদের ছিল, তাহলে কি তাঁদের দোষ? তাই বা বলি কী করে! তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সেই অগ্নিপুরুষদের সততা আর যোগ্যতা প্রশ্নাতীত। দুই সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে তাঁরা হিড়হিড় করে টেনে নিয়েছেন আদালতে, নির্জনবাস করিয়েছেন মাসের পর মাস, এমনকি খাবারে বিষ মিশিয়ে মেরে ফেলার চেষ্টাও নাকি করেছেন! পর্বতসম সততা আর নৈতিক মনোবল ছিল বলেই না এসব অভিযোগে কেশাগ্র স্পর্শ করা হয়নি তাঁদের!
দোষ তাঁদের কারও নেই, ছিলও না। কারণ বাংলাদেশে ছিঁচকে চোর আছে, বড় দুর্নীতিবাজ কেউ নেই। ছিঁচকে চোরদের দিয়ে দেশের দুর্নীতির পরিমাপ হয় না। কাজেই যারা বাংলাদেশকে এত দিন দুর্নীতিতে প্রথম করেছে তারা ছিল যড়যন্ত্রকারী! বাংলাদেশে বড় সব যড়যন্ত্রে বিদেশিদের হাত থাকে। এখানেও নিশ্চয়ই ছিল। এমনও হতে পারে যে, যড়যন্ত্রকারীরা ছিল ভারতের দালাল, না হলে পাকিস্তানের দালাল!
২.
কালো টাকা আর পেশিশক্তিমুক্ত নির্বাচনের কথা বলত ষড়যন্ত্রকারীরা। নেতারা কেউই যে কালো টাকার মালিক না তা তো প্রমাণিত হচ্ছেই। তাঁরা এমনকি সন্ত্রাসীও না। এসব কথা গণতন্ত্র না থাকলে বোঝা যায় না। গত গণতন্ত্রের আমলে আমরা দেখেছি, ২১ আগস্টের ঘটনায় কেউ দায়ী ছিল না। দায়ী ছিল শুধু বিদেশি শক্তি। স্বয়ং উচ্চ আদালতের একজন বিচারক তদন্ত করে তাই জানিয়েছিলেন। স্বজাতিদের সম্মান রক্ষায় জানপ্রাণ এই বিচারপতির মূল্যায়ন হয়নি দেশে। এক/এগারো না হলে হয়তো তিনি সম্মানিত হতেন, প্রধান বিচারপতিও নাকি হওয়ার কথা ছিল তাঁর। অথচ নতুন গণতন্ত্রের যুগে তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির তদন্ত হচ্ছে। তবে আমরা নিশ্চিত থাকতে পারি, তাঁরও শেষরক্ষা হবে। এ দেশে বড় মানুষেরা দুর্নীতি করে না।
দুর্নীতি করে ট্রাফিক সার্জেন্ট বা কেরানির মতো ছোট মানুষেরা। সন্ত্রাস করে জজ মিয়ারা। নতুন গণতন্ত্রের আমলেও তার কত প্রমাণ দেখছি আমরা! এই তো সেদিন এমপির গাড়িতে নাকি গুলিবিদ্ধ হয়েছেন ইব্রাহিম মিয়া। পুলিশ সঙ্গে সঙ্গেই বুঝতে পেরেছে, দোষ আসলে ইব্রাহিমেরই। এমপিরা দার্শনিক প্রজাতির মানুষ, লাইসেন্স করা অস্ত্র যেখানে-সেখানে ফেলে যেতেই পারেন। সেই অস্ত্র নিয়ে তুই ব্যাটা নাড়াচড়া করে মরলে এমপির কী দোষ! দোষ হলে হবে বড়জোর এমপির গাড়িচালক আর চামচাদের। তারা সাধারণ মানুষ। সাধারণ মানুষেরা খুব খারাপ এ দেশে। পুলিশ তাই এদের গ্রেপ্তার করেছে, এমপিকে নয়।
ইব্রাহিমের বউ এখন আবোল-তাবোল বললেও এমপির কিছু হবে না! এমপিরা এ দেশে কখনো কোনো হত্যাকাণ্ড ঘটাননি। আজ পর্যন্ত কোনো আদালত তার প্রমাণ দিতে পারবেন না। যত দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী হোন না কেন, এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর তাঁরা যাদুবলে সাধুপুরুষ হয়ে যান। এখন যদি কেউ প্রশ্ন তোলে, পিস্তলে এমপির হাতের ছাপ ছিল কি না, বুঝতে হবে, সেও যড়যন্ত্রকারী। কিংবা যুদ্ধাপরাধীর দোসর!
এমপিরা মাঝেমধ্যে চড়-থাপড় দেন বটে, ওসি-ডিসি, কন্ট্রাক্টর-ব্যবসায়ী এমনকি শিক্ষকদের গায়েও হাত তোলেন তাঁরা মাঝে মধ্যে। কিন্তু বুঝতে হবে, এটি দেশের ভালোর জন্যই। এমপিদের সঙ্গে বেয়াদবি করে, তাদের কোনো নির্দেশ না মেনে দেশের উন্নতি হবে কী করে! কারা খুনি, কোন মামলা নিতে হবে, কোন ব্যবসায়ী কাজ পাবে, প্রশাসন কীভাবে চালাতে হয় তা এমপিদের চেয়ে ভালো কেউ বোঝে নাকি? যদি বুঝত তাহলে তারাই তো এমপি হতো! ঠিক কি না? তো এসব যারা বুঝবে না তারা যে সামান্য চড়-থাপড়ে পার পাচ্ছে এটাও তো অনেক!
এমপিরা মহাজ্ঞানীও। সরকারি দলের এমপিরা আরও জ্ঞানী। তাঁরা আইনবেত্তার চেয়ে ভালো আইন বোঝেন, চিকিত্সকের চেয়ে বেশি চিকিৎসা বোঝেন, ইতিহাসবিদদের চেয়ে বেশি ইতিহাস বোঝেন, আমলাদের চেয়ে বেশি প্রশাসন বোঝেন। তাঁরা সর্বজ্ঞানী! তবে তাঁদের চেয়ে বড় জ্ঞানী কেউ নেই তা নয়। প্রধানমন্ত্রী আছেন। বিরোধী দলের এমপিদের জন্য বিরোধী দলের নেত্রী আছেন। তাঁদের কোনো কথার সামান্য নড়চড় করেন না তাই এমপিরা! আমরা সাধারণ মানুষ, আমাদের কথা শোনার মতো বোকা নন তাঁরা।
এমপি-মন্ত্রী-হর্তাকর্তারা সব গুণে গুণী। সব দোষের ঊর্ধ্বে তাঁরা। এমন পোড়া দেশে এই অসামান্য সত্য বুঝতে না পারলে দোষ আমাদেরই।

৩.
আমরা সাধারণ মানুষ। আমাদের আরও দোষ আছে। সামান্য ট্রাফিক জ্যামে দুই-তিন ঘণ্টা দেরি হলে আমরা অধৈর্য হয়ে উঠি। মানুষে মানুষে কিলবিল করা আমাদের দেশ! যারা রাস্তাঘাট-গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানি কিছুই পাচ্ছে না তারা তো কোনো চেঁচামেচি করে না? সুবোধ বালকের মতো তারা অন্ধকারে রাত কাটায়, ‘বায়োগ্যাসে’ রান্না করে, পচা পানি খেয়ে হজম করে। তারা ভোটের দিন ভোট দেয়, দলবেঁধে জনসভায় যায়, মনের সুখে প্রজননচর্চা করে, অসুখ হলে শান্তভাবে ইন্তেকাল করে।
সমস্যা আমাদের শহরের সাধারণ মানুষদের। আমরা গ্রামের মানুষের মতো সুনাগরিক হতে পারি না, রথী-মহারথীদের মতো সুশীলও হতে পারি না। ট্রাফিক জ্যামে ল্যাপটপ খুলে গাড়িতে অফিস করার যোগ্যতা নেই আমাদের। জেনারেটর কিনে বিদ্যুৎ সমস্যা দূর করার সামর্থ্য নেই, গ্যাস যায় না এমন জায়গায় থাকার ক্ষমতা নেই, দ্রব্যমূল্য বাড়লে বেশি দামে দ্রব্য কেনার বুদ্ধি নেই। শহরে ভিড় বাড়লে প্যারিস-লন্ডন এমনকি ব্যাংককে যাওয়ার মুরোদ নেই! আমাদের সব চাওয়া কেবল সরকারের কাছে। সেখানে একটা হেরফের হলে আমরা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠি, ভাঙচুর শুরু করে দিই। আরে, দ্রব্যমূল্য-বিদ্যুৎ-গ্যাসের সমস্যা তো আগের সরকারের তৈরি! আগের সরকারের আমলেরটা তার আগের সরকারের তৈরি। এই সামান্য সত্যটা বুঝতে পারি না আমরা। রেগে গিয়ে একবার একে আরেকবার ওকে ক্ষমতায় বসাই আমরা। কারও ভিশন-মিশন বোঝার ধৈর্য পর্যন্ত নেই আমাদের।
আমাদের সবচেয়ে বড় অযোগ্যতা বোঝার ক্ষেত্রে। আমরা বুঝতে চাই না গ্যাস-বিদ্যুৎ-দ্রব্যমূল্য কিংবা কোমলমতিদের খুনোখুনি নিয়ে সরকারকে পড়ে থাকলে চলে না। বাঙালি জাতিকে উদ্ধারে কার কী অবদান, কোন চেতনা কীভাবে পুনরুদ্ধার করা যায়, কোন দেশের দালালদের কীভাবে ঠেকানো যায়, দেশ রক্ষার্থে কাকে হামলা, কার বিরুদ্ধে মামলা করা যায়, এ ধরনের কত উঁচুমার্গীয় চিন্তায় দিন কাটে আমাদের রথী-মহারথীদের! আমরা ছাপোষা মানুষ। এসব না বুঝে খামাখাই সরকারের ওপর রুষ্ট হই আমরা।
আমরা খানিকটা ইতর প্রজাতিরও। আমাদের উদ্ধারের চিন্তায় সারা শহর নিশ্চল করে দিয়ে দামি গাড়িবহরে ছুটে বেড়ান হর্তা-কর্তা মহাজনেরা। তবু কেন রাগে মাথা খারাপ হয় আমাদের, মনের মুখে ফোটে অশ্রাব্য শব্দাবলি?
আমাদের আসলে বুঝতে হবে, তারা সাধু, আমরাই শয়তান।
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

আওয়ামী লীগ বনাম বিএনপি

গত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও তার সমর্থক দলগুলো ভোট পেয়েছিল প্রায় ৬০ শতাংশ। দল হিসেবে আওয়ামী লীগ সফল হলে এখনো অন্তত এই সংখ্যার মানুষের তাদের পক্ষে থাকার কথা। প্রথম আলোর ২০১০ সালে জরিপে তা দেখা যায়নি।
আওয়ামী লীগকে গত বছর সবচেয়ে কালিমালিপ্ত করেছে ছাত্রলীগ ও কিছু ক্ষেত্রে যুবলীগের কর্মকাণ্ড। বিরোধী দল শুধু নয়, সরকারি কর্মকর্তা ও সাধারণ মানুষও এদের সন্ত্রাসের শিকার হয়েছে এ সময়। প্রথম আলোর জরিপে ২০০৯ সালে ১১ শতাংশ মানুষ বলেছিলেন তাঁরা ছাত্রলীগ ও যুবলীগের কর্মকাণ্ডে একেবারেই সন্তুষ্ট নন। ২০১০ সালের জরিপে ২৬ শতাংশ মানুষ অর্থাৎ প্রায় আড়াই গুণ বেশি মানুষ তাঁদের তীব্র অসন্তোষের কথা জানিয়েছেন। ২৯ শতাংশ (আগের বছর ১৮ শতাংশ) জানিয়েছেন, তাঁরা তেমন সন্তুষ্ট নন। তার মানে পুরোপুরি ও অনেকাংশে অসন্তুষ্ট মানুষের মোট সংখ্যা ৫৫ শতাংশ।
এ দেশে অঙ্গসংগঠনের কোনো স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নেই, তাদের কর্মকাণ্ডের দায় তাই কিছুটা হলেও মূল দলের ওপর এসে পড়ার কথা। প্রথম আলোর জরিপে অবশ্য তা সামান্যই প্রমাণিত হয়েছে। প্রথম আলো প্রশ্ন করেছিল আওয়ামী লীগ কি তার কর্মীদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে? ৪৫ শতাংশ (আগের বছর ৪৭ শতাংশ) বলছেন পেরেছে, ৫৩ শতাংশ (আগের বছর ৫২ শতাংশ) বলেছেন পারেনি। প্রশ্নটি যদি এমন হতো যে ছাত্রলীগ-যুবলীগকে আওয়ামী লীগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে কি না, তাহলে নেতিবাচক ভোটের সংখ্যা বাড়ত বলে আমার ধারণা।
গত বছর মানুষের হতাশার একটি বড় কারণ ছিল রাজনৈতিক সংস্কৃতির দৈন্যদশা। আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা এবং বর্তমান নেতাদের সম্পর্কে অশোভন, কখনো কখনো অশ্লীল কথাবার্তা বলেছেন। বিরোধী দলের কর্মসূচি নস্যাৎ করার জন্য শুধু সরকারের বাহিনীগুলো নয়, আওয়ামী লীগ তার দলগত দাপটও ব্যবহার করেছে। বিরোধী দলের প্রতি মামলা, হামলা ও হুমকির ঘটনা গত বছরের তুলনায় বেড়েছে। অন্যদিকে বিরোধী দলও বেশি আক্রমণাত্মক হয়েছে, কখনো আওয়ামী লীগের নেতাদের সম্পর্কে অশোভন উক্তি করেছে, অধিকাংশ সময়ে সংসদ বর্জন করেছে। জরিপে এর কিছুটা প্রতিফলন রয়েছে। ২০০৯ সালে ৫৯ শতাংশ মানুষ রাজনীতিতে ভালো পরিবর্তন লক্ষ করেছিলেন, এবার সেই সংখ্যা নেমে এসেছে ৪৭ শতাংশে। আগের বছর ৫৯ শতাংশ মানুষ মনে করতেন হরতাল, সহিংসতা ইত্যাদি রাজনৈতিক অসুখ ফিরে আসবে না দেশে। এখন তা মনে করেন ৫৩ শতাংশ মানুষ। অর্থাৎ খুব তীব্রভাবে না হলেও মানুষের মধ্যে হতাশা বেড়েছে।
জরিপের ফলাফলে আওয়ামী লীগের জন্য যা গভীরতর সতর্কবার্তা, তা হচ্ছে ভোটার হিসেবে মানুষের মনোভাব। এখন নির্বাচন হলে আপনি কোন দলকে ভোট দেবেন? এই প্রশ্নের উত্তরে গত বছর জরিপে অংশ নেওয়া ৫৬ শতাংশ মানুষ বলেছিলেন, তাঁরা আওয়ামী লীগকে ভোট দেবেন, এবার তা ১০ শতাংশ কমে ৪৬ শতাংশে নেমে এসেছে। ঢাকায় এই জনপ্রিয়তা কমেছে ১৬ শতাংশ, চট্টগ্রামে ইতিমধ্যে বিএনপি আওয়ামী লীগের চেয়ে সামান্য হলেও বেশি জনপ্রিয় দল। গোটা দেশের হিসাবে, গত বছর বিএনপির প্রতি সমর্থন জানিয়েছিলেন ২৫ শতাংশ মানুষ, এবার তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৯ শতাংশে। জরিপের ফল অনুসারে সামগ্রিকভাবে আওয়ামী লীগ এখনো বিএনপির চেয়ে ৭ শতাংশ বেশি জনপ্রিয়। তবে এক বছরে ১০ শতাংশ জনপ্রিয়তা কমে যাওয়ার গতি মোটামুটিভাবে অব্যাহত থাকলে আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ সুখকর হবে না, দলটির মধ্যে এখনই এই ভাবনা আসা উচিত।
বিএনপির প্রতি মানুষের সমর্থন বেড়েছে। তবে এই বৃদ্ধি যত না বিএনপি নিজে অর্জন করেছে, তারচেয়ে বেশি আওয়ামী লীগের ব্যর্থতার কারণে হয়েছে। আমরা এটিকে বলি নেতিবাচক ভোট। এর প্রমাণ জরিপে রয়েছে। যেমন: ৮৩ শতাংশ (আগের বছর ৮৮ শতাংশ) মানুষ মনে করেন বিএনপির সংসদ বর্জন ঠিক হয়নি, ৬০ শতাংশ (আগের বছর ৫০ শতাংশ) মানুষ মনে করেন বিএনপি সংসদের বাইরে কার্যকর কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি, মাত্র ২৪ শতাংশ (আগের বছর ৩০ শতাংশ) মানুষের ধারণা, বিএনপি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে ভালো ভূমিকা রেখেছে। এ বছর বিএনপির ভূমিকার প্রতি মানুষের নেতিবাচক মনোভাব বাড়লেও তাদের প্রতি সমর্থন বাড়ার একটিই কারণ হতে পারে; তা হচ্ছে সরকারের ব্যর্থতা তুলনামূলকভাবে আরও প্রকটভাবে ধরা পড়েছে মানুষের কাছে।
বাংলাদেশে দল মানেই একক নেতৃত্বকেন্দ্রিক। সরকার মানেও তা-ই। অনেক দেশেই তা নয়। আমেরিকায় ওবামার জনপ্রিয়তা যতটা ওঠানামা করে, রিপাবলিকান পার্টির ততটা হয় না। ব্রিটেনে একসময় লেবার পার্টির জনপ্রিয়তার ভাটার সময়েও টনি ব্লেয়ার জনপ্রিয় ছিলেন। বাংলাদেশে সংগত কারণেই তা হওয়ার কথা নয়। জরিপে তাই দলের মতো জনপ্রিয়তা কমতির দিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনারও। জনপ্রিয়তার বিচারে আওয়ামী লীগের চেয়ে এখন বিএনপির ব্যবধান ৭ শতাংশ। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে কাকে দেখতে চান, এই প্রশ্নের উত্তরে শেখ হাসিনা (৪৮ শতাংশ) খালেদার (৪০ শতাংশ) চেয়ে প্রায় একই রকমভাবে ৮ শতাংশ এগিয়ে এখন। এখানেও চট্টগ্রামে খালেদা এগিয়ে, বাকি তিনটি বিভাগে হাসিনা এগিয়ে। বিভাগভিত্তিক জরিপে বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তরে রাজশাহীর লোকজন এখন পর্যন্ত সরকার ও আওয়ামী লীগের প্রতি সবচেয়ে ইতিবাচকভাবে ভোট দিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রিত্বের ক্ষেত্রেও রাজশাহী বিভাগে হাসিনা এগিয়ে ১৬ শতাংশ ভোটে। গোটা দেশে শহরাঞ্চলগুলোয় হাসিনা এগিয়ে মাত্র ২ শতাংশ, গ্রামাঞ্চলে এগিয়ে ৯ শতাংশ। আবার পুরুষদের মধ্যে হাসিনা এগিয়ে ৯ শতাংশ, নারীদের মধ্যে ২ শতাংশ।
দুই নেত্রীর গ্রহণযোগ্যতার হ্রাসবৃদ্ধির চিত্র ফুটে উঠেছে আরও দুটো প্রশ্নে। এবারের জরিপ অনুসারে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনাকে খুব ভালো মনে করেন ৩২ শতাংশ মানুষ, আগের বছর মনে করতেন ৩৯ শতাংশ মানুষ। খালেদা জিয়াকে জাতীয় নেত্রী হিসেবে খুব ভালো মনে করতেন ২৩ শতাংশ মানুষ, এবার তা ২৪ শতাংশ। তাঁদের একদমই ভালো মনে করেন না এমন মানুষের সংখ্যা শেখ হাসিনার ক্ষেত্রে বেড়েছে ৫ শতাংশ, খালেদার ক্ষেত্রে বেড়েছে ১ শতাংশ।
আমার ধারণা, এই জরিপের ফলাফল দুই দলকেই হতাশ করবে। বিএনপি ভাবে, এখন নির্বাচন হলে অবশ্যই আওয়ামী লীগ পরাজিত হবে; আওয়ামী লীগ ভাবে, দল হিসেবে বিএনপি প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। প্রথম আলোর জরিপের ফলাফলে দুই দলের ধারণাই ভুল মনে হয়। এখনো এগিয়ে থাকলেও আওয়ামী লীগের সমর্থন এ বছর উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে, বিএনপির সমর্থন আগের তুলনায় বেড়েছে। কিন্তু সমর্থন মানে গ্রহণযোগ্যতা নয়। দুই দলের প্রতি মানুষের নেতিবাচক মনোভাব বেড়েছে। তাদের সামনে তৃতীয় কোনো বিকল্প নেই। আওয়ামী লীগের প্রতি অসন্তুষ্ট কিছু মানুষ, তাই বিএনপিকে ভোট দেবে বলছেন।
নেতিবাচকভাবে ক্ষমতার পালাবদল আমরা আগেও দেখেছি। সরকার আর আওয়ামী লীগের ব্যর্থতা অব্যাহত থাকলে আগামী নির্বাচনেও হয়তো তা হতে পারে। কিন্তু আমরা চাই, দুই দলের ইতিবাচক প্রতিযোগিতা। সুশাসন প্রদানকারী হিসেবে আওয়ামী লীগ আর সুশাসন প্রদানের সম্ভাবনাময় দল হিসেবে বিএনপির প্রতিযোগিতাই কেবল বাংলাদেশকে প্রত্যাশিত মাত্রায় এগিয়ে নিতে পারে। অন্য কিছু নয়।
আসিফ নজরুল: রাজনৈতিক বিশ্লেষক, গবেষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক।
তারিখ: ০৬-০১-২০১১

অনেক বেশি দেওয়ার কথা ছিল

সরকারের সমালোচনা করি বলে মাঝেমধ্যে কিছু শুভাকাঙ্ক্ষী আতঙ্কিত হন। জানতে চান, ঝামেলা হচ্ছে না কোনো? তাঁদের বোঝাতে কষ্ট হয় যে আসলেই কোনো ঝামেলা হচ্ছে না। আমাদের প্রধানমন্ত্রী নিজে টক শো দেখেন। এ নিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করে তিনি পত্রিকায় লিখেছেন। কোনো কোনো টক শোতে আমাদের বলে দেওয়া হয়, ভাই, প্রধানমন্ত্রী আর তাঁর পরিবারকে বাঁচিয়ে কথা বলবেন, অন্য কারও সমালোচনা করলে অসুবিধা নেই। কিন্তু আমি স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর বহু সমালোচনা করেছি, কিছু সমালোচনা বেশ কড়া ভাষায়। অন্তত আমার এ জন্য কোনো সমস্যায় পড়তে হয়নি এখনো। নেই নেই গণতন্ত্র বলে আক্ষেপ করি আমরা, সেই ম্লান গণতন্ত্রও এটুকু সুরক্ষা দিতে পারে আমাদের অনেককে।
কিন্তু আমাদেরও ভালো কথা বলতে ইচ্ছে করে, তা করতে পারলে ভালোও লাগে। বর্তমান সরকারের এক বছর পূর্তি উপলক্ষে ভয়েস অব আমেরিকা একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিল আমার। তার সংক্ষিপ্ত বিবরণী এখনো আছে তাদের ওয়েব পেইজে। আমারই অবাক লাগে, কত প্রশংসা করা সম্ভব হয়েছিল তখন সরকারের! শুরুটা কী চমৎকারই না ছিল তাদের! বিদেশনীতি আর অর্থনীতির বিভিন্ন বিপর্যয় নেমে আসেনি তখন, রাজনীতিতে হানাহানিও শুরু হয়নি। সরকার প্রথম সভায় সংসদীয় কমিটি করেছে, তার কয়েকটির প্রধান হিসেবে আবার বিরোধী দলের নেতাদের বসিয়েছে, বিরোধী দলের সমালোচনা করা হচ্ছে সংযতভাবে। বিরোধী দল নজিরবিহীনভাবে উদ্বোধনী অধিবেশনে অংশ নিয়েছে, বিরোধীদলীয় নেত্রী সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন কয়েকবার। কিছু ইতিবাচক দিক দেখে আশাবাদী হয়ে উঠেছিলাম আমরা, ভেবেছিলাম ওয়ান-ইলেভেন থেকে হয়তো কিছু উপলব্ধি এসেছে আমাদের নেতাদের।
এখন কি আর এভাবে ভাবতে পারি আমরা? সরকারের তিন বছর মেয়াদ পূর্ণ হতে চলেছে। সুশাসন আর রাজনীতির ক্ষেত্রে গত তিন বছরের মূল্যায়নে কেমন করে শুধু ভালো কথা লিখতে পারে এখন কেউ?

২.
আমার পক্ষে বিশ্বাস করা সম্ভব না যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কল্যাণ চান না দেশের। তবে ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট তাঁর জীবনে যে ভয়ংকরতম দুঃসহ ঘটনা ঘটেছে তার প্রভাব থেকে তিনি হয়তো আজও মুক্ত হতে পারেননি। একই কথা অনেকটা প্রযোজ্য বেগম খালেদা জিয়ার ক্ষেত্রেও। আমার ধারণা, তাঁদের পক্ষে রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে একটি পর্যায়ে ব্যক্তিগত তিক্ততা আর রাজনৈতিক বৈরিতা কিছুতেই ভোলা সম্ভব হয় না। সুশাসন আর জনকল্যাণের চিন্তা আর সার্বিকভাবে করতে পারেন না, দেশ মানে তাঁদের কাছে শুধুই আওয়ামী লীগ কিংবা শুধুই বিএনপি। বিরোধী দল মানে প্রতিপক্ষ; প্রতিযোগী নয়, অংশীদার তো নয়ই। ক্ষমতা মানে তাই তাঁদের কাছে বিরোধী শিবিরকে দমন-পীড়ন আর নির্যাতনের প্রাধিকার। যা ঘটে বিএনপির আমলে, অনেকটা একই ঘটনা ঘটে আওয়ামী লীগের আমলে। বরং প্রতিযোগিতামূলক কুশাসনের মাত্রা বাড়ে, নাভিশ্বাস ওঠে মাঝখানে থাকা জনগণের।
তাই বলে ভালো কিছু একদম হয় না তা নয়। কিন্তু তা মোটেও যথেষ্ট নয়। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে পাঁচটি অগ্রাধিকারের একটি ছিল সুশাসন। আমরা যদি পর্যালোচনা করি তাহলে দেখব, এর খুব অল্প বাস্তবায়িত করতে পেরেছে সরকার। নির্বাচনী ইশতেহারের ঘোষণামতো সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস আর জঙ্গিবাদ থেকে দেশকে অনেকাংশে মুক্ত করেছে বর্তমান সরকার। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার হয়েছে, কিন্তু যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চলছে খুঁড়িয়ে, জাতীয় চার নেতার হত্যাকাণ্ডের বিচার আরও ম্লানভাবে।
আওয়ামী সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ ছিল তাদের নির্বাচনী অঙ্গীকার অনুসারে ‘বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ করা, দলীয়করণমুক্ত অরাজনৈতিক গণমুখী প্রশাসন গড়ে তোলা, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন কঠোরভাবে বন্ধ করা’। এগুলো বড় চ্যালেঞ্জ, কারণ ১৯৯০ সালের পর থেকে প্রতিটি সরকার এসব দায়িত্ব পালনে ক্রমাগত আরও বেশি ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে আসছিল। আওয়ামী লীগের আমলে একই নিম্নমুখী ধারা অব্যাহত থেকেছে। বাড়তি বা নতুন উদ্বেগের বিষয় ছিল গুম ও গুপ্তহত্যার মতো নিকৃষ্টতম মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা, ঘোষণা দিয়ে ঢালাওভাবে দলের লোকদের বিভিন্ন চাকরিতে নিয়োগ, নির্বিচারে দলের লোকদের বিরুদ্ধে সব মামলা প্রত্যাহার, এমনকি ব্যাপকসংখ্যক দণ্ডিত অপরাধীকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমা প্রদর্শন। নরসিংদীর মেয়র লোকমান হত্যাকাণ্ডে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে বিএনপির একজন নেতাকে সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিকভাবে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, অথচ এজাহারভুক্ত একজন শীর্ষস্থানীয় আসামিকে (যিনি একজন মন্ত্রীর ভাই) পুলিশ আজও গ্রেপ্তার করতে পারেনি। দলের শাসন কতটা নগ্নভাবে জেঁকে বসেছে এটি তার একটি বড় প্রমাণ। এমন প্রমাণ আরও বহু ঘটনায় পাওয়া গেছে। অপরাধ বিচারে আগ্রহের চেয়ে অপরাধের দায় অনেক সময় অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া বা দায় আড়াল করা হলে, চাকরি বা ব্যবসায় মেধা ও যোগ্যতা নয়, দলীয় পরিচয় মুখ্য বিবেচ্য বিষয় হয়ে উঠলে, বিনা বিচারে মানুষ খুন বা উধাও হয়ে গেলে সে রাষ্ট্রে আইনের শাসন বা মানবাধিকার আছে তা বলার কোনো সুযোগ নেই। পরিহাসের বিষয় হচ্ছে, এসব এমন একসময় ঘটছে যখন দেশে একটি কলরবময় জাতীয় মানবাধিকার কমিশন এবং তথ্য কমিশন রয়েছে, সরকার জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলে দ্বিতীয়বার নির্বাচিত হয়েছে এবং দিনবদলের অঙ্গীকারের ভিত্তিতে এই সরকার ক্ষমতায় এসেছে।
সরকারের আরেকটি বড় অঙ্গীকার ছিল ‘বিচার বিভাগের প্রকৃত স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা’। নিম্ন আদালতে কয়েক শ বিচারক আমারই একসময়ের ছাত্র বা সহপাঠী। আমার ধারণা, যেভাবে বর্তমানে দল, স্থানীয় প্রশাসন এমনকি মন্ত্রণালয় থেকে এই আদালতকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করা হয় তা বিএনপির আমলের চেয়ে ভিন্ন কিছু নয়। এই সরকারের প্রথম দিকে নিম্ন আদালতে নিয়োগ হয়েছিল ভালোভাবে, এখন সেখানেও বৈষম্যমূলক মুক্তিযোদ্ধা কোটাব্যবস্থা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। নিম্ন আদালতকে আরও দলীয়করণের চিন্তা থেকে সম্ভবত সেখানে নিয়োগের পূর্বশর্ত হিসেবে দলাদলিতে বিভক্ত বারে আইনজীবী হিসেবে দুই বছর কাজ করার নিয়ম করা হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, উচ্চ আদালতে আগের মতোই অধিকাংশ নিয়োগ হয়েছে দলীয় বিবেচনায় কিংবা মন্ত্রী বা জেলা কোটার ভাগাভাগির ভিত্তিতে। নতুন যা, নজিরবিহীনভাবে শতাধিক সিনিয়র বিচারককে ডিঙিয়ে হাইকোর্টে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, প্রায় অর্ধশত সিনিয়য়কে ডিঙিয়ে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে আপিল বিভাগে। জনস্বার্থকর অনেক মামলায় উচ্চ আদালত প্রশংসনীয় ভূমিকা রেখেছেন, কিন্তু রাজনৈতিকভাবে স্পর্শকাতর মামলায় (যেমন ড. ইউনূসের অপসারণ, খালেদা জিয়ার বাড়ি, মাহমুদুর রহমান আদালত অবমাননা ইত্যাদি) তার বিভিন্ন রায়ের কঠোর সমালোচনা করেছেন দেশের শীর্ষস্থানীয় অধিকাংশ আইনজীবী। উচ্চ আদালতের কয়েকজন বিচারকের আচরণ নিয়েও সমাজে বহু প্রশ্ন উত্থিত হয়েছে, কিন্তু তার প্রতিকার হয়নি।
উচ্চ আদালতের অন্যতম বিতর্কিত ভূমিকা ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারসংক্রান্ত মামলার রায়ে। সারা দেশে একমাত্র জাতীয় পার্টি ছাড়া সব মহল এই সরকারব্যবস্থা রাখার পক্ষে প্রকাশ্য অবস্থান নিয়েছিল। ঠিক তখনি তড়িঘড়ি করে উচ্চ আদালত দুর্বোধ্য এবং পরস্পরবিরোধী এমন একটি আদেশ দিয়েছেন যার সুযোগে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সরকার এই ব্যবস্থাকে বাতিল করতে পেরেছে। দেশে পরবর্তী দুই বছরে রাজনৈতিক হানাহানি, সংঘাত এমনকি অবশিষ্ট গণতন্ত্র হুমকির মধ্যে পড়তে পারে এ কারণে।
দেশের আইন ও বিচারব্যবস্থার অন্যতম প্রধান দায়িত্ব থাকে শাসন বিভাগকে জবাবদিহির মুখোমুখি করা। ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারির মর্মান্তিক পিলখানা হত্যাকাণ্ড থেকে আজ পর্যন্ত সরকারের জন্য বিব্রতকর বিষয়গুলোতে এই দায়িত্ব কতটুকু পালন করা হয়েছে বা পালন করতে দেওয়া হয়েছে তা নিয়ে আরও বহু প্রশ্ন ভবিষ্যতে উত্থাপিত হতে পারে।

৩.
প্রশাসন ও বিচার বিভাগ দলীয়করণ, ক্রসফায়ার, মানবাধিকার লঙ্ঘনসহ বহু ব্যর্থতার মূলে কাজ করেছে অপরাজনীতি। অথচ রাজনৈতিক সংস্কৃতির ইতিবাচক পরিবর্তন ছিল আওয়ামী লীগের অন্যতম নির্বাচনী অঙ্গীকার। তাদের লিখিত অঙ্গীকার ছিল: রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে শিষ্টাচার ও সহিষ্ণুতা গড়ে তোলা হবে, সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজি নিষিদ্ধ হবে, একটি সর্বসম্মত আচরণ বিধিমালা প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে এবং জাতীয় সংসদকে কার্যকর ও সরকারের জবাবদিহি নিশ্চিত করা হবে। আগেই বলেছি, এ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের সূচনা ছিল অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক। কিন্তু এরপর সংসদে কটূক্তি, রাজপথে নির্মম পুলিশি নির্যাতন ও মামলা-হামলার যে ঘটনাগুলো ঘটেছে তা দেশে ব্যাপক রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে। বছরের শেষ দিকে বিরোধী দলকে নির্বিঘ্নে রোডমার্চ করতে দিয়ে সরকার প্রশংসিত হয়েছে, বিএনপিও নেতিবাচক কর্মসূচি কিছুটা পরিবর্তন করে রাষ্ট্রপতির সংলাপ ও সংসদে অংশ নেওয়ার কথা বলেছে। তবে এসব মানুষের উদ্বেগ মোচনের জন্য মোটেও যথেষ্ট নয়। বিশেষ করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও নির্বাচন কমিশন নিয়ে দুই দলের মৌলিক বিরোধ আগামী দিনে রাজনৈতিক অস্থিরতা বৃদ্ধি না করলেই তা বিস্ময়কর হবে।
এক-এগারোর দুঃখজনক অভিজ্ঞতার পর মানুষ রাজনৈতিক দলগুলোর আচরণে বড় ধরনের ইতিবাচক পরিবর্তন আশা করেছিল। এটি হয়নি। আওয়ামী লীগের আমলে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড কিছুটা কমেছে, কিন্তু দমন-পীড়নের অন্যান্য আলামত কমেনি। অন্যদের সম্পর্কে দলের নেতাদের এমনকি প্রধান নেত্রীর কিছু মন্তব্য মানুষকে হতাশ করেছে, বিএনপি নেত্রীও আগের তুলনায় কখনো কখনো মারমুখী মন্তব্য করেছেন। আমার মনে হয় না বাংলাদেশের মানুষ এখন বিশ্বাস করে যে এই দুই নেত্রী আরও একটি অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির আশঙ্কা দূরীকরণে যথেষ্ট সতর্ক আছেন।

৪.
চাইলে এই লেখা আরও ইতিবাচক করা সম্ভব। বিস্তারিতভাবে বলা সম্ভব যে আওয়ামী লীগের আমলে পার্লামেন্টারি কমিটি অনেক বেশি কার্যকর রয়েছে, অধিকাংশ নির্বাচন ঠিকমতো হয়েছে, শিক্ষা ও কৃষি প্রশাসনে গতিশীলতা এসেছে, বিভিন্ন বিধিবদ্ধ কমিশন গঠিত হয়েছে, এমনকি হয়তো দুর্নীতির প্রকোপও কমেছে। বিএনপির আমলের সঙ্গে তুলনা করে আরও কিছু ইতিবাচক উদাহরণও দেওয়া সম্ভব।
কিন্তু আমার কথা হচ্ছে, ২০০৮ সালের নির্বাচনে ভোটাররা খারাপ পূর্বসূরির চেয়ে সামান্য কম খারাপ সরকার প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা থেকে ভোট দেয়নি। আওয়ামী লীগও তাদের নির্বাচনী মেনিফেস্টোতে তা বলেনি। একটি অসাধারণ মেনিফেস্টো রচনা করে তা ব্যাপকভাবে প্রচার করে আওয়ামী লীগ বিশেষ করে তরুণ ভোটারদের মনে বরং নতুন আশাবাদের সৃষ্টি করেছিল।
এই সরকারের ইতিমধ্যেই তিন বছর পার হয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি আপনার মন্ত্রী ও সিনিয়র নেতাদের নিয়ে এই মেনিফেস্টো আরেকবার পড়ে দেখবেন কি?
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

বিশেষজ্ঞ নই, তবু মতামত দিচ্ছি

পিএইচডি নিয়ে পৃথিবীতে নানা গল্প প্রচলিত আছে। এসব গল্প ভালো বলতে পারেন ড. আইনুন নিশাত। তিনি আমাকে একবার বলেছিলেন, পিএইচডি আসলে পাঁচ প্রকার। জালিয়াতি (ব্যাখ্যা নিষ্প্রয়োজন), তেজারতি (টাকা-পয়সা খরচ করলেই যা পাওয়া যায়), খয়রাতি (খয়রাত হিসেবে যা দেওয়া হয়), মারফতি (যে পিএইচডির ব্যাখ্যা মারফতি জ্ঞান ছাড়া সম্ভব নয়) এবং মেহনতি (মেহনত করে পাওয়া)।
আমরা যারা বিদেশে বৃত্তি (যেমন কমনওয়েলথ বা ফুলব্রাইট) নিয়ে পড়াশোনা করেছি, তাদের মেহনতি পিএইচডি করা ছাড়া উপায় নেই। আমার পিএইচডি ছিল আন্তর্জাতিক নদী আইনের ওপর। নদী নিয়ে মানুষ গল্প-কবিতা-গান লেখে, চিত্রকলা করে। আর আমাকে করতে হয়েছে পিএইচডি। আমার এক শ্রদ্ধেয় শিক্ষক বুঝিয়েছিলেন, অর্ধশত আন্তর্জাতিক নদী প্রবাহিত বাংলাদেশের ওপর দিয়ে, কাজেই এটি করা খুব জরুরি। তাঁর বক্তব্য: যৌথ নদী কমিশনে আমার ‘বিশেষজ্ঞ জ্ঞান’ ব্যবহার করে উপকৃত হবে দেশ।
আমার ‘বিশেষজ্ঞ জ্ঞান’ আসলে দেশের তেমন কাজে লাগেনি। বিনয়ের সঙ্গে বলি, দেশের ১৫-১৬ কোটি মানুষের মধ্যে আমি সম্ভবত একমাত্র আন্তর্জাতিক নদী আইনে পিএইচডিধারী। নদী আইন বিষয়ে ক্লুয়ার একাডেমিক পাবলিশার্স কর্তৃক প্রকাশিত বইয়ের অধ্যায় ও জার্নাল অব এনভায়রনমেন্টাল লসহ কিছু উঁচুমানের জায়গায় আমি লিখেছি। পৃথিবীর বিভিন্ন ফোরামে এ বিষয়ে বক্তৃতা দেওয়ার সুযোগও হয়েছে। কিন্তু যে কারণে আমি পিএইচডি করেছিলাম, তা হয়নি। পিএইচডি করে আসার পর বিএনপি-তত্ত্বাবধায়ক-আওয়ামী লীগ সরকারের ১১ বছর অতিক্রান্ত হলো। আন্তর্জাতিক নদী নিয়ে কখনো কোনো সরকার আমাকে মতামত দেওয়ার জন্য ডাকেনি। যৌথ নদী কমিশনে আইনি বিষয়ে পরামর্শ দেওয়ার কাজ করেছেন প্রকৌশলীরা, কিন্তু আমি বা অন্য কোনো আইনের লোক নয়।
সে তুলনায় সাংবিধানিক আইনে আমার জ্ঞান সীমিত। কাজেই সংবিধান সংশোধনবিষয়ক সংসদীয় বিশেষ কমিটিতে মতামত দেওয়ার জন্য আমার মতো কাউকে ডাকা হবে না, এটি স্বাভাবিক। কিন্তু আমার আপত্তি অন্য জায়গায়। সাংবিধানিক আইন দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়ানো হয় বহু বছর ধরে। কমিটি শুধু এটি বিবেচনায় নিয়েও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আইন বিভাগকে মতামত দেওয়ার জন্য আহ্বান জানাতে পারত। পত্রিকায় দেখলাম, মতামত জানানোর জন্য ডাকা হয়েছে শুধু আইনজীবী আর বিচারকদের। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, আইনের গবেষকদের নয় কেন? কেন সামাজিক বিজ্ঞানের গবেষকদেরও নয়? কেন নয় সমাজের বিভিন্ন পেশাজীবীর প্রতিনিধিদের? কেন নয় নারী-শিশু-ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিদের?
সংবিধান সর্বস্তরের মানুষের জন্য। এত ঢাকঢোল পিটিয়ে কাজ করতে থাকা কমিটিতে তাদের কথা শোনার আগ্রহ নেই কারও?

২.
কমিটির কারও আগ্রহ না থাকলে আমরা তো বসে থাকতে পারি না। পত্রপত্রিকায় সংবিধান সংশোধন বিষয়ে বহু মানুষ ইতিমধ্যে মতামত জানিয়েছেন। জানি না এত কিছু পড়ে দেখার ইচ্ছে বা সময় কমিটির হয়েছে কি না। আমি শুধু সংক্ষেপে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু সাংবিধানিক পরিবর্তনের প্রয়োজনের কথা আবারও তুলে ধরছি।
প্রথমত, সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কার্যকাল ও কার্যাবলি সুনির্দিষ্ট করতে হবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে রাষ্ট্রপতি অতিমাত্রায় ক্ষমতাশালী হয়ে পড়েন বলে এই একজন ব্যক্তিকে বাধ্য করে বহু অঘটন করানো সম্ভব। তাই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে রাষ্ট্রপতির ওপর অবশ্যই উপদেষ্টামণ্ডলীর পরামর্শ অনুসারে কাজ করার বাধ্যবাধকতা আরোপ করতে হবে।
দ্বিতীয়ত, নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে প্রধানমন্ত্রী অতিমাত্রায় ক্ষমতা ভোগ করেন বলে কার্যত এক ব্যক্তির সরকার প্রতিষ্ঠিত হয় তখন দেশে। ভারতের সংবিধানে এই ক্ষমতা রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভার মধ্যে বণ্টিত। ভারতের রাষ্ট্রপতি মন্ত্রিসভার পরামর্শ নিয়ে কাজ করেন, আমাদের দেশের মতো শুধু প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ নেওয়ার বাধ্যবাধকতা সেখানে নেই। ভারতে রাষ্ট্রপতি প্রয়োজন মনে করলে এই পরামর্শ পুনর্বিবেচনার জন্য মন্ত্রিসভার কাছে ফেরতও পাঠাতে পারেন। রাষ্ট্রপতি ও মন্ত্রিসভার ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য এসব ভালো বিধানকে বিবেচনায় নেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে।
তৃতীয়ত, আইনসভাকে আরও কার্যকর করার জন্য সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ শুধু আস্থা-অনাস্থা ভোট ও বাজেট পাসের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, এটি সংবিধানে লিখে দেওয়া প্রয়োজন। আফ্রিকা ও পূর্ব ইউরোপের কিছু দেশে অনুরূপ ও প্রতিবেশী পাকিস্তানে অবিকল এ ধরনের বিধান রয়েছে।
চতুর্থত, নিম্ন আদালতের স্বাধীনতার জন্য ১৯৭২ সালের সংবিধানের ১১৫ ও ১১৬ অনুচ্ছেদ অবিকলভাবে ফিরিয়ে আনতে হবে। পঞ্চম সংশোধনী মামলায় স্বয়ং আপিল বিভাগের কাছে এটি করার সুযোগ ছিল। কিন্তু তাঁরা এটি করতে আশ্চর্যজনকভাবে অনীহ ছিলেন। এখন সংসদও এটি করতে ব্যর্থ হলে বিচার বিভাগের কাজে নানাভাবে হস্তক্ষেপ করার সুযোগ অব্যাহত থাকবে।
পঞ্চমত, উচ্চ আদালতের জবাবদিহি প্রতিষ্ঠা করতে হলে ১৯৭২ সালের ৯৬ অনুচ্ছেদ ফিরিয়ে আনতে হবে। ওই অনুচ্ছেদে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদকে দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশে সংসদ নির্বাহী বিভাগের আজ্ঞাবহ বলে এই ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের কাছেই রাখতে চান কেউ কেউ। কিন্তু আমাদের প্রশ্ন হলো, এই কাউন্সিল কি সত্যিই তার দায়িত্ব পালন করে? কোনো কোনো বিচারপতির বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ শোনা যায়, কিন্তু কাউন্সিলকে আমরা কদাচিৎ কাজ করতে দেখি। কাজেই সংসদের কাছে এ ক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়ার বিধানে আপত্তির কোনো যুক্তিসংগত কারণ নেই। এ ছাড়া সংবিধানের ৯৫ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে উচ্চ আদালতের বিচারক পদে প্রার্থীদের যোগ্যতা অবশ্যই সুনির্দিষ্ট ও বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করতে হবে। এতে সর্বোচ্চ আদালতে অযোগ্য ও রাজনৈতিক ব্যক্তিদের নিয়োগের সম্ভাবনা হ্রাস পাবে।
সংবিধানে আরও বহু সংশোধনীর প্রয়োজন রয়েছে। সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারগুলো আমাদের সংবিধানে যথেষ্টভাবে বর্ণিত হয়নি, সুরক্ষিতও হয়নি। সংবিধানে লিগ্যাল এইড, শ্রমিকদের জীবনধারণক্ষম ন্যূনতম মজুরি, মা ও শিশুদের জন্য বিশেষ সুযোগ-সুবিধা, পরিবেশ রক্ষা এবং ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীগুলোর সাংসৃ্কতিক অধিকারের কোনো সুনির্দিষ্ট উল্লেখ নেই। আমাদের সংবিধানে নিবর্তনমূলক আটকের বিধান ভারত বা পাকিস্তানের চেয়ে অনেক বেশি কঠোর ও স্বৈরতান্ত্রিক। সংবিধানে সংসদের ন্যূনতম অধিবেশন বা কার্যদিবসের কথা বলা হয়নি, অনুমতি না নিয়ে সংসদে একাদিক্রমে ঊননব্বই বৈঠক দিবসে অনুপস্থিত থাকার সুযোগ রয়েছে, ধর্মপালনের অধিকারের ক্ষেত্রে বৈষম্য আছে আমাদের সংবিধানে। গত কয়েক বছরে নাগরিক সমাজ, পেশাজীবী, গণমাধ্যম এমনকি বড় দুই দলের অনেক নেতা এসব বিষয়ে সংবিধান সংশোধনীর প্রয়োজনের কথা বলেছেন। এখন তা ভুলে যাওয়া ঠিক হবে না।
৩.
সংবিধান সংশোধনের পাশাপাশি আরেকটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ করার প্রয়োজন রয়েছে। আমরা ৩৯ বছর ধরে এটি করতে ব্যর্থ হয়েছি সংবিধানের সুস্পষ্ট নির্দেশনা সত্ত্বেও। যেমন—সংবিধানের ৭৬ অনুচ্ছেদে রয়েছে সংসদীয় কমিটি তার কাছে কোনো ব্যক্তিকে হাজির হতে (বা দলিল উপস্থাপনের জন্য) নির্দেশ দেবেন, এই ক্ষমতা সংসদ আইন দ্বারা কমিটিগুলোকে প্রদান করবে। বর্তমানে সংসদীয় কমিটিগুলো বিভিন্ন ব্যক্তিকে হাজির হওয়ার জন্য নির্দেশ দিচ্ছেন এ ধরনের কোনো আইন ছাড়াই। এই আইনটি করতে অসুবিধা কী? সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদে আছে, প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য কমিশনারকে রাষ্ট্রপতি ‘উক্ত বিষয়ে প্রণীত কোন আইনের বিধানাবলী-সাপেক্ষে’ নিয়োগদান করবেন। সুশাসনের স্বার্থে সংবিধানে এ রকম আরও কয়েকটি জায়গায় আইন প্রণয়নের নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু সংসদ এসব আইন প্রণয়ন করেনি। সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ পুনঃস্থাপিত হলে তার অধীনে বিচারপতিদের অপসারণের পদ্ধতিসংক্রান্ত একটি আইনও করতে হবে। এসব আইন প্রণীত না হওয়ায় শুধু বাহাত্তরের সংবিধানের চেতনা ও প্রত্যাশা খর্বিত হচ্ছে না, গণতন্ত্রের ভিতও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
১৯৭২ সালের সংবিধানের একটি মূল প্রত্যাশা ছিল সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় প্রশাসন ও বিচারব্যবস্থাকে নিয়ে যাওয়া। এর ১০০ অনুচ্ছেদে প্রধান বিচারপতিকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে হাইকোর্টের অস্থায়ী অধিবেশন বসানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এটি করা হলে সারা দেশের মানুষকে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ঢাকায় ছুটে আসার দুর্ভোগে পড়তে হতো না। গত প্রায় ৪০ বছরে আমাদের প্রধান বিচারপতিরা এই জনস্বার্থমূলক কাজটি করতে ব্যর্থ হয়েছেন। তাই বলে এ ক্ষেত্রে কি সংসদেরও কিছু করার নেই? সংবিধান সংশোধনীবিষয়ক বিশেষ কমিটি এ বিষয়ে নজর দেবে কি?

৪.
কমিটির কাছে আরেকটি অনুরোধ সংবিধান সংশোধনী বিষয়ে তাড়াহুড়ো না করার জন্য। তথ্যপ্রযুক্তি, তথ্য অধিকার, ডিজিটাল বাংলাদেশ—এসব কথা এই সরকারের কাছে আমরা সবচেয়ে বেশি শুনি। এ লক্ষ্যে সরকার কিছু গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগও নিয়েছে। সংবিধান সংশোধন কমিটি কি পারে না একটি ওয়েব পাতা খুলে এবং একই সঙ্গে নির্দিষ্ট নম্বরে ফোন ও এসএমএস করে সব নাগরিককে মতামত পেশের সুযোগ দিতে?
আমি বিশ্বাস করি, কমিটি চাইলেই তা করতে পারে। চাইলে আরও বহু ভালো নজির স্থাপন করা যায়। এই কমিটিতে সাজেদা চৌধুরী, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, তোফায়েল আহমেদের মতো ১৯৭২ সালের সংবিধানপ্রণেতারা আছেন। তাঁদের কাছে আমাদের প্রত্যাশা অনেক।
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
তারিখ: ২২-০৪-২০১১